বেড়ানোর বাহানায় ইয়াবা পাচার, গ্রেপ্তার দুই

আগের সংবাদ

মহাসড়ক যেন মরণফাঁদ

পরের সংবাদ

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে চাপ বেড়েছে অর্থনীতিতে : মূল্যস্ফীতি বাড়বে, পোশাক খাতে ঝুঁকি

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি ঋণ, রাজস্ব আয়- অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো চাপে রয়েছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাপকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি এ সংঘাত বিস্তৃতি লাভ করে ও দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর নানামুখী প্রভাব পড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এজন্য আমাদের নিজস্ব অর্থনীতি যেসব ঝুঁকির মধ্যে আছে- সেখানে যেন নতুন কোনো প্রভাব না ফেলে- সে চেষ্টা করতে হবে। এজন্য অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, স্থিতিশীলতা আনার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে বলে মনে করেন তারা।
ইরান-ইসরায়েল একে অপরের প্রতি চরম বৈরী দুটি দেশ। সিরিয়ায় করস্যুলেট ভবনে হামলার জবাবে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এর প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েলও। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সব মিলিয়ে ইরান-ইসরায়েল পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকেই যাচ্ছে; যা ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা মধ্যপাচ্যে। এর প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর এ যুদ্ধের নানা রকম প্রভাব পরতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ মধ্যপ্রাচ্য জ¦ালানি তেলের একটি বড় জোগানদাতা। এ যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। এতে অন্যান্য জিনিসেরও দাম বাড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশের আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাত বড় ধরনের সংকটে পড়বে। ফলে আমাদের রপ্তানি আয়ের ওপর প্রভাব পড়তে পারে এবং জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। ফলে আমরা একটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে পারি।
এসব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে বড় সংকট নিয়ে আমরা চলতি বছর শুরু করেছি। অর্থনীতিতে বর্তমানে তিন সমস্যা আছে। এগুলো হলো- উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা। নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতায় জ¦ালানি তেলের ওপরে বড় ধরনের প্রভাব পড়লে তা অর্থনীতিতে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। বৈদেশিক মুদ্রা, তেলের দাম- সবই আবার ঊর্ধ্বমুখী হবে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে। শিপিং এর খরচ বাড়বে। মূল্যস্ফিতি বাড়বে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, অন্যদের মতোই জ্বালানির দাম বাড়বে এবং সমুদ্রপথে বাণিজ্য ব্যয় বাড়বে। এতে মূল্যস্ফিতি বাড়বে, বৈশ্বিক চাহিদার ওপর প্রভাব পড়বে; ফলে রপ্তানির ওপরে প্রভাব পড়বে, তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়বে। সংঘাত বাড়লে বৈশ্বিক অর্থনীতি নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করবে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে চাহিদা হ্রাস পেতে পারে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন- শঙ্কা নির্ভর করবে সংঘাতের বিস্তৃতির ওপর। ইরান- ইসরায়েলের মধ্যে মিশাইল ছোড়াছুড়ি করলে প্রভাব পড়বে একরকম; আর অন্যান্য দেশ এর মধ্যে যুক্ত হলে তা হবে অন্যরকম। তিনি বলেন, যদি সংঘাত দীর্ঘায়িত ও বিস্তৃতি লাভ করে তাহলে জ¦ালনি তেল ও শিপিং খরচ- এ দুটির ওপর অভিঘাত পড়বে। সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় ধরনের একটা অভিঘাত হতে পারে; যা আমরা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে দেখেছি। তেলের দাম বাড়লে অন্যান্য পণ্যের ওপরও প্রভাব পড়বে। তখন বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে। ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু

করেছে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব অর্থনীতি যেসব ঝুঁকির মধ্যে আছে সেখানে যেন কোনো প্রভাব না ফেলে সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের

যেসব কর্মকাণ্ড- বাজার ব্যবস্থাপনা, খবরদারি, নজরদারি এগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও স্থিতিশীলতা আনার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হলে তা জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া এবং আমদানি বিল বাড়ানোর দিকে ঠেলে দিতে পারে। সরকার বেশি দামে জ্বালানি আমদানিতে ব্যর্থ হলে লোডশেডিং ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তে পারে। লোহিত সাগরের নৌপথের পরিবর্তে ইতোমধ্যেই আফ্রিকার মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল করছে। যদি হরমুজ প্রণালি দিয়ে বাণিজ্য ব্যাহত হয় তাহলে শিপিং সময় এবং খরচ আরো বাড়বে। আফ্রিকান অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের কারণে এ পরিস্থিতি জাহাজগুলোর জন্য সম্ভাব্য সংকট তৈরি করতে পারে।
ইরান বা ইসরায়েল কেউই বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অভিবাসী শ্রমিক নেয় না। তবে সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে অনুভূত হবে, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। ফলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে, যা লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। সংঘাত বেশি সময় ধরে চললে বাংলাদেশিরা তাদের চাকরি হারাতে শুরু করতে পারেন।
ইসরায়েল এবং ইরানের সহিংস পরিস্থিতি বাংলাদেশকে নতুন কূটনৈতিক চাপে ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধু বলয় বাড়াতে চাইবে এবং বাংলাদেশ যাতে কোনোভাবেই ইরানের পক্ষে বা ইসরায়েলের বিপক্ষে অবস্থান না নেয় তা নিশ্চিত করতে চাইবে। সবকিছু মিলিয়ে এ যুদ্ধ যদি দীর্ঘদিন গড়ায় তাহলে তা বাংলাদেশের উপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী ভোরের কাগজকে বলেন, সমস্যা কতটা গভীর হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। মধ্যপ্রাচ্য জ¦ালানি তেলের একটি বড় যোগানদাতা। তাই যুদ্ধ বেধে গেলে জ¦ালানি তেলে একটি বড় প্রভাব পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। এছাড়া রপ্তানিতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে শুল্ক আহরণে। তিনি বলেন, সবকিছু নিয়েই একটি অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আমাদের আমদানি নির্ভর অর্থনীতি। ফলে আমদানি এবং রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ সামস্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব বেশি পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যুদ্ধ বিগ্রহ না হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার কারণেও সমস্যাগুলো কিছুটা হলেও বেড়ে যাওয়ার একটা শঙ্কা রয়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, লোহিত সাগর সংকট শুরুর পর ঢাকা থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে গেছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে তা আরো বাড়তে পারে। তিনি বলেন, বর্তমানে ঢাকা থেকে ইউরোপের বিমানবন্দরগুলোয় এক কেজি পণ্য পরিবহনে এয়ারলাইন্সগুলো আড়াই ডলারের বেশি চার্জ করে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে একই গন্তব্যে ৩০ মার্কিন সেন্টের চেয়ে বেশি দরকার হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত বলেন, জ¦ালানি তেলের পাশাপাশি ইসরায়েল-ইরান সংকট পুঁজিবাজারের অনিশ্চয়তাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে, বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি-বিরুদ্ধ অবস্থান নেবে এবং দুর্বল বাজার থেকে ফিরে আসবে। এছাড়া মুদ্রা বাজারগুলোও প্রভাবিত হবে; বিশ্বব্যাপী বাজার সরবরাহ শৃঙ্খলাকে ব্যাহত করবে; যা প্রযুক্তি থেকে কৃষি পর্যন্ত শিল্পগুলোকে প্রভাবিত করবে। তিনি বলেন, সংঘর্ষের ফলে পারস্য উপসাগর এবং সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে সামুদ্রিক রুটসহ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট হুমকির মুখে পড়বে। শিপিং বিলম্ব এবং বর্ধিত নিরাপত্তা উদ্বেগ এই রুটের উপর নির্ভরশীল কোম্পানিগুলোর জন্য খরচ ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ বাড়বে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়