যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে চায় বাংলাদেশ

আগের সংবাদ

পুঁজিবাজারে ধস গুজব ও আতঙ্কে : ডলারের অস্থিরতায় শেয়ার বিক্রি করছে বিদেশিরা, যাচাই-বাছাই করে মার্জিন ঋণ দেয়ার দাবি

পরের সংবাদ

জীবনযাত্রায় চাপ আরো বাড়বে : গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব : শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে > সব পণ্যেরই দাম বাড়বে

প্রকাশিত: মে ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : করোনার ধাক্কা এখনো অনেকে সামলে উঠতে পারেননি। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সব পেশায় কমবেশি কিছু লোকজন চাকরি হারিয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিসহ নানা কারণে দ্রব্যমূল্যের পারদ চড়ছেই। আজ ভোজ্যতেল তো কাল পেঁয়াজ, তার পরদিন রসুন কিংবা আদা- এভাবেই বাজারকে অস্থির করে রেখেছে ভোগ্যপণ্য। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তার প্রতিঘাত অনেক দূর পর্যন্ত গড়াবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে দেশের শিল্প খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে, উৎপাদন খরচ ১০-১২ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করছে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মতে, এর ফলে বহুমাত্রিক মূল্যস্ফীতি উসকে দিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে এবং উন্নয়নের চলমান ধারা মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হবে। ব্যবসায়ী নেতা বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ভোরের কাগজকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দেখেছি, তাতে আমাদের ১০ থেকে ১২ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বর্তমানে সারাবিশ্বের পরিস্থিতি মন্দার দিকে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়াতে চাইলে বায়ারদের কাছ থেকে তা পাব না। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্য পণ্যের চাহিদা অনেকটাই কমে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দাম আরো বাড়ালে রপ্তানি খাত হুমকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, আমরাও বুঝতে পারছি, দাম বাড়াতে হবে। তবে দাম বাড়ানোর এখন সঠিক সময় নয়। সরকারের সিস্টেম লস আছে, সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয়নি- এসব বিষয়ে নজর দিলে এ খাতে ভর্তুকি আরো কমানো সম্ভব বলে মনে করি।

করোনাকালে সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা চাপে পিষ্ট। ঠিক সেই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিক্রেতা কোম্পানিগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যগুলোর দাম ফের বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, চলতি অর্থবছরেই সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ৭০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন। বিশাল পরিমাণ এ ভর্তুকি বহন করা অসম্ভব। ফলে আগামী বাজেটের আগেই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। এজন্য গ্যাস বিক্রেতা কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে একটি অবাস্তব প্রস্তাব পেশ করেছে, যেখানে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি করার কথা বলা হয়েছে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সঠিক নীতি, সময়মতো রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বন্ধ, দুর্নীতি, অহেতুক অপচয় ও সিস্টেম লস- এগুলো কীভাবে সংশোধন করা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। এগুলো জনগণের উপরে চাপিয়ে দিলে হবে না। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, তাতে সরকারের উপরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে তা সামঞ্জস্য করার এখনই সময় কিনা তা ভেবে দেখা উচিত। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা দাম বেড়েছে। এটা ভর্তুকির মাধ্যমে সমন্বয় করা যেতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশাহারা। এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়লে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও সেবা খাতে খরচ বাড়বে। নিত্যপণ্যের দাম আরো বাড়বে। মানুষের মাসিক খরচ বাড়বে- যা বহন করার সক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর ফলে ভোক্তা-উৎপাদক সবার ওপর আরো চাপ পড়বে। সুতরাং এখন দাম না বাড়িয়ে কিছুটা শুল্ক সমন্বয় করা, কিছুটা দক্ষতা বাড়ানো- এসবের মাধ্যমেও দাম সহনীয় করা সম্ভব।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিমউদ্দিন বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবে শিপিং খরচ বেড়েছে। একই কারণে উৎপাদন ব্যয়ও অত্যধিক বেড়ে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ওপর। একইভাবে রপ্তানি শিল্পে উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। এতে রপ্তানি কমে যেতে পারে। ফলে ব্যাংকিং খাতের অর্থপ্রবাহে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়ার আশঙ্কাকে বিবেচনায় নেয়াটা জরুরি। এছাড়া মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাবে জনজীবনে নেমে আসতে পারে হতাশা। সর্বোপরি অর্থনীতির চলমান ধারাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত বছরের শেষদিকে ডিজেল- কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়। সেই রেশ এখনো কাটেনি। ফের সামনে আসছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ। পেট্রোবাংলা দাবি করেছে, মিশ্রিত গ্যাসের পাইকারি ব্যয় (২০২২ সালে প্রতি ঘনমিটার) ১৫ দশমিক ৩০ টাকায় গিয়ে ঠেকবে। এ কারণে তারা ১১৭ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে। তবে বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর পক্ষে মতামত দেয় গণশুনানিতে। সবশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানোর আদেশে (২০১৯ সালে) পাইকারি দর প্রতি ঘনমিটার ১২ দশমিক ৬০ টাকা করা হয়। ভর্তুকি দিয়ে ৯ দশমিক ৭০ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেয় বিইআরসি। মার্চে টানা ৪ দিনব্যাপী গ্যাসের দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেই রিপোর্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে, যে কোনো দিন ঘোষণা আসতে পারে।
অন্যদিকে গত বুধবার (১৮ মে) বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যুতের দাম ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি টিম। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) প্রস্তাব ছিল ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ানোর। এর বিপরীতে যাচাই-বাছাই করে ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে কারিগরি টিম। তবে সরকার যদি ভর্তুকি দেয় তাহলে দাম না বাড়িয়ে আগের মতোই রাখা যেতে পারে।
ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেছেন, সামগ্রিকভাবে ৮ শতাংশের ওপর সিস্টেম লস দেখানো হচ্ছে; বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের ওপর সিস্টেম লস নেই। দৈনিক কমবেশি ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাইপলাইনে দেয়া হচ্ছে। এখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে গড়ে মাত্র ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে- যে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে যে পরিমাণ গ্যাস ৫-৬ ডলারে পাওয়া যেত এখন সেই গ্যাস কিনতে হচ্ছে ৩১ ডলার দিয়ে।
শিল্প খাতে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে- জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে সুতা উৎপাদন করতে প্রতি কেজিতে আমাদের ২৫ সেন্ট খরচ পড়ে। দেশীয় মুদ্রায় ২০ থেকে ২২ টাকা। যদি গ্যাসের দাম বাড়ে তাহলে খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ৫৬ সেন্ট। প্রতি কেজি কাপড় ডাইং করতে আমাদের ২৯ টাকা লাগে। ১৩২ শতাংশ দাম বাড়ালে আমাদের ৬০ থেকে ৬৫ টাকা খরচ পড়ে যাবে। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বের দিকে এগিয়ে যেতে যে ডেল্টা প্ল্যান রয়েছে, সেখানে আমাদের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির প্রয়োজন হবে। এভাবে শিল্প খাতকে বাধাগ্রস্ত করলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, সারাবিশ্ব এখন লণ্ডভণ্ড অবস্থায় আছে। যুদ্ধের কারণে সব পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি। এ মুহূর্তে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে আমি মনে করি।
রিয়েল এস্টেট এন্ড হাউসিং এসোসিয়েশনের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি কাটতে না কাটতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দামামায় এমনিতেই শিল্প প্রতিষ্ঠান নানা চাপের মুখে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ালে রপ্তানি খাতসহ অভ্যন্তরীণ শিল্পকারখানা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। যা প্রকারান্তে দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলতে পারে। গ্যাসের যে কস্টিং হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই অপচয় হচ্ছে, অব্যবস্থাপনা রয়েছে। সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়ার কারণে উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এসব দিকে সরকারের নজর দিয়ে গ্যাসের খরচ কমাতে হবে। দাম বাড়িয়ে এ সমস্যা সমাধান করা যাবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়