ঢাকা আইনজীবী সমিতি : সভাপতি-সম্পাদকসহ আওয়ামীপন্থিদের ২১ পদে জয়

আগের সংবাদ

অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁই বেশি : ঢাকায় রেস্টুরেন্ট ২৫ হাজারের বেশি, ট্রেড লাইসেন্স মাত্র ২৮শর

পরের সংবাদ

দায়ীরা পার পেয়ে যায় যেভাবে

প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রকি আহমেদ : ২০১০ সালে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১২৫ জন। তবে এ ঘটনার ১৪ বছরেও হয়নি কোনো মামলা। এরপর ২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে ঘটে ভয়াবহ আরেক অগ্নিকাণ্ড। এতে নিহত হন ১১২ জন। এ ঘটনায় দুটি মামলা হলেও বিচারকাজ শেষ হয়নি এক যুগেও। গত বছর এ অগ্নিকাণ্ডের মামলার ৬টি তারিখ ধার্য থাকলেও একজন সাক্ষীও হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৯ সালে দেশে ঘটে বড় দুটি অগ্নিকাণ্ড। এর মধ্যে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহত হন। আর বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ২৭ জনের। এ দুই ঘটনায় পৃথক মামলা হলেও বিচার আটকে আছে সাক্ষীতে। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এছাড়া ২০২৩ সালে বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কেউ মারা না গেলেও দোকানে থাকা কোটি কোটি টাকার কাপড় পুড়ে যায়। পথে বসে যান হাজার হাজার ব্যবসায়ী। অথচ এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত হয়নি কোনো মামলা। এভাবে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও বিচারহীনতায় পার পেয়ে যাচ্ছে দায়ীরা। যেসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে, তার আসামিরাও দ্রুত জামিন পেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন বিচারহীনতা ও দায়বদ্ধতার অভাবেই সর্বশেষ বেইলি রোডের মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কাড়ল ৪৬ প্রাণ।
অগ্নিকাণ্ডের এসব মামলার বিচারে ধীরগতি কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু ভোরের কাগজকে বলেন, অনেক মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিতে দেরি করে। এজন্য বিচার শুরু হতে দেরি হয়। এছাড়া সাক্ষীরা আদালতে আসতে চায় না। তাদের হাজির হতে সমন জারি করা হলেও অনাগ্রহ দেখা যায়। আমরা চাই অগ্নিকাণ্ডের মামলাগুলোর বিচারকাজ দ্রুত শেষ হোক। রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী আরো বলেন, অগ্নিকাণ্ডের মূল সমস্যা হলো অসাবধানতা। রাজউকের উচিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ মামলাই করা হয় ৩০৪ (ক) ধারায়, যার সাজা সর্বোচ্চ ৫ বছর। দণ্ডবিধি ৩০৪ (ক) ধারায় অবহেলার ফলে ঘটিত মৃত্যু আইনে বলা আছে, ‘যে ব্যক্তি অপরাধজনক নরহত্যা বলে গণ্য নয় এইরূপ কোনো বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কার্য করে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ পাঁচ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, বা জরিমানা দণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ অর্থাৎ বেইলি রোডে ৪৬ জনের মৃত্যু বা তাজরীন ফ্যাশনসে ১১২ জনের মৃত্যুর মামলা প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ ৫ বছর সাজা হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক ভোরের কাগজকে বলেন, বাইরের দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ আদায়ে দেওয়ানী মামলা হয়। এতে করে আগুন লাগা ভবন বা প্রতিষ্ঠান মালিককে বড় ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তাই তারা সর্বদা সজাগ থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে হয় ফৌজদারি মামলা। যেমন প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের মৃত্যুতেই ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র মামলা হয়। এর সাজার বিধান আছে ৩-৫ বছর। আবার ফৌজদারি আইনে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু যারা সাক্ষী তাদের কোনো স্বার্থ থাকে না। এজন্য আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে চান না। তাই ফৌজদারি মামলা না করে ক্ষতিপূরণে দেওয়ানী মামলা করলে রাউজক লাগবে না, বড় ক্ষতিপূরণের ভয়ে ভবন মালিকরাই সচেতন থাকবেন।

নিমতলী ট্র্যাজেডি : ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলী এলাকার নবাব কাটারার ৪৩ নম্বর বাড়ির একতলার কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১২৫ জন নিহত হন। সারাদেশে শোকের মাতম শুরু হলেও এ ঘটনার ১৪ বছরেও কোনো মামলা হয়নি। দোষী করা হয়নি কাউকে। শুধু ঘটনার কথা উল্লেখ করে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। নিয়ম হচ্ছে- কোনো ঘটনায় জিডি হলে পুলিশকে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হয়। কিন্তু এত বছর পরও প্রতিবেদন দেয়নি পুলিশ।
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড : ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন নিহত এবং দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। ঘটনার পর দিন আশুলিয়া থানার পুলিশ বাদী হয়ে ২টি মামলা দায়ের করেন। মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়। মামলা তদন্ত করে সিআইডি ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর তাজরীনের চেয়ারম্যান মাহমুদা আকতার ও এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। আর মামলা ২টি বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-১ এ বিচারাধীন। যদিও এখন পর্যন্ত মামলায় ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। গত বছরে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ছয়টি তারিখ (১ জানুয়ারি, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ৩০ মে, ১৯ জুলাই, ৩ সেপ্টেম্বর, এবং ১ নভেম্বর) ধার্য ছিল। একটি তারিখেও রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। আগামী ২৫ মার্চও এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি : ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহত হন। এছাড়া আহত হন আরো অনেক। এ ঘটনায় নিহত জুম্মনের ছেলে মো. আসিফ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার ৮ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে। তবে এখনো এ মামলায় বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণই শেষ হয়নি। আগামী ২১ মার্চ বাদীর সাক্ষীর তারিখ ধার্য রয়েছে। এ অগ্নিকাণ্ডে নিহত জুম্মনের ছেলে মো. আসিফ ভোরের কাগজকে বলেন, ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের কথা ভাবলে এখনো শিউরে উঠি। ৫ বছর হয়ে গেল। এখন সেখানে সব আগের মতো চলছে। আগুন লাগা ভবন সংস্কার করে ব্যবহার হচ্ছে। আসামিরা জামিন পেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলার যে ধীরগতি, তাতে ন্যায়বিচার পাব কিনা শঙ্কায় আছি। এ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- আগুন লাগা ভবনের মালিক দুই সহোদর হাসান ওরফে হাসান সুলতান, সোহেল ওরফে শহীদ ওরফে হোসেন, রাসায়নিকের গুদামের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিচালক মোজাম্মেল হক, ম্যানেজার মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াদ আতির, মো. নাবিল ও মোহাম্মদ কাশিফ।
বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড : ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে বনানীর ১৭ নম্বর রোডের এফআর টাওয়ারে আগুন লাগলে ২৭ জন নিহত ও ৭০ জনের বেশি মানুষ আহত হন। রাজউকের ছাড়পত্র ইস্যু ও নকশা অনুমোদন না নিয়ে ভুয়া নকশা তৈরি করে এফআর টাওয়ারের ১৯তলা থেকে ২৩তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক, বিক্রি ও অগ্নিকাণ্ডে জনসাধারণের জানমালের ক্ষতির কারণে দুদক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। এফআর টাওয়ার ভবনের মালিক সৈয়দ মো. হোসাইন ইমাম ফারুক ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুলসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৫ নভেম্বর চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে সাক্ষীতে আটকা আছে।
বঙ্গবাজার মার্কেটে আগুন : ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশে কাপড়ের অন্যতম বড় পাইকারি মার্কেট বঙ্গবাজারে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। হাজারো ব্যবসায়ীকে পথে বসিয়ে দেয়া এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী কে তা এখনো চিহ্নিত হয়নি। হয়নি কোনো মামলাও। তবে বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় বংশাল থানায় অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আগামী ৩১ মার্চ আদালতে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে।
আরমানিটোলায় রাসায়নিকের গুদামে আগুন : ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল রাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে মারা যান ৪ জন। গুরুতর দগ্ধ হন ২১ জন। এ ঘটনায় ২৩ এপ্রিল বংশাল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। এ মামলায় আরমানিটোলার পুড়ে যাওয়া হাজি মুসা ম্যানশন ভবনের মালিক এবং ভবনে থাকা রাসায়নিক গুদামের মালিকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে আনা হয়েছে। এ মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি কোনো আসামিকেও।
আরো ৫ অগ্নিকাণ্ড : ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামে একটি প্যাকেজিং কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে ৪০ বছরের পুরনো ভবনটি ধসে পড়ে। এতে নিহত হন ৩৫ জন। এছাড়া ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে ৩০ শ্রমিক মারা যান। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সদরের গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২১ শ্রমিক। রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ীতে ২০০০ সালে গেøাব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে আগুন লেগে মারা যান ১২ শ্রমিক। এসব ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। প্রতিটি ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেই দায় সেরেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি আনিসুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, মামলার যখন তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার তারিখ থাকে তখন আমাদের পক্ষ থেকে তা দ্রুত দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের ভূমিকা বেশি থাকতে হবে। এছাড়া মামলার চার্জশিট তৈরি হলে আমরা দ্রুত আদালতে দাখিল করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়