** কৃতকার্য ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ ** জিপিএ ৫ কমেছে ** ইংরেজি-অর্থনীতিতে ফেল বেশি **
অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : করোনার সময় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার যেখানে ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, করোনার পরের বছরই একই পরীক্ষায় ওই বিষয়ে পাসের হার নেমে এসেছে ৯০ শতাংশের নিচে। এতে সার্বিক ফলাফলে পাসের হারসহ জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যা কমেছে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে শুধু ঢাকা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৯২.৩৩ এবং কুমিল্লা বোর্ডে ৯৪.৬৪ শতাংশ। এর বাইরে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৯৫ শতাংশের ওপরে। গতকাল বুধবার ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম বোর্ডে বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে কম পরীক্ষার্থী পাস করেছে অর্থনীতি প্রথম পত্রে, ৭৯ দশমিক ৭১ শতাংশ। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে ৮২ দশমিক ৯৬ ও প্রথম পত্রে ৯০ দশমিক ৭৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। যুক্তিবিদ্যায় ৮৯ দশমকি ৬০ শতাংশ পাস করেছে। বাকি অধিকাংশ বিষয়ে পাসের হার ৯০ শতাংশের ওপরে প্রায় শতভাগের কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাধারণত গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সাম্প্রতিক সময়ে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ভীত থাকে। এর প্রভাব পড়ে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে। করোনার সময় সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এবং কম সংখ্যক বিষয়ে পরীক্ষা হওয়ায় কঠিন এই বিষয়গুলোর পাসের হার ওইভাবে চোখে পড়েনি কিন্তু করোনাকাল কাটিয়ে ওঠার পরই সেই বিষয়গুলোর চিত্র ফের সামনে চলে আসে। যার প্রভাব পড়েছে এবারের ফলাফলে। তাদের মতে, করোনা মহামারির কারণে এসএসসি ও এইচএসসির পুরো শিক্ষাপঞ্জি এলোমেলো হয়ে গেছে। ২০২১ সালে নেয়া হয়েছিল তিন বিষয়ে পরীক্ষা। ২০২২ সালের পরীক্ষায় বিষয় বাড়লেও তা হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলে গড় পাসের হার ৮৫
দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০২১ সালে যা ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। সেই হিসাবে পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। একই সঙ্গে জিপিএ ৫ ও কমেছে।
এর আগে গতকাল দুপুরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। গতবারের তুলনায় এবারে কমেছে পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এবার পাস করেছে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। গত বছর এই পরীক্ষায় ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। সেই হিসাবে এবার পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ শিক্ষার্থী। গত বছর ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছিল। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১২ হাজার ৮৮৭ জন। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফলাফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, এইচএসসিতে ৯ বিভাগে এবার ৮৪ দশমিক ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে আলিমে ৯২ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডের ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। এ বছর বন্যাসহ বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় গত ৬ নভেম্বর। এতে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা বোর্ড ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেয় মোট ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন শিক্ষার্থী। এ বছর ২ হাজার ৬৪৯টি কেন্দ্র ও ৯ হাজার ১৮১টি প্রতিষ্ঠানে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন বোর্ডে ইংরেজি প্রথম পত্রে প্রায় ১০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় পত্রে ১৭ শতাংশেরও বেশি পরীক্ষার্থী ফেল করেছেন। বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা তিন বিভাগের পরীক্ষার্থীরাই ইংরেজিতে খারাপ ফল করায় সামগ্রিক ফলাফলে প্রভাব পড়েছে। এছাড়া অর্থনীতি প্রথম পত্রেও প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। তবে কর্মকর্তারা করোনার সময়ের ২০২০ ও ২০২১ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে এবারের ফলাফলের তুলনা না করার অনুরোধ করেছেন। তারা বলেছেন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের সঙ্গে তুলনা করলে এবার বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড এগিয়ে গেছে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি। জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নে শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করে। ২০২১ সালেও একই কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পিছিয়ে ডিসেম্বরে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে ছয়টি পত্রে এইচএসসি পরীক্ষা হয়েছিল।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড এবার ভালো করেছে। তবে অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের চেয়ে আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ হচ্ছে- ইংরেজি প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্রে পরীক্ষার্থীরা তুলনামূলক রেজাল্ট খারাপ করেছে। প্রান্তিক পর্যায়ে ইংরেজিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংকট আছে। মানসম্মত পাঠদানের বিকল্প নেই। তারপরও আমরা বিষয়টি যাচাইবাছাই করে দেখব।
তিনি বলেন, বেশি ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে গ্রামগঞ্জের বেসরকারি কলেজগুলো থেকে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়লেই হয় না, সেগুলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হয়। এসব কলেজে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংকট আছে। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার অনেক অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় সেখানেও ভালো শিক্ষকের অভাব আছে।
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেন, এবার পাসের হার কমার মূল কারণ বেশি বিষয়ে পরীক্ষা হওয়া। পাসের হার কমার এ ধারা আরো কয়েক বছর থাকবে। কেননা অটোপাশ ও তিন বিষয় পরীক্ষা নেয়ার মধ্য দিয়ে পাসের হার অনেক বেড়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালে এইচএসসি পরীক্ষা পুনর্বিন্যাস পাঠ্যসূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পরীক্ষা ছাড়া বাকি ১২ বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে পরীক্ষা হয় শুধু নৈর্বাচনিক তিন বিষয়ে। আর ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে পরীক্ষা না নিয়ে সবাইকে অটোপাশ দেয়া হয়। সাধারণত প্রতি বছর এপ্রিলে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হলেও বন্যাসহ বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে যাওয়া এই পাবলিক পরীক্ষা ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর শুরু হয়। এতে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা বোর্ড ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে ছয় লাখ ২২ হাজার ৭৬৯ জন ছেলে ও পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ৬১১ জন মেয়ে। এ বছর দুই হাজার ৬৪৯টি কেন্দ্র ও ৯ হাজার ১৮১টি প্রতিষ্ঠানে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
বেশি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় পাসের হার কমেছে বলে মনে করেন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, গতবারের চেয়ে এবার গড় পাসের হার ৯ শতাংশের বেশি কমেছে। এর মূল কারণ ২০২১ সালের তুলনায় বেশি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া। তবে গত পাঁচ বছরের ফল বিশ্লেষণ করলে বলা যায় ফল সন্তোষজনক।
শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমেছে : গত বছরের তুলনায় কমেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। আর বেড়েছে শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমেছে ৩১ শতাংশ। ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ২ হাজার ৬৩৭ কেন্দ্রে অংশ নেয় ৯ হাজার ১৩৯টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে শতভাগ পাস করেছে ১ হাজার ৩৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। গতবার এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৩৪। গতবারের তুলনায় শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৬০৪টি। এছাড়া এবার শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০টি। যা গতবার ছিল ৫টি। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৪৫টি। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই নন এমপিওভুক্ত। এদের মধ্যে কোনোটিতে ১ কিংবা দুজন শিক্ষার্থী। এই একজন শিক্ষার্থী ফেল করলেই শতভাগ ফেলের তকমা প্রতিষ্ঠানের গায়ে পড়ে। তবে বিষয়টি আমরা বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে শূন্যপাস করা প্রতিষ্ঠান কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছি।
জিপিএ ৫ কমেছে : এবার কমেছে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন শিক্ষার্থী। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন। অর্থাৎ জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কমেছে ১২ হাজার ৮৮৭ জন।
পাস ও জিপিএ ৫ এ এগিয়ে মেয়েরা : বরাবরের মতো এবারো জিপিএ ৫ ও পাশের হারে এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা। সব শিক্ষা বোর্ডে উত্তীর্ণ মোট ছাত্রের চেয়ে ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি ছাত্রী পাস করেছে। আর ১৫ হাজার ১৬০টি বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে ছাত্রীরা।
ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় এবার ছাত্রীদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮৬৫ জন ছাত্রী পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন প্রায় পাঁচ লাখ। অন্যদিকে ছাত্রদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ৬ লাখের বেশি ছাত্র পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন ৫ লাখের বেশি। আর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে উত্তীর্ণ মোট ছাত্রের চেয়ে ৩৭ হাজার ২৩২ জন বেশি ছাত্রী উত্তীর্ণ হয়েছে। এবং ছাত্রের চেয়ে ১৫ হাজার ১৬০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছে।
শীর্ষে কুমিল্লা, পিছিয়ে দিনাজপুর : ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হারে শীর্ষে অবস্থানে আছে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে গড় পাসের হার ৯০ দশমিক ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে পাসের হার কম দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড, ৭৯ দশমিক ০৮ শতাংশ। পাসের হার কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ইংরেজি পরীক্ষার ফল তুলনামূলক খারাপ হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে গড় পাশের হারে। আশা করি ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে ভালো করবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।