প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
সেবিকা দেবনাথ : প্রতি বছর পৃথিবীতে ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মশা। মশাবাহিত রোগের মধ্যে এই মুহূর্তে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই এই বিষয়ে সতর্ক বার্তা জারি করেছে। তারা হুঁশিয়ারি করেছে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ডেঙ্গু জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল। তবে ৭টি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্রতর হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্রতর হওয়া দেশগুলোর তালিকায় আছে ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, ফিজি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম।
এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকরা বলছেন, ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত, মার্চ-এপ্রিলে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যেত। ২০১৩ সালের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দুয়েক মাস বাদ দিয়ে প্রায় সব মাসেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি মাসেই একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এবার পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে নাজুক হতে পারে। সংক্রমণ ও মৃত্যু সেই পূর্বাভাস দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ২০২৩ সালে। সেই বছর সরকারি হিসাব মতে, ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ১ হাজার ৭০৫ জনের। ওই বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল ৯০১ জন। মৃত্যু হয়েছিল ১০ জনের। বাংলাদেশের ইতিহাস ভেঙে দেয়া আক্রান্তের বছরের হিসাব ছাড়িয়ে ২০২৪ সালের শুরু থেকে আগ্রাসি ভূমিকায় আছে ডেঙ্গু। চলতি বছর এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, গত বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মূল কারণ আবহাওয়া। যা এডিস মশার বংশ
বিস্তারের পক্ষে সহায়ক ছিল। উচ্চ তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার সঙ্গে থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কারণে এডিস মশা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়েছে, সেখানে ডেঙ্গুর বিস্তার কম হয়েছে। সুতরাং আবহাওয়ার যে বার্তা পাওয়া যাচ্ছে তাতে চলতি বছর গরম আরো বেশি পড়বে। এটি হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
মশা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। চলতি বছর ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বেশি হওয়ার শঙ্কার কথা জানান তিনিও। ড. কবিরুল বাশার জানান, তার অভিজ্ঞতার আলোকে যে ফোরকাস্টিং মডেলটি তৈরি করেছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে- ২০২৪ সালে ডেঙ্গু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে বাংলাদেশকে। ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরের কিছু জেলায় বিগত বছরগুলোর সব হিসাব অতিক্রম করে ডেঙ্গু আঘাত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা,কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও খুলনায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হতে পারে। এই জেলাগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটবে চলতি বছর।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এপ্রিল মাসের পর থেকে যখন বৃষ্টিপাত শুরু হবে তখন থেকেই এডিস মশার প্রজনন বাড়তে থাকবে। বৃষ্টি হলে বাড়ি, বাড়ির আঙিনা অথবা বিভিন্ন জায়গায় আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা পাত্রে পানি জমা হবে এবং সেই পানিতে এডিস মশা ডিম পেড়ে তার বংশবিস্তার করবে। কোনো একটি জায়গায় এডিস মশার ঘনত্বের ইনডেক্স বা ব্রোটো ইনডেক্স যখন ২০ অতিক্রম করবে; তখনই সেই এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকবে। মৌসুমের শুরুতে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা; বিশেষ করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে পারলে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কোনো দেশে যদি একবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দেয় তা পুরোপুরি নির্মূল করার উপায় নেই। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন। কিন্তু গ্রামে এসবের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে চলতি বছর গ্রামে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মশা নিধনের অভিজ্ঞতা, সম্পদ, জনবলের কোনোটাই নেই। ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনের প্রধান কারণ অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্যব্যবস্থা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যকর করতে না পারলে এই সংকট বাড়বে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মশা কমানো বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এদিকে রোগীর সংখ্যা বাড়লে দেশের চিকিৎসা সক্ষমতার ওপর অনেক চাপ পড়বে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় রোগীর ব্যবস্থাপনা ভালো থাকলে মৃত্যু কম হতে পারে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ডেঙ্গু রোগীদের সময়মতো ও যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিতে মার্চ মাসের মাঝামাঝিতেই সারাদেশের সব হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। গতকাল সোমবারও সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, কারো যাতে ডেঙ্গু না হয় সেজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। আমরা হাসপাতালগুলোকে বলে রেখেছি। এখন চিকিৎসকরা ডেঙ্গু চিকিৎসা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। স্যালাইনের যে সংকটের কথা ভাবা হয়েছে, সেটা নিয়েও বৈঠক করেছি। স্যালাইনের কোনো সংকট হবে না। তবে ডেঙ্গু না হোক; সেটা আমাদের সবার প্রার্থনা। বিপর্যয় না হওয়ার জন্য কী করতে হয়; সেটা আপনারা ভালো করে জানেন।
‘ডেঙ্গু : বৈশ্বিক পরিস্থিতি’ শিরোনামে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে ১৩টি কারণে সারা বিশ্বে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হলো- এডিস মশা পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও মশার বসবাসের উপযোগী অন্যান্য কর্মকাণ্ড বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর উপযোগী আবহাওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, একই সঙ্গে ডেঙ্গুর একাধিক ধরনের বিস্তার, সুনির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত করার সমস্যা, ল্যাবরেটরি ও পরীক্ষাব্যবস্থার অপ্রতুলতা, কোভিড-১৯সহ একই সময়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চলা প্রাদুর্ভাব, ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার অনুপস্থিতি, ডেঙ্গু সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা ও আচরণ বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি, কমিউনিটিকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডের ঘাটতি, মশার ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার ঘাটতি, স্থায়ীভাবে অর্থায়নের ঘাটতিসহ অংশীজনদের কাজে সমন্বয়ের অভাব এবং মানুষ ও পণ্যের ব্যাপক চলাচল। বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে উল্লেখযোগ্যভাবে ডেঙ্গু বেড়েছে। এদিকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে গতকাল সোমবার শুরু হয়েছে কর্মশালা।
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।