কবিতাসমগ্র

আগের সংবাদ

অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠেকাতে কঠোর বার্তা

পরের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : সিরিয়ায় ইরানি কনসুলেট ভবনে আগ্রাসি হামলার জবাবে ইসরায়েলে ইরানের নজিরবিহীন ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর অঞ্চলটিতে চলমান উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে সতর্ক করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা। এর ফলে বিশ্বজুড়ে বহুমুখী প্রভাব পড়বে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এতে বাংলাদেশকেও ভুগতে হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
প্রসঙ্গত, স্থানীয় সময় গত শনিবার রাতে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে ইরান। একই সঙ্গে ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকেও হামলা চালানো হয়। ইসরায়েল বলছে, তিনশর বেশি ড্রোন, ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। রবিবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ দাবি করেছে, ইরানের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিহত করা হয়েছে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই যুদ্ধ পরিস্থিতিই এখন মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও এই হামলা নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ঈদে পণ্যের দাম নিয়ে স্বস্তি ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল পাল্টপাল্টি হামলার ঘটনায় অস্বস্তিতে আছি। আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহের প্রভাব বাজারে পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ যাতে বাজারে না আসে, তা মোকাবিলা করতে হবে। তবে এর আগের দিন রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রগুলোকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার। আমরা যে কোনো যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমরা চাই, পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, সব যুদ্ধ বন্ধ হোক। ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের প্রসঙ্গ টেনে হাছান মাহমুদ বলেন, ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে আক্রমণ করার পরিপ্রেক্ষিতেই ইরান এই আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছে। আমরা আশা করি, দায়িত্বশীল রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধে ভূমিকা রাখবে।
জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, যে দিন থেকে গাজার ওপর ইসরায়েল হামলা শুরু করেছিল সেদিনই বলা হয়েছিল, এই হামলা বিস্তৃত হবে। সেই বিস্তৃতির ফলাফল হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। এই সংঘাতের ফলে আন্তর্জাতিকভাবে রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, জ¦ালানি এবং বিমান খাতে চাপ তৈরি হবে। আর এর খেসারত আমাদের দিতে হবে। বাংলাদেশও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সব মিলিয়ে অস্থিরতা আরো গভীর হবে।
ল্যাঙ্কাস্টার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লেখা একাধিক বইয়ের লেখক সাইমন মাবন ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে বলেছেন, বর্তমানে এই অঞ্চলের স্থিতাবস্থা এবং ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। এই আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করেছে এবং অনিশ্চয়তায় ভরা একটি অনিশ্চিত

পরিবেশ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এই হামলা আঞ্চলিক রাজনীতিতে নাটকীয় প্রভাব ফেলবে। ইসরায়েলের সরাসরি হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর শাখা আইআরজিসির কয়েক সিনিয়র সদস্য নিহত হয়েছেন। এতে ইরানের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, এটি ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং এর বাইরেও অনেক দেশের মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু হামলার পর বলেছেন, তার দেশ কয়েক বছর ধরে ইরানের সরাসরি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং যারা তাদের ক্ষতি করবে, তাদেরও ক্ষতি করা হবে। ইসরায়েলের এমন প্রতিক্রিয়া নিয়ে সাইমন মাবন বলেন, ইসরায়েল বলেছে, যদি ইরানের ভূখণ্ড থেকে সরাসরি হামলা হয় তাহলে পাল্টা জবাব দেবে তারা। ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি দৃঢ় সমর্থনের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। এখন ইসরায়েল যদি ইরানে পাল্টা হামলা চালায় তাহলে এটি তৈরি করতে পারে আরো একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি। যা ছড়িয়ে পড়বে আশপাশের অঞ্চলে। ইসরায়েলের সমর্থনে যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এগিয়ে আসবে তেমনি ইরানকেও সমর্থন দেবে তাদের মিত্ররা। এতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা বেড়ে যাবে। আর এমন কিছু হলে ব্যাঘাত ঘটবে বিশ্ব অর্থনীতিতে, দেখা দিবে খাদ্য ও তেল সরবরাহের ঘাটতি, শুরু হতে পারে দুর্ভিক্ষ।
মধ্যপ্রাচ্যে এয়ারলাইন সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে : ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার পর ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে বিমান চলাচলে সমস্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এর ফলে বিমান শিল্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। কান্তাসসহ অন্তত এক ডজন এয়ারলাইন্সকে গত দুই দিনে ফ্লাইট বাতিল বা পুনরায় রুট নির্ধারণ করতে হয়েছে। ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর ইরান-ইসরায়েল হামলাই প্রথম যেখানে বহু বিমান তার পথ বদল করেছে অথবা উড়ান বন্ধ করেছে। ইসরয়েল শনিবার তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়, রবিবার সকালে সেগুলো আবার খুলেও দেয়। একই সঙ্গে বন্ধ করে দেয়া জর্ডান, ইরাক ও লেবাননও তাদের ভূখণ্ডে আবার ফ্লাইট চালু করেছে। এমিরেটস এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ এবং ইতিহাদ এয়ারওয়েজসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান এয়ারলাইন্সগুলো রবিবার বলেছে, তারা কিছু ফ্লাইট বাতিল বা পুনরায় রুট করার পর এই অঞ্চলে পুনরায় কার্যক্রম শুরু করবে। সাম্প্রতিক অস্থিরতা যাত্রীদের চাহিদাকে প্রভাবিত করবে কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এটা ঠিক, এমন পরিস্থিতি এবং দ্ব›দ্ব বাড়তে থাকলে ভ্রমণের বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে।
ইরানের হামলার পর কমেছে তেলের দাম : ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে, এমন ধারণাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে বিপরীত ঘটনা। সামান্য হলেও কমে গেছে তেলের দাম। গতকাল সোমবার সকালে এশিয়ান ট্রেডে এই কম মূল্যের প্রবণতাই দেখা গেছে, যদিও সেটা প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলারের কাছাকাছিই ছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে। তবে এটাও ঠিক, ইসরায়েলের ওপর ইরান আক্রমণের ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই তেলের দামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছিল। গত ছয় মাসের মধ্যে গত সপ্তাহে তেলে দাম ছিল সর্বোচ্চ। গত সপ্তাহের শেষে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৯২ দশমিক ১৮ ডলার পর্যন্ত হয়েছিল। গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে ধরলে সেটা ছিল সর্বোচ্চ। এর পর থেকে কমতে কমতে সেটা ৯০ দশমিক ৪৫ ডলারে নেমেছিল। সোমবার সকালে সেটা আরো ২০ থেকে ৩০ সেন্ট কমেছে। ইরান বর্তমানে প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করে থাকে। তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ওপেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ইরানের অবস্থান চতুর্থ। বিশ্বের মধ্যে সপ্তম। ইসরায়েলে হামলার পর থেকে সব সময়ই একটা পাল্টা আঘাতের আশঙ্কায় রয়েছে ইরান। সে আঘাত ইরানের তেলক্ষেত্রের ওপরও হতে পারে। এসব বিবেচনায় তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে ইরান এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করবে। বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ববাজারে তেলে দাম বাড়া-কমার ক্ষেত্রে হরমুজ প্রণালী একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের ২০ শতাংশ তেলবাহী জাহাজ এই সমুদ্রপথ দিয়েই চলাচল করে। ওপেকভুক্ত দেশ সৌদি আরব, ইরান, আরব আমিরাত, কুয়েত এবং ইরাক তাদের বেশির ভাগ তেল এই পথেই রপ্তানি করে। ওমান ও ইরানের মধ্যেকার সংবেদনশীল এই সমুদ্রপথটি শান্তিপূর্ণ থাকলে কমে যায় তেলের দাম। গত শনিবার ইরান হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বাণিজ্যিক জাহাজকে আটক করে। তাদের অভিযোগ ছিল জাহাজটি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে এই হরমুজ প্রণালী কতটুকু নিরাপদ থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। এসব কারণেই, সোমবার হঠাৎ করেই তেলের দামে এই সামান্য পড়তিকে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য অত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাদের মতে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলা হলেই তেলের দাম আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে।
ইরানের হামলায় আরব দেশগুলো ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে : ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ইরানি আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতাকে অনস্বীকার্য করে তুলেছে। সংঘর্ষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো রান্ডা সিøম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, আগের যুদ্ধগুলোতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ ছিল না। কিন্তু এখন আমরা এই যুগে প্রবেশ করছি- যেখানে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ হচ্ছে, যা এই অঞ্চলকে টেনে আনতে পারে সংঘাতের দিকে। শুধু এই অঞ্চলকে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও টেনে আনতে পারে। এর ফলে এখন আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা সব সময় টেবিলে থাকবে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জুস্ট হিলটারম্যান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, এই মুহূর্তের জন্য, একমাত্র প্রতিরোধ শক্তি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দীর্ঘকালের শত্রæ ইরান উভয়কেই সংঘাতের বিস্তৃতি এড়ানো নিয়ে ভাবতে হবে। আমি এই সত্যে আনন্দিত, একমাত্র যারা যুদ্ধ চায় তারা ইসরায়েল এবং হামাস। ইরানিরা এখনো আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলছে। হিল্টারম্যান বলেন, ইরানি বার্তাটি স্পষ্ট করে দিয়েছিল, তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চাইছে, যুদ্ধকে প্রসারিত করতে চাইছে না। তারা বলেছিল, একটি আক্রমণ হতে চলেছে, তবে আমরা এটি সীমিত রাখতে যাচ্ছি। তবুও, আরব দেশগুলোর নাগরিকরা যাদের মধ্যে অনেকেই শনিবার তাদের আকাশজুড়ে প্রচুর ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রবাহিত হতে দেখেছেন। আপাতত সেটি বন্ধ থাকলে ভবিষ্যতে কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাত ইসরায়েল এবং কিছু আরব রাষ্ট্রের মধ্যে তুলনামূলকভাবে নতুন সম্পর্ককে আরো টেনে আনবে কি না তা স্পষ্ট নয়। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, সেই সম্পর্কগুলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, যেসব আরব সরকার সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে- তাদের কেউই তাদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়