মির্জা ফখরুল : দলমত নির্বিশেষে ‘গণঐক্য’ গড়ার আহ্বান

আগের সংবাদ

পরিবেশবাদীদের ক্ষোভ প: সুনামগঞ্জে একসঙ্গে ৩ হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ

পরের সংবাদ

রমজান ও ব্যবসায় নৈতিকতা : ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আবহমানকাল থেকে ব্যবসা একটি মহৎ পেশা। ঐতিহ্যিক এ পেশার মাধ্যমে মানবসেবার মহান ব্রতও পালনের বহু নজির রয়েছে বিশ্ব-ইতিহাসে।
মানবেতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের অনেকেই জীবন-জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে এ ব্যবসাকেই বেছে নিয়েছিলেন। বহু পয়গম্বরের জীবনেতিহাসেও ব্যবসা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মানবজীবনের মহত্তর এ পেশার গুরুত্ব সম্বন্ধে তাই ইসলামের মহান পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদের (সা.) দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ছিল এরূপ- ‘আত্ তাজিরুস্ সুদুকুল আমিন মাআন্নাবিয়্যিনা ওয়াস্ সিদ্দিকিনা ওয়াশ্ শোহাদায়ে ওয়াস্ সালেহিন’ অর্থাৎ সত্যবাদী ও আমানতদার (বিশ্বস্ত) ব্যবসায়ী কেয়ামতের কঠিন ময়দানে নবী-রাসুল, সিদ্দিক (সত্যনিষ্ঠ), শহীদ ও নেককার মানুষজনের সঙ্গে অবস্থান করবেন। রাসুলে পাকের (সা.) এই একটি মাত্র বাণীর বদৌলতে আমরা ব্যবসায়ীগণের উচ্চতর মর্যাদা ও অবস্থানের বিষয়ে সম্যক অবহিত হতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরকালীন জীবনে জবাবদিহিতার অনুভূতি যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে সে ব্যক্তি কখনোই অবিশ্বস্ত, মজুতদার ও শুধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী হতে পারে না। মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ যারা অন্যায় ও চাতুর্যের সঙ্গে স্বল্প পরিশ্রমে অধিক মাত্রায় ভক্ষণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে- এরা আসলে ব্যবসায়ী নয়, অমানবিকতার ঘৃণ্য প্রতিবিম্ব মাত্র। দেশের মানুষের সামষ্টিক স্বার্থ ও অধিকারকে জলাঞ্জলি দিয়ে, পদপিষ্ট করে এরা গুটিকয়েক নিজেদের আখের গোছায়; সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। অতি সম্প্রতি এবং প্রতি রমজানেই পেঁয়াজ ও চালসহ দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্য নিয়ে একশ্রেণির স্বার্থপর ব্যবসায়ী যে অমানবিকতার মহড়া দিয়ে যাচ্ছে- তা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। অতি লোভ, অতি মুনাফা অর্জনের খায়েশ, পরিস্থিতির সুযোগ নেয়া, জবাবদিহিতার ভয় না থাকা ও আইনের আওতায় আসার আশঙ্কাহীনতাই এদের দিনে দিনে রাঘব বোয়ালে পরিণত করেছে।
ধর্মের মর্মবাণীর অনুসরণ আর নৈতিকতার মানোন্নয়ন একনিষ্ঠভাবে বিশ্বাস ও পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম-দর্শনই মানবতার কথা, মানবপ্রেম ও মানবসেবার কথা পরিব্যক্ত করেছে। কিন্তু এসব অমানবিক হৃদয়ের অধিকারী মানুষেরা না কোনো ধর্মের মর্মবাণীর অনুসরণ করে আর না কোনো নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধার ধারে। কথায় আছে- চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী; অন্যায় ও অসৎ পথে মানুষকে জিম্মি করে অর্থ উপার্জনই হলো এদের মূল ব্রত। ব্যবসায়িক মূলনীতির বহু কথা ধর্মীয় অনুশাসনে ও নীতিবিধানের শাস্ত্রীয় পরিমণ্ডলে বিবৃত রয়েছে; সেসব দিকে এদের কোনো খেয়াল নেই। আর সেজন্যই ব্যবসার মতো মহত্তর এ পেশা আজ অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত-ক্ষতবিক্ষত; পার্থিব জীবনে মানবিকতার প্রতি গভীর মমত্ববোধের শিক্ষা এবং পরকালীন জীবনে কঠিন শাস্তি ভোগের ভীতিকর অনুভূতিই পারে চলমান অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে।
পবিত্র কুরআনে কারিমে মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘আহাল্লাল্লাহুল বায়আ ওয়া র্হারামার রিবা’ অর্থাৎ আল্লাহপাক ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। বেচাকেনার এই পদ্ধতি অবশ্যই মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত হতে হবে; ভোক্তা সাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ধর্ম ও মানবতার সব বিচারেই অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। কালোবাজারি, মজুতদারি, কৃত্রিম সংকট তৈরি, অধিক মুনাফাখোরি- এ সবই ব্যবসায়িক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের পরিপন্থি। মানবতার মহান দূত রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি আমদানিকৃত পণ্য অধিক মূল্যে বিক্রির আশায় তা মজুত করে রাখে, মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। আর যে ব্যক্তি পণ্যদ্রব্য প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী বিক্রি করে, তার ওপর আল্লাহপাকের রহমত বর্ষিত হয়। তিনি আরো বলেন, কোনো ব্যক্তি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হলে মহান আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন আগুনের হাড়ের ওপর বসিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দেবেন। ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি শরিফের হাদিস অনুযায়ী কোনো জনপদে খাদ্য দ্রব্যাদি মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে তথাকার অধিবাসীদের মধ্যে অনাহার, মহামারি, খরা, দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। মজুতদার ব্যক্তিকে রাসুল (সা.) মানুষ হিসেবে খুবই নিকৃষ্ট বলে আখ্যা দিয়েছেন; যে কি-না জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাসে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে নিজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়! কৃত্রিম সংকট কাজে লাগিয়ে আর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যেসব ব্যবসায়ী পণ্যদ্রব্যের অধিক মূল্য গ্রহণ করে, তারা অতিরিক্ত অর্থ যেন সুদ হিসেবেই নিয়ে থাকে; ভোক্তাদের কাছ থেকে গৃহিত অতিরিক্ত টাকা সুদ গ্রহণের মতোই পাপের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। মুসলিম শরিফের বর্ণনা মতে, নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুত করার মধ্য দিয়ে মানুষের রিজিক যারা সংকোচিত করবে তারা বড় অপরাধী; মহান আল্লাহর দরবারে তাদের নিশ্চিতভাবে পাপী হিসেবেই দাঁড়াতে হবে। মেশকাতের অপর বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি কোনো খাদ্য দ্রব্য চল্লিশ দিন গুদামজাত রাখবে, পরবর্তীতে সমপরিমাণ খাদ্য দান করলেও এর পাপের দায় শোধ হবে না। এমনকি ইবনে মাজাহ শরিফের বর্ণনা মতে, এসব মজুতদার আল্লাহর অভিশাপের কারণ হবে। মুসনাদে আহমাদের ভাষ্যমতে, মজুতদার ব্যক্তির সঙ্গে মহান আল্লাহর সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। রাসুলে পাকের নক্ষত্রতুল্য সাহাবায়ে কেরামও মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে হজরত উমর (রা.) ও হজরত উসমান (রা.) সব ব্যবসায়ীকে পণ্য মজুতের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিলেন। আমিরুল মোমেনিন হজরত আলি (রা.) মজুতকৃত খাদ্যদ্রব্য আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিয়েছিলেন, যেন পরবর্তীতে আর কেউ পণ্য মজুত করার দুঃসাহস না দেখায়। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামের চার মাজহাবের মহান ইমামগণও মজুতদারির বিষয়ে ফতোয়া দিতে গিয়ে সহমত ব্যক্ত করেছেন; মজুতদারিকে তাঁরা সবৈব হারাম বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং ইসলামে খাদ্যসামগ্রী বা কোনো একটি পণ্য গুদামজাত করে বা মজুত রেখে অধিক লাভের নেশায় মানুষকে কষ্ট দেয়া কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়; বরং এটি সব যুগে সব সমাজে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আমরা অন্তত এই পবিত্র রমজানে আশা করেছিলাম যে, দেশের ব্যবসায়ীগণ নিত্যপণ্যের মূল্যকে স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু অধিকাংশের কাছেই মুনাফাখুরিটাই গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে রমজানের এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ভোক্তা রোজাদারদের কষ্ট দিয়ে তারা অধিক পরিমাণে নিজেদের লাভবান হওয়ার বিষয়েই সদা তৎপর থেকেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাহে রমজান উপলক্ষে বিশেষ মূল্যছাড় দেয়া হয়; এমনকি অনেক অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও পবিত্র রমজানের কারণে দ্রব্যমূল্যের হ্রাস ঘটানো হয়। রমজানের প্রতি সম্মান জানিয়ে অন্যরা মূল্যহ্রাস করলেও আমাদের দেশে কখনোই আমরা এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণের নজির দেখতে পাইনি; উপরন্তু রমজানকে অধিক লাভের সময় মনে করে প্রতিটা নিত্যপণ্যের দাম আরো অনেক বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং পুরো প্রক্রিয়াটিই পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন করা হয়- আমাদের এ এক নিদারুণ বাস্তবতা, দুর্ভাগ্য।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়