নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে গুমোট হয়ে ওঠে ঢামেক প্রাঙ্গণ : বেইলি রোড ট্র্যাজেডি

আগের সংবাদ

দায়ীরা পার পেয়ে যায় যেভাবে

পরের সংবাদ

সমন্বয় নেই ভবন তদারকিতে : আইনের ফাঁক গলে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন > রাজউকের নকশা মেনেই সেবা সংযোগ দেয়ার পরামর্শ

প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : একটি ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে, তা আইনে স্পষ্ট বলা আছে। সেই আইন মানছেন না ভবন মালিকরা। রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ ও ডেকোরেশন করে থাকেন তারা। আইনকে তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো ভবন ব্যবহার করেন তারা। এতে প্রায়ই ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। প্রাণ যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের। ভবনের এসব দেখভাল বা তদারকির দায়িত্ব যাদের, তাদের রয়েছে গাফিলতি। কেউ কেউ ঘুষ নিয়েই থাকেন চুপচাপ, নেন না কোনো পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের ভবন নির্মাণ আইনের দুর্বলতারও সুযোগ নেন অনেকেই। এ বিষয়ে দায়িত্বশীলরাও নীরব। কোথাও কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কিছুদিনের জন্য নড়েচড়ে বসেন তারা। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে আসে আগের অবস্থায়। অথচ সঠিকভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে তদারকি হলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো যেত। এদিকে ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের যেসব ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, তারমধ্যে ভবন নির্মাণে আইনের দুর্বলতাকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাজউক কিংবা ফায়ার সার্ভিসের আইন নয়; জননিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ভবন নির্র্মাণ আইন করা জরুরি। তাহলে এসব দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে।
যে কোনো বহুতল ভবনের তদারকির দায়িত্ব রাজউকের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসি, ওয়াসা, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের। কিন্তু এসব সংস্থার দায়িত্বশীলরা কে কতটা তদারকি করে, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দায়িত্বশীলরা নিজ নিজ সংস্থার নিয়ম মেনে কাজ করলে অগ্নিঝুঁকি কমানো সহজ হবে।
আইন অনুযায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করা হলে সংস্থাটির অনুমোদন নিতে হয়। রাজউক সব নিয়ম মেনে প্ল্যান ও নকশার অনুমোদন দেয় ভবন তৈরির। সংস্থাটি বলছে, ভবন তৈরির সময় সেটি রাজউকের অনুমোদিত নকশা মেনে করা হচ্ছে কিনা, তা তদারক করে থাকে রাজউক। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর সব ঠিকঠাক থাকলে রাজউক অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (বসবাস সনদ) দেয়। এরপর রাজউকের সঙ্গে ভবন মালিকের আর সম্পর্ক থাকে না। সংস্থাটির মুখপাত্র ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দেয়ার পর ভবন মালিক সাধারণত রাজউকে আর আসেন না, আসার দরকারও হয় না। তখন যারা ভবনটি ব্যবহার করবে সেটা আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক হোক- তাদের প্রতি মাসে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে সিটি করপোরেশনে যেতে হয়। বিদ্যুৎ বিল দিতে বিদ্যুৎ অফিসে যেতে হয়। পানির বিল দিতে ওয়াসায় যেতে

হয়। ট্রেড লাইসেন্সের জন্য সিটি করপোরেশনে যেতে হয়। তখন যদি রাজউকের নকশা তারা যাচাই করে তাদের সেবাগুলো নিশ্চিত করেন, তাহলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে না। কোনো ভবন মালিকও এ ধরনের সুযোগ আর পাবেন না। অর্থাৎ রাজউকের অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটলে কোনো সংস্থা যদি তাদের সংযোগ না দেয়, তাহলেই এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। রাজউক যদি আবাসিক ব্যবহারের অনুমতি দেয়, ডিডিপিসি সেখানে কেন বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ দেবে? বারবার অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কী করতে হবে- জবাবে রাজউকের এই কর্মকর্তা বলেন, নতুন যেসব ভবন হবে, সেসব ভবনের স্থাপত্য নকশার পাশাপাশি ফায়ার সেফটি প্ল্যান, স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং এবং ইলেকট্রনিক কনশট্রাকসন পারমিটিং সিস্টেম আমরা তিনমাস আগে থেকে চালু করেছি। ভবনের প্রিন্ট লেভেল থেকে শুরু করে ট্যাকনিক্যাল কারিগরি ভিত্তিক টিম নিয়োজিত করার মাধ্যমে সার্টিফিকেশন সিস্টেম চালু হয়েছে। এতে নতুন ভবন সুরক্ষিত থাকবে। আর পুরাতন ভবনের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক টিম গঠন করা হবে। আমরা একটি নীতিমালা প্রস্তুত করেছি। নীতিমালার আলোকে ৮টি জোনে ৮টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারা সরজমিন বিদ্যমান ভবনগুলো পরিদর্শন করবে। যেখানে যা করা দরকার সেগুলোর জন্য সুপারিশ করবে। এরপর রাজউক সেগুলো বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেবে।
ঢাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের মানদণ্ড কী হবে, তা নিয়ে আইনে কিছুটা গলদ আছে। রাজউকের আইনে ১০ তলার ওপর ভবন করা হলে তা হবে বহুতল ভবন; আর ফায়ার সার্ভিসের আইনে আছে ৬ তলার ওপর কোনো ভবন করা হলে সেটি হবে বহুতল ভবন। ফলে এর মাঝখানে যে পার্থক্য রয়েছে, সেটির সুযোগ নেয় অনেকেই। ফলে যেসব ভবন তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণই থেকে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউকের আইন ও ফায়ার সার্ভিসের আইনে কিছু পার্থক্য আছে। বিল্ডিং কোডে বহুতল বলতে ১০ তলার উপরের ভবন বোঝানো হচ্ছে; আর ফায়ার সার্ভিসের আইনে ৭ তলার উপরের ভবন বোঝাচ্ছে। এই গ্যাপের সুযোগ নিচ্ছে প্লটের মালিক, নির্র্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবীসহ অনেকেই। তিনি বলেন, কোনো ভবনের নিরাপত্তা একাধিক সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিটি সংস্থাই নিজ নিজ কর্মপরিধির মধ্য দিয়ে কাজ করে। রাজউকের আইনে ১০ তলার বেশি উচ্চতা হলে বহুতল ভবন। আর ফায়ার সার্ভিসের আইনে ৭ তলার ওপর বহুতল ভবন। কাজেই ৭ তলার ওপর ও ১০ তলার কম যেসব ভবন- সেগুলো রাজউকের আইনে বহুতল ভবন বিল্ডিং কোড অনুযায়ী সেটা বহুতল ভবন নয়। কাজেই সেখানে বহুতল ভবনে যেসব ব্যবস্থা থাকা উচিত এই আইনের ফাঁক থাকায় সেটা থাকছে না। ফলে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। এর সমাধান কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাপানে ৫ তলার ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে ধরা হয়। সেখানে সব ধরনের সেফটি থাকে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেভাবে বহুতল ভবন করা হয়, আমাদের দেশেও সেভাবেই করা উচিত। অর্থাৎ দিনশেষে মানুষের নিরাপত্তাটাই আগে জরুরি। আমরা চাই আইনটা সমন্বয় হোক। সেক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস আইনটাই কার্যকর হওয়া উচিত।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (অপারেশন) ফরিদ আহাম্মদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, ৭ তলা ভবন হলেই ডাবল সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে বলে আমাদের আইনে যেটি বলা আছে, আমরা সেটিই অনুসরণ করি। কেউ যদি রাজউকের আইনের দোহাই দেয় তাহলে আমরা তাদের ফায়ার সেফটি লাইসেন্স দেই না। এরপরও কেউ ওই দোহাই দিয়ে ভবন করলে সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের জায়গাটা পরিষ্কার, জননিরাপত্তার স্বার্থে আমরা আমাদের আইন অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।
আর ফায়ার সার্ভিস নয়, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে রাজউকের সিদ্ধান্তই সঠিক উল্লেখ করে সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ভোরের কাগজকে বলেন, বহুতল ভবনের অনুমোদনের জন্য রাজউক যেটি নির্ধারণ করেছে ১০ তলার ওপরে বহুতল ভবন ধরা হয়, সেটিই সঠিক। কারণ প্ল্যান দেয়ার অথরিটি রাজউক, ফায়ার সার্ভিস নয়। ভবনের অনুমোদন, রুমের আকার কী রকম, কী রকম সিঁড়ি হবে- সেই এখতিয়ার রাজউকের। বিল্ডিং কোডে রাজউককে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, একটি ভবনে কনজ্যুমারর্স অথরিটির দায়িত্ব আছে। সেইসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সেরও দায়িত্ব আছে। রাজউকের দায়িত্ব বিল্ডিংটি সঠিকভাবে হলো কিনা, সেটা দেখার। কিন্তু সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হলো ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার আগে তারা দেখবে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী তারা সেখানে কী কী ব্যবহার করতে পারবে। অকুপেন্সি না থাকলে তারা লাইসেন্স দেবে না। তেমনিভাবে অন্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোও সেটা দেখবে।
ভবন আবাসিক না কী বাণিজ্যিক সেটা দেখেই পানির সংযোগ দেয়া হয় জানিয়ে ঢাকা ওয়াসার কমার্সিয়াল ম্যানেজার উত্তম কুমার বলেন, ঢাকা ওয়াসা প্লট পর্যন্ত পানির সংযোগ দিয়ে থাকে। ভেতরের দায়িত্ব ভবন মালিকের। তিনি যেভাবে সংযোগ নেবেন, সেটা তার বিষয়। আমরা আবাসিক থাকলে আবাসিক সংযোগ দেই, বাণিজ্যিক থাকলে বাণিজ্যক সংযোগ দেই। ভেতরের অবস্থা তদারকির দায়িত্ব আমাদের নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপিডিসির ডিজিএম পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহককে কিছু ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করে আবেদন করতে হয়। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখে সংযোগ দেয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নিই। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ক্লিয়ারেন্সটি অবশ্যই সব ভবনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, আমরা সেটি দেখি। এরপর ভবন যত উচ হয়, তখন পরিবেশ ছাড়পত্রসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের ক্লিয়ারেন্সগুলো খতিয়ে দেখা হয়। তারপর আমরা সংযোগ দেই। কিন্তু এক্ষত্রে রাজউকের নকশা অনুসরণ করাটা আমাদের কাছে জরুরি মনে হয় না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়