এমসিসিএইচএসএলে দুর্নীতির অভিযোগ

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে দুষ্ট চক্রের থাবা

পরের সংবাদ

বাজার তদারকি দৃশ্যমান নয়

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : দামের উত্তাপে পুড়ছে নিত্যপণ্যের বাজার। আজ চিনি তো কাল তেল, পেঁয়াজ। পরদিন শোনা যায় অন্য আরেকটি পণ্যের দাম বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে ক্রেতারা মনে করছেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারের হুঁশিয়ারির থোড়াই তোয়াক্কা করছে তারা। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার তদারকিতে দায়িত্বরত সরকারের সংস্থাগুলো বাজারে তেমন সক্রিয় নয়। বাজার তদারকি জোরদার করার কথা হাঁকডাক করে বললেও বাস্তবে তা দৃশ্যমান নয়।
টানা চতুর্থবারের মতো নতুন সরকার গঠনের পর ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ওপর। সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা পেয়ে কিছুটা তৎপর হতে দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোকে। রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে রাখা হয়েছে সরকারের ১২টি সংস্থা। আর এ কাজে রয়েছে প্রায় ৩৫টি টিম। পাশাপাশি বাজার পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন দিয়ে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার কথা টিমগুলোর। কিন্তু সাধারণ ভোক্তা-ক্রেতাদের অভিযোগ, এসব মনিটরিং সংস্থাগুলো যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। আর এই সুযোগে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে; ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটে নিচ্ছে।
একমাত্র জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান চালালেও প্রয়োজনের তুলনায় টিম কম হওয়ায় সুফল মিলছে না। এর বাইরেও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিমের বাজার তদারকি করার কথা। অথচ বাজারে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নাগাল পাওয়া যায় না। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সব সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি একসঙ্গে বাজার তদারকি এবং বাজারে অভিযান পরিচালনা করে; তাহলে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। পাশাপাশি সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে জোর দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী ভোরের কাগজকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের যা করণীয় তা করছে। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু নীতি সুদহার নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। এজন্য আরো অনেক কিছু দরকার। যেমন- আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা তত উন্নত নয়; তাই বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন দরকার। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় যে ফাঁক বা দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। এজন্য প্রথমে দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। বাজারে কমিটি গঠন করে, জরিমানা করে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। বাজার ব্যবস্থাপনায় ‘মূল্যশৃঙ্খল’ বা ‘ভ্যালুচেইন’ ঠিক করতে হবে। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে যাওয়া পর্যন্ত এখানে অনেকগুলো স্টেজ রয়েছে। স্টেজের যেসব দুর্বলতা রয়েছে এগুলো খুঁজে বের করে তা দূর করলেই বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে। তখন সেই দুর্বলতার সুযোগগুলো কেউ নিতে পারে না। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, কমিটি গঠন করে বা জরিমানা করে এই সব দুর্বলতা দূর হয় না। কৃষিজাত বা খাদ্যপণ্যের যেগুলোর মূল্য খুব বেশি ওঠা-নামা করে সেগুলোর মূল্যশৃঙ্খলকে প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। এতে দুর্বলতা কমে আসবে, ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগও নিতে পারবে না। কিন্তু আমরা তা করছি না। বর্তমানে বাজার নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা বাজার পরিস্থিতি সমাধান করতে সক্ষম নয়। মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও চিনি থেকে শুরু করে সবজির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আবার ডিম ও আলু আমদানির অনুমতি দেয়ার পর এই দুই পণ্যের দাম দ্রুত কিছুটা কমেছে। এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে সমস্যাটা পণ্যের জোগান বা উৎপাদন খরচের নয়। মূলত বাজারে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, আলু ও ডিম ব্যবসায়ীরা যখন অস্বাভাবিক মুনাফা তুলে নিচ্ছেন, তখন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরাও সুযোগ নিচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি সবজি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকলেও একসঙ্গে এতগুলো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পরও তাদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের অবস্থা পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে। সুতরাং আমাদের মূল যে সমস্যা সেই সমস্যাগুলোতে হাত দিতে হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কোথায় দুর্বলতা রয়েছে তা বের করে সমাধান করতে হবে।
সূত্র জানায়, ভোক্তাকে রক্ষা করতে সরকারের একাধিক বাজার তদারকি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে বর্তমানে বাজার তদারকির সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় ছাড়াও ঢাকায় রয়েছে বিভাগীয় কার্যালয়। এ কার্যালয়ের আওতায় ঢাকা ও আশপাশের বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এছাড়া প্রতিটি বিভাগ ও জেলায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় আছে। একদিকে জনবল সংকটের কারণে সঠিকভাবে বাজার তদারকি করতে না পারা; অন্যদিকে শাস্তি কম হওয়ায় সেভাবে কাজে আসে না ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, অধিদপ্তর তার সক্ষমতা অনুযায়ী বাজারে তদারকি অভিযান পরিচালনা করছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা দফায়

দফায় সভা করছি। ব্যবসায়ীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছি। কোনো অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাজারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ভোক্তা অধিদপ্তর বসে নেই, কাজ করে যাচ্ছে। তবে অন্য সংস্থাগুলো কী করছে, সেটি বলার এখতিয়ার আমার নেই। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যেমন পণ্যের দাম নির্ধাারণ করে দেন, তেমনি তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের। কিন্তু তা করছে না। আমরা অভিযান চালিয়ে তরমুজের দাম নিয়ন্ত্রণে এনেছি। অথচ এটা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কাজ ছিল।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বাজার সংযোগ ১) প্রণব কুমার সাহা গণমাধ্যমকে বলেন, অধিদপ্তর থেকে পণ্যের যৌক্তিক মূল্য বেঁধে দেয়া হচ্ছে। সেই দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা তা দেখতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ টিম নিয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য বিপণন ব্যবস্থায় কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হলে তা রোধ করা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে কৃষি বিপণন আইনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাজার তদারকির জন্য সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা আছে। সংস্থাগুলো পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ঠিকমতো কাজ করছে বলে আমার মনে হয় না। মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তরের টিমকে বাজার তদারকি করতে দেখা যায়। এছাড়া আর কোনো সংস্থার উপস্থিতি বাজারে চোখে পড়ে না। ঠিকমতো বাজার তদারকি না করায় পণ্য মজুত রাখা, অতি মুনাফার চিন্তা থেকে ব্যবসায়ীদের বিরত রেখে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে তারা অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে, কারসাজি করে পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়