রিকশাচালকের সাক্ষ্য : পরিচত মানুষই হত্যা করেন সগিরাকে

আগের সংবাদ

দক্ষিণ আফ্রিকায় অবিস্মরণীয় সিরিজ জয় : ইতিহাস গড়ল টাইগাররা

পরের সংবাদ

কারা এই মগ লিবারেশন আর্মি

প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম অফিস : হঠাৎ করে ‘মগ লিবারেশন আর্মি’ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ি জনজীবনে অস্থিরতা ও আতঙ্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। কয়েক বছর আগেও যে মগ লিবারেশন আর্মির খুব একটা কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি- তারা কি করে শক্তিশালী অবস্থানে এসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। এদের উৎপত্তি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অস্ত্রের জোগান নিয়েও অনেক কথা প্রচলিত আছে পার্বত্য অঞ্চলে। গতকাল মঙ্গলবার রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সীমান্তবর্তী গাইন্দা ইউনিয়ন এলাকায় মগ লিবারেশন আর্মির সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে স্থানীয় একটি সশস্ত্র গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও কমপক্ষে তিনজনের প্রাণহানির পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- কারা এই ‘ মগ লিবারেশন পার্টি’ বা ‘ মগ লিবারেশন আর্মি’?
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সংবাদকর্মী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে কর্মসূত্রে রয়েছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন, এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি মূলত পার্বত্য অঞ্চলের দলছুট কিছু তরুণকে নিয়ে গঠিত- যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিছু গ্রুপ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিছু গ্রুপ। ‘মগ লিবারেশন পার্টি’ নামে যে সংগঠনটি রয়েছে, তারই কথিত সামরিক শাখা ‘মগ লিবারেশন আর্মি’।
ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, তিন পার্বত্য অঞ্চলে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যসহ নানা সুবিধাভোগী অবস্থানে রয়েছে চাকমারা। আর পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের নেতৃত্বে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস। দীর্ঘ কয়েক দশকের সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এই জেএসএসের সঙ্গে সরকারের ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে এবার শান্তি ফিরে আসবে। একবারে যে শান্তি ফেরেনি তা কিন্তু নয়। তবে আশানুরূপ শান্তির বাতাস সেখানে নেই অথবা সেখানে ঠিকভাবে যাতে শান্তি-সম্প্রীতি বিরাজ না করে- সেজন্য বিভিন্ন সময়ে নানা তৎপরতা চালায় কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল। সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালিতো বটেই;

পাহাড়িদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে। জেএসএসের রয়েছে আবার সংস্কারপন্থি একটি গ্রুপ, পাশাপাশি জেএসএসের বিরোধী ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) রয়েছে। এই ইউপিডিএফ এরও রয়েছে নানা গ্রুপ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ‘মগ লিবারেশন পার্টি’র সৃষ্টি হয়েছে জেএসএসের আধিপত্য খর্ব করার জন্য। এজন্য মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের প্রচারণা চালানো হয়েছে- তাদের জন্য একটি আলাদা ‘স্টেট’ গঠন করা হবে। এই শস্তা বুলি প্রচারের মাধ্যমে মারমা জনগোষ্ঠীর একটি সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। আর তাতে এই মগ লিবারেশন পার্টি বা মগ লিবারেশন আর্মি কিছুটা হলেও স্থানীয় সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে। এরই মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী এই সংগঠনটির হাতে বেশ কিছু আধুনিক অস্ত্র-গোলাবারুদ এসেছে- যা দিয়ে তারা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হচ্ছে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসের সঙ্গে।
জানা যায়, আরাকান লিবারেশন ইউনিয়নের (এএলইউ) সামরিক সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) নিজেদের পরিচয় ঢাকতে ২০১০ সালের দিকে ‘মগ লিবারেশন পার্টি (এএলপি)’ গঠন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটায়। এই বাহিনীতে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর দলছুট সদস্যদের পাশাপাশি বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির মারমা যুবকদের রিক্রুট করা হয়। বান্দরবানের বিভিন্ন গহীন ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি), আরাকান কমিউনিস্ট পার্টি (এসিপি) এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আরাকানসহ (ডিপিএ) আরো কয়েকটি গ্রুপের অপতৎপরতার পর এই অঞ্চলের জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে মগ লিবারেশন পার্টির (এমএলপি) সশস্ত্র শাখা মগ লিবারেশন আর্মি।
প্রথমদিকে এই মগ লিবারেশন পার্টির তৎপরতা বান্দরবান এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার গহীন ও দুর্গম এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে তারা। বান্দরবান পার্বত্য জেলা সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা এলাকা, রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী এলাকায় এদের অবস্থান রয়েছে। রাঙ্গামাটির এসব এলাকাতেই সাম্প্রতিককালে তাদের বিচরণ বেশি বলে জানা গেছে। অপরদিকে খাগড়াছড়ির সাজেক এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায়ও সংগঠনটি তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সংবাদকর্মী এবং এলাকার অধিবাসীরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন দলছুট কিছু তরুণকে নিয়েই চলছে এই মগ লিবারেশন পার্টি। যাদের সুনির্দিষ্ট কোনো নেতা নেই, সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। এদের যেখানে ডাকা হয় তারা সেখানেই যায়। যদিও তারা মারমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার করে, তারা মারমাদের অধিকার আদায়ের জন্য, একটি স্বাধীন মারমা বা ‘মগ স্টেট’ সৃষ্টির জন্য কাজ করছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করেন এমন বেশ কয়েকজনের ভাষায়- এটি মূলত একটি ‘ক্রিয়েটেড পার্টি’। অর্থাৎ তাদের বিশেষ কারো স্বার্থসিদ্ধির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, ২০১০ সালের দিকে ‘মগ লিবারেশন পার্টি’ ( এমএলপি) গঠিত হলেও বিভিন্ন সময়ে তারা বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে কার্যক্রম চালায়। এ কারণে এমএলপি নামটি তেমন ছড়িয়ে পড়েনি। ২০১৮ সালের মে মাসের দিকে মংখ্যাইনু মারমা নামে এক ব্যক্তি অস্ত্রসহ আটক হওয়ার পর সে সময় প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিল, ২০১২ সালে তিনি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে তিনি মিয়ানমারের কারেন প্রদেশ ও ভারতের বিভিন্ন পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদী অধ্যুষিত এলাকায় সামরিক ও গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। মংখ্যাইনু মারমা নিজেকে একজন ‘পাহাড়ি বৈদ্য’ পরিচয় দিয়ে এমএলপিতে সদস্য রিক্রুট এবং বিভিন্ন গ্রামের সমমনাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তবে তিনি যে মূল নেতা বা তাদের মূল নেতা কে- সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তিন পার্বত্য জেলার কয়েকজন সংবাদকর্মী, ওই এলাকার অধিবাসী, ব্যবসায়ী ও মাঠপর্যায়ের কয়েকজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন- এই বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘মগ লিবারেশন পার্টি বা মগ লিবারেশন আর্মি’ গঠনের নেপথ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট-মাঝারি ও বড় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির ইন্ধন রয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও বিজিবির তৎপরতার কারণে এই সশস্ত্র সংগঠনটি খুব বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না বলেও অভিমত তাদের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়