বেড়ানোর বাহানায় ইয়াবা পাচার, গ্রেপ্তার দুই

আগের সংবাদ

মহাসড়ক যেন মরণফাঁদ

পরের সংবাদ

ভোটের মাঠে তৃণমূল নেতারা ফের বর্জনের ঘোষণা কেন্দ্রের

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুমানা জামান : ‘নির্বাচনী প্রহসনের অংশীদার হতে চায় না বিএনপি’- এমন কারণ দেখিয়েই আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তবে দলের অবস্থান সম্পর্কে সময়মতো, স্পষ্ট বার্তা না পেয়ে এরই মধ্যে
ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন তৃণমূলের অনেক নেতা। প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলায় বিএনপির ৪৫ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে যারা প্রার্থী হচ্ছেন, তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য নির্দেশনা পাঠানো হবে। এতে কাজ না হলে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। তবে দলটির এই বার্তা ভোটে আগ্রহী তৃণমূলের নেতাদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে দলের ভেতরেই।
বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় শেষ হওয়ার পর, গত সোমবার রাতে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটি সোমবার রাতে বৈঠক করে বর্তমান সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট বর্জনের ধারাবাহিকতায় উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রহসনের অংশীদার হতে চায় না বিএনপি। সে কারণে ৮ মে থেকে শুরু হওয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান সম্পর্কে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অস্পষ্টতায় ছিলেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা। কারণ, বিএনপি নেতৃত্ব এত দিন সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি।
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির যে ৪৫ জন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, এই সংখ্যাটা বেশি নয় বলেও মনে করছে বিএনপি। দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়ে নেতারা ঝুঁকি নিয়ে ভোট করবেন, এই সংখ্যা বেশি হবে না। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে ২২ এপ্রিল, এর মধ্যেই সবাই দলের নির্দেশ মোতাবেক মনোনায়ন প্রত্যাহার করে

নেবেন। তবে এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়ে গেলে বহিষ্কার নিয়ে ঝুঁকিতে পড়বে দল। এক্ষেত্রে শীর্ষ নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান ভোরের কাগজকে বলেন, যেখানে জাতীয় নির্বাচন দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে, সেখানে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? বিষয়টি পুরোপুরি হাস্যকর। কারণ, আওয়ামী লীগের অধীনে প্রহসনের এ নির্বাচনে ফলাফল আগের মতোই একচেটিয়া হবে; এ নির্বাচন দিয়ে জনগণের অধিকার আদায়ের অভিষ্ট অর্জন হবে না। এ কারণে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের যে সিদ্ধান্ত- তা অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও প্রতিহিংসা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে তারা নিজেরাই নিজেদের নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে, দলীয় ভিত্তিতে উপজেলা নির্বাচন করবে না।
উপজেলা নির্বাচনকে ‘ফাঁদ’ মনে করে হাইকামান্ড : বিএনপির নেতারা উপজেলা নির্বাচনকে দলের জন্য ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করছেন, বিএনপি এ নির্বাচনে গেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে; সেখান থেকে অনেকটাই উতরে যাবে সরকার। একই সঙ্গে দলের দিকে বিভিন্ন মহলের আঙুল উঠবে- জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে মস্ত ভুল করছে বিএনপি। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বিএনপি দলগতভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে না- এটাই সিদ্ধান্ত। যারা স্বতন্ত্রভাবে এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; তাদের বুঝিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হবে। এরপরও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শেষ পর্যন্ত কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি আজীবন বহিষ্কারও করা হতে পারে।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, দুটি কৌশল থেকে সরকার এবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে, সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। কারণ, যে কোনোভাবে বিএনপিকে এ নির্বাচনে আনা গেলে তাদের ‘একতরফা’ সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক- তা মিটে যাবে। অন্যটি হলো- উপজেলা নির্বাচন দলীয়ভাবে করতে গেলে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের ভরাডুবি হতে পারে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। মূলত সংসদ নির্বাচনে এর ইঙ্গিত পেয়ে এবার আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করেছে, দলীয় প্রতীক না থাকলে দলীয় ও স্বতন্ত্র বিভেদ থাকবে না, বিএনপিও ভোটে আসবে। ফলে বিএনপিকে হাতে গোনা কয়েকটি উপজেলায় জয় দেখিয়ে তারা নির্বাচন জায়েজ করে নেবে। এতে বিএনপির দীর্ঘদিনের আন্দোলনে তৈরি হওয়া নৈতিক অবস্থানও নষ্ট হবে।
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে তৃণমূল নেতারা অনেকেই প্রচারণায় নেমেছেন- তাদের বিরত রাখবেন কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, শখ থাকলেও এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর উপজেলায় অংশ নেয়াটা হাস্যকর হবে। এতে আমাদের আগামীর আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানে ধস নামবে।
বিএনপির অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়টি তাদের দলের পুরনো অবস্থান। তারা সেই অবস্থানেই অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা পর্যালোচনা করেছি; তৃণমূলে কর্মীদের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন করার আগ্রহ সেভাবে নেই। কারণ, সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন ও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে তাদের লাখ লাখ নেতাকর্মী মামলায় জর্জরিত। ২৭ হাজারের বেশি কারাগারে গেছেন। ফলে তৃণমূলের কর্মীরা নতুন করে মামলা বা নির্যাতনের মুখোমুখি হতে চান না।
কুমিল্লার বরুড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আমরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে অটুট। কেন্দ্র অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না। স্থানীয় নেতাকর্মীরা এসব বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। যারা সত্যিকারের বিএনপি বা জনগণকে ভালোবাসেন, তারা কেউই এই একদলীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।
নেতারা দিচ্ছেন বহিষ্কারের হুমকি : দলের সিদ্ধান্ত না মেনে নির্বাচনে কেউ অংশ নিলে দল কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে বলে জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কখনোই শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে না। সুতরাং, তার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। আমার বিশ্বাস, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ ভোটে যাবে না; গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, বিএনপির রাজনীতি যারা করেন, তারা দলকে ভালোবাসেন বলেই অতীতের মতো এবারের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে না। খুলনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী বলেন, বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে না। এখন কেউ ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থী হলে দলের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে তৃণমূল : ময়মনসিংহ জেলা দক্ষিণ যুবদলের সহসভাপতি মাজহারুল ইসলাম জুয়েল ত্রিশাল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগে নেমেছেন। মাজহারুল ইসলাম জুয়েল বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন অংশ নিলে বহিষ্কারও হতে পারি; বিষয়টি মাথায় রেখেই ত্রিশাল উপজেলার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগ করছি, তাদের সঙ্গে কথা বলছি। কারণ নেতাকর্মীদের চাঙা রাখা এবং তাদের সংঘবদ্ধ করতেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়া জরুরি বলে মনে করি।
গাজীপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ওই উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ইজাদুর রহমান। তিনি বলেন, এখন দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমি গত দুদিনে আমার উপজেলায় দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাদের আগ্রহের কারণে আমি প্রার্থী হয়েছি। দল যা ইচ্ছা ব্যবস্থা নিতেই পারে; তবে আমি শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকব।
নির্বাচনে আগ্রহী ত্রিশাল উপজেলা বিএনপি নেতা আনোয়ার শাদাত বলেন, আমার বাবা ত্রিশাল থেকে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। আমার বাবার ইচ্ছা ছিল আমিও জনপ্রতিনিধি হই। তার ইচ্ছাতেই বিএনপির সঙ্গে আছি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে গণসংযোগ শুরু করেছি। এ ব্যাপারে জনগণের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। দলীয় সিদ্ধান্তে বহিষ্কার করলেও নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করে জনগণের সেবা করতে চাই। যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় কোনো প্রতীক থাকবে না, সেই বিবেচনা থেকে আমি নির্বাচনে অংশ নিতে চাই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়