ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে : কলকাতায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

সমন্বয় নেই ভবন তদারকিতে : আইনের ফাঁক গলে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন > রাজউকের নকশা মেনেই সেবা সংযোগ দেয়ার পরামর্শ

পরের সংবাদ

বিভীষিকাময় এই মৃত্যুর দায় কার : ভবন ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে মালিককে তিনবার নোটিস দেয় ফায়ার সার্ভিস, রেস্টুরেন্ট কিংবা দোকানের অনুমোদন ছিল না

প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২, ২০২৪ , ১:৫০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কটেজ নামে সাততলা ভবনটি নির্মাণে মানা হয়নি ইমারত বিধিমালা। নিয়মানুযায়ী কোনো বহুতল ভবন তৈরি করা হলে সিঁড়ি থাকতে হয় দুটি, সেই সঙ্গে থাকতে হয় অগ্নিনির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং জরুরি নির্গমন পথ। কিন্তু এই ভবনটিতে ছিল না তার কোনোটিই। এছাড়া ভবনটির বাণিজ্যিক অনুমতি থাকলেও নিয়ম না মেনে করা হয়েছে আবাসিকও। রাজউক বলছে, প্ল্যান অনুযায়ী যথাযথ নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হয়েছে ভবনটি। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ইতোপূর্বে তিনবার নোটিস দেয়া হয়েছে মালিকপক্ষকে; কিন্তু এর কোনো তোয়াক্কা করেননি ভবন মালিক। সিটি করপোরেশনের মতে, ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী থেকে স্থপতি ও মালিক সবাই দায়ী।
এদিকে বেইলি রোডের ওই ভবনটিতে শুক্রবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ জনে। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। এর মধ্যে ১২ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের কারো অবস্থাই শঙ্কামুক্ত নয়। এই মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনায় সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এই বিভীষিকাময় ঘটনার জন্য ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতাকে দায়ী করেন।
জানা গেছে, বেইলি রোডের অগ্নিদুর্ঘটনাকবলিত ওই ভবনটি নির্মাণে ২০১১ সালে একটি বেসমেন্টসহ আবাসিক কাম বাণিজ্যিক অনুমোদন দিয়েছিল রাজউক। হামিদা খাতুন গং নামে প্ল্যান পাস করা হয়। ভবনের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ছিল আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ভবন নির্মাণের পর ফ্লোর স্পেস বিক্রি করে তারা চলে যায়। এরপর তাদের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। ভবনের মালিক কার কাছে কী হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন, সেটা মালিকের বিষয়।
জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইলস এরিয়া প্ল্যানের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবনটির একটি ফ্লোর ছিল আবাসিক। বাকি ফ্লোরগুলো ছিল বাণিজ্যিক। বাণিজ্যিকের মধ্যে দুটি ক্যাটাগরি থাকে। একটি এফ-১ টাইপ, আরেকটি এফ-২ টাইপ। এফ-১ টাইপ হলো অফিস স্পেস হিসেবে অনুমোদন; আর এফ-২ হলো ছোট দোকান বা রেস্টুরেন্ট প্রভৃতি। ভবনটির অনুমোদন ছিল আবাসিক এবং এফ-১ টাইপ অর্থাৎ অফিস স্পেস হিসেবে। এখানে কোনো রেস্টুরেন্টের অনুমোদন ছিল না। ভবনটি রাজউকের প্ল্যান অনুযায়ী যথাযথ নিয়মে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু অফিস স্পেস এবং আবাসিক ব্যবহার না করে এখানে বাণিজ্যিক অর্থাৎ শোরুম ও বেশির ভাগ ফ্লোর স্পেসে রেস্টুরেন্ট আকারে নির্মাণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ৬ তলার উপর কোনো ভবন নির্মাণ করা হলে সেখানে দুটি সিঁড়ি থাকতে হয়। আর রাজউকের বিধিমালা অনুযায়ী দশতলার উপর ভবন হলে দুটি সিঁড়ি নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালের রাজউকের বিধিমালায় ছিল ৬ তলার উপর ভবন হলে দুটি সিঁড়ি থাকতে হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন ডেভলোপার প্রতিষ্ঠান ও আর্কিটেক একপ্রকার চাপ দিয়ে ১০ তলার উপর ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে করে নেয়। আর বর্তমানে সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়েছে। রাজধানীর কোথাও ১০ তলার নিচে কোনো বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে আইন অনুযায়ী রাজউক তার দায় এড়াতে পারে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আইনে ১০ তলার নিচে বা ৬ তলার উপরে কোনো বহুতল ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে রাজউক দায় এড়াতে পারে না। অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ৬ তলার উপরে বহুতল ভবন ধরা হয়েছে। আর রাজউকের আইন অনুযায়ী ১০ তলার উপর বহুতল ভবন হিসেবে ধরা হয়।
গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি পরিদর্শনে এসে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন মালিককে তিনবার চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বেইলি রোডের বাণিজ্যিক ভবনটির অগ্নিনির্গমন পথ না থাকায় গতকাল ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছি; তবুও মানুষ এতটা সচেতন নয়। একটি বহুতল ভবনে আগুন লেগেছে, যার কোনো অগ্নিনির্গমন পথের ব্যবস্থা নেই। কোনো ভবন বা স্থাপনা তৈরির সময় স্থাপত্যবিদদের অনুরোধ করি- যেন খোলা বারান্দা বা ভেন্টিলেশন ও অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু স্থাপত্যবিদরা সেভাবে নকশা করেন না; আবার মালিকরা এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়তে চায় না। আমরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার (নির্বাপক) লাগানোসহ অগ্নিনির্গমন পথের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ বারবার দিচ্ছি। সেটা তারা মানে না।
গতকাল দুর্ঘটনাস্থল পরির্দশনে এসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি নির্মাণের সময় অনিয়ম হয়েছে। পাঁচ তলার উপর কোনো ভবন হলে দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। এই ভবনে তা ছিল না। সিঁড়ি প্রশস্ত থাকার কথা; কিন্তু এই ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি, তা-ও প্রশস্ত নয়। এছাড়া ভবনটি বাণিজ্যিক কাজের জন্য অনুমোদন নেয়ার পরও আবাসিক করা হয়েছে বিনা অনুমতিতে। ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়র বলেন, ভবন নির্মাণে ইমারত বিধিমালাগুলো ন্যক্কারজনকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তদারকিতেও গাফিলতি রয়েছে, পর্যাপ্ত তদারকি হচ্ছে না। নকশা অনুমোদন হচ্ছে, কিন্তু নকশায় ইমারত বিধিমালা মানা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে নকশা ঠিক থাকলেও ভবন নির্মাণে অনিয়ম করা হচ্ছে। যখন দুর্ঘটনা ঘটে, তখন নজর দেয়া হয়। তখন নজর দিয়ে আমরা একই কারণ পাচ্ছি। ভবন নির্মাণে প্রকৌশলী থেকে স্থপতি এবং মালিক সবাইকেই সেই দায় বহন করতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়