ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে : কলকাতায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

সমন্বয় নেই ভবন তদারকিতে : আইনের ফাঁক গলে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন > রাজউকের নকশা মেনেই সেবা সংযোগ দেয়ার পরামর্শ

পরের সংবাদ

নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে গুমোট হয়ে ওঠে ঢামেক প্রাঙ্গণ : বেইলি রোড ট্র্যাজেডি

প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গের সামনে বিলাপ করে কাঁদছিলেন এক বৃদ্ধ। সামনে যেতেই শোনা গেল তিনি বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় নিহত সাগরের (২৪) বাবা তালেব প্রামাণিক। একটু শান্ত হলে তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাবনা জেলার বাসিন্দা তিনি। গত বৃহস্পতিবারই তার ছেলে সাগর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে নিরপত্তারক্ষীর কাজে যোগ দেয়। আর এর মধ্যেই আগুনের ঘটনায় মারা যায় সে। কর্মক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবার আহাজারিতে গতকাল শুক্রবার গুমোট হয়ে ওঠে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ।
শুধু তালেবই নয়, অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মরদেহ নিতে গতকাল সকাল থেকেই ঢামেক হাসপাতাল মর্গে এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভিড় করেন তাদের স্বজনরা। এ সময় তাদের আহাজারিতে গুমোট হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ। আগুনে নিহত ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টের কর্মচারী পটুয়াখালীর জুয়েলের স্ত্রী রেবা আক্তার বলেন, রাত ১০টা পাঁচ মিনিটে শেষ কথা হয়েছিল। এরপর অনেক ফোন করেছি, কিন্তু ফোন আর ধরেনি। এখন স্বামীর মরদেহ পেলাম। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল।
বরগুনা জেলার বড় গৌরিচেনা গ্রামের দিনমজুর বাবার সন্তান নাইম আহমেদ। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে সে ঢাকায় এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি তার। নিথর নাইম ফিরেছে কফিনবন্দী মরদেহ হয়ে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিহত নাইমের বাবা নান্টু মিয়া আহাজারি করে বলছিলেন, নাইমের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে রাত সাড়ে ৯টার দিকে। তখন সে মার্কেটে আগুন লাগার কথা জানায়। এ কথা শুনে ছেলেকে ছাদে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন বাবা। বলেছিলেন, আল্লাহ ফয়সালা করবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
আগুনের ঘটনায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন (৩৪) ও তার স্ত্রী-মেহেরুন্নেছা জাহান হেলালী (২৪) এবং সাড়ে ৩ বছরের মেয়ে ফায়রুজ কাশেম জামিরার লাশ শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে এসে তাদের লাশ শনাক্ত করেন শাহজালালের শ্বশুর মুক্তার আলম হেলালী। তিনি জানান, শাহজালালের অফিস ঢাকার কেরাণীগঞ্জের পানগাঁও। স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কেরাণীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকায় থাকতেন। শাহজালাল
অফিস থেকে ৩ দিনের ছুটি পেয়েছিলেন। সেই ছুটি কাটাতে পরিবার নিয়ে খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই অনুযায়ী রাজারবাগ এলাকায় গ্রিন লাইন বাসের টিকেটও কেটেছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে বাসে চড়ে রওনা দেবে। এজন্য সন্ধ্যায় ৩ জন বাসা থেকে রওনা হন। এরপর বেইলি রোডে ওই ভবনের কোনো একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে উঠেছিলেন। সেখানেই আগুনে পুড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বেইলি রোডে ভবনে আগুনে মৃত ব্যক্তিদের বেশির ভাগের শরীরে পোড়া দাগ দেখা যায়নি। তাহলে এত লোকের মৃত্যু হলো কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও ইউনিটপ্রধান (অরেঞ্জ) প্রবীর চন্দ্র দাস গতকাল বলেন, যে কজন মারা গেছেন, তাদের সবার মৃত্যুর কারণ পরীক্ষা করা সম্ভব না হলেও গত বৃহস্পতিবার রাতে যে ১০ জনকে আনা হয়েছিল তাদের মৃত্যুর কারণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে তা কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং। তিনি বলেন, আহত ব্যক্তিরা আধা ঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিট বদ্ধ ঘরে কালো ধোঁয়ার মধ্যে আটকে ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ঢামেক হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে রোগী এবং তার স্বজনদের চাপ সামলাতে বেগ পেতে দেখা যায়। হাসপাতালের সামনে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নিলেও উৎসুক জনতার ভিড় বরাবরের মতো সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে, যা গতকালও দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেকাতে লাঠিচার্জের ঘটনাও ঘটে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।
বেইলি রোডে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন নিশ্চিত করেছিলেন আগেই। তবে এখন পর্যন্ত শনাক্তকৃত ৪০ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। ৬ জনের মরদেহ মর্গে রয়েছে। মারা যাওয়া ৪২ জনের নাম জানা গেছে। ঢামেক হাসপাতালে যারা মারা গেছেন তারা হলেন- ফওজিয়া আফরিন রিয়া (২২), পপি রায় (৩৬), সম্পূর্ণা পোদ্দার (১১), আশরাফুল ইসলাম আসিফ (২৫), নাজিয়া আক্তার (৩১), আরহাম মোস্তফা আহমেদ (৬), নুরুল ইসলাম (৩২), পম্পা সাহা (৪৬), শান্ত হোসেন (২৪), মায়িশা কবির মাহি (২১), মেহেরা কবির দোলা (২৯), তাজবিন (২৩), মো. জাহিদ (২২), মো. কামরুল হাসান হাবিব (২০), দিলরুবা হক (২৩), আতাউর রহমান শামিম (৬৩), নুসরাত জাহান শিমু (১৯), সাইদা ফাতেমাতুজ্জা জহুরা (১৬), সৈয়দ আবদুল্লাহ (৪০), স্বপ্না আক্তার (৪০), জেরিন তাসনিম প্রিয়তি (২০), সৈয়দ মোবারক (৪৮), বিয়ানঙ্কা রায় (১৮), রুবি রায় (৪৮), তুষার হাওলাদার (২৬), জুয়েল গাজি (৩০), মেহেদী হাসান (২৭), আসিফ (২১), নয়ন (১৭), শাহজালাল উদ্দিন (৩৪), তার স্ত্রী মেহেরুন্নেছা জাহান হেলালী (২৪) ও তাদের সাড়ে ৩ বছরের মেয়ে ফায়রুজ কাশেম জামিরা।
এছাড়া শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে যারা মারা গেছেন তারা হলেন- লুৎফুন নাহার লাকি (৫০) ও তার মেয়ে জান্নাতিন তাজরী নিকিতা, লামিশা ইসলাম (২০), তানজিনা নওরিন (৩৫), সংকল্প শান (৯), আলিশা (১৩), নাহিয়ান আমিন (১৯), আমিনা আক্তার (১৩), মো. স্বপন মিয়া (২১) ও নাইম আহমেদ (১৮)। অন্যদিকে, মুসলিম নাকি সনাতন ধর্মাবলম্বী- এই বিতর্কে মর্গে পড়ে থাকা এক তরুণীর মরদেহ হস্তান্তর করা যায়নি। তরুণীর বাবা দাবি করা এক ব্যক্তি বলছেন, তরুণীর নাম বৃষ্টি খাতুন। তবে সহকর্মী ও পরিচিতরা বলছেন, মরদেহটি অভিশ্রæতি শাস্ত্রীর।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বনগ্রাম এলাকার বাসিন্দা সবুজ শেখ দাবি করেন আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া তরুণী তার মেয়ে বৃষ্টি খাতুন। তিনি বলেন, আমার পরিবার মুসলিম ধর্মাবলম্বী। সেই অনুযায়ী দেখান বৃষ্টির এনআইডি কার্ডের কপি। যদিও তার সহকর্মী ও পরিচিতরা দাবি করেন, তরুণীর নাম অভিশ্রæতি শাস্ত্রী। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব দে বলেন, নিহত ওই তরুণীর নাম অভিশ্রæতি শাস্ত্রী। সনাতন ধর্মের অনুসারী তিনি। পূজার্চনায় নিয়মিত অংশ নিতেন রমনা কালী মন্দির ও ঢাকেশ্বরীতে। বিপ্লব দে ও অভিশ্রæতির সহকর্মীরা দাবি করেন, সে দ্য রিপোর্ট অনলাইন পোর্টালের ইলেকশন কমিশন বিটের রিপোর্টার। এই নামেই সবাই চেনেন তাকে। অন্য একটি অফিসে যেই সিভি পাঠিয়েছিলেন সেখানেও তার নাম অভিশ্রæতি শাস্ত্রী। তার সনাতন ধর্মাবলম্বী বাবা-মাকে খুঁজে বের করে তাদের হাতে মরদেহ বুঝিয়ে দেয়ার দাবি তাদের।
যাদের শনাক্ত করা যায়নি তাদের ডিএনএ টেস্ট করা হবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের ডিএনএ অ্যানালিস্ট মো. আশ্রাফুল আলম ভোরের কাগজকে বলেন, ডিএনএর মাধ্যমে দুজনের মরদেহ শনাক্তে দুটি পরিবারের ৪ জন সদস্য নমুনা দিয়েছেন। আরো কেউ যদি এমন ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন তাহলে সিআইডি বা রমনা থানা পুলিশের সঙ্গে যোগোযোগের জন্য অনুরোধ জানান তিনি। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র, পুলিশপ্রধান ও র‌্যাবপ্রধান হাসপাতালে এসে রোগীদের খোঁজখবর নেন। এ সময় তারা সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেন। এছাড়া দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ও ঢাকা জেলা প্রশাসন সার্বিক কার্যক্রমের খোঁজখবর নেন। আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করাসহ মরদেহ পরিবহনে নগদ সহায়তা করা হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়