সিংগাইর : হাত কাটা ও গুলি করার হুমকিদাতার বিরুদ্ধে মামলা

আগের সংবাদ

নৌকা নেই, তাই আমেজ কম

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের নির্বাচন আমেরিকার মুখ পোড়াবে

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া গণতন্ত্র নিয়ে তাদের বোধ-বুদ্ধি ও সদিচ্ছার ওপর একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন তুলে দিয়েছে। আমেরিকা নিজেদের গণতন্ত্রের পূজারি বলে তুমুল প্রচার করে। বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের রকমফের আছে। আমেরিকায় নির্বাচন হয় ইলেকটোরাল পদ্ধতিতে। কিন্তু ভারত বা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এই পদ্ধতিতে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচিত বিরোধী দলের একটা ভূমিকা থাকে। কিন্তু সংজ্ঞা অনুযায়ী বিরোধী দল তারাই যারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসন দখল করে সংসদে সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য শপথ নেয়। বাংলাদেশের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি, জামায়াত ও আরো কিছু খুচরো দল নির্বাচন বয়কট করছে নিরপেক্ষ সরকার পরিচালিত নির্বাচনের দাবিতে। ২০১৪ সালে তারা একই দাবিতে ভোট বয়কট করেছিল। ২০১৯ সালে তাদের ভরাডুবি হয়। এবারে অর্থাৎ ২০২৪ সালেও তারা ভোটে যাচ্ছেন না।
এ কথা সত্যি যে, জোরদার বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচে না। নাগরিক সমাজে এবং বৃহত্তর লোকসমাজে রাজনীতিকে যদি তার পঙ্কশয্যা থেকে টেনে তুলতে হয়, তবে তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিরোধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ। অংশগ্রহণ মানে সভা ডেকে মাইক ভাড়া করে ভাষণ দেয়া নয়, গলা এবং গাল ফুলিয়ে সেøাগান কীর্তন নয়, অংশগ্রহণ মানে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সংকটে সহায় হওয়া, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে সরব ও সক্রিয় হওয়া, সেই অধিকার আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ ও সংগঠিত উপায়ে শাসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। বৃহৎ অর্থে এ কাজ স্বেচ্ছাসেবীর কাজ, কারণ যথার্থ স্ব-ইচ্ছাই এমন উদ্যোগের প্রকৃত চালিকা শক্তি হতে পারে, ওপর থেকে দলীয় নির্দেশ বা নেতানেত্রীর অনুপ্রেরণা দিয়ে সত্যিকার সামাজিক আন্দোলন হয় না। প্রশ্ন এখানেই যে, যারা আজ নির্বাচন বয়কট করছেন তারা কি এই গণআন্দোলন গত পাঁচ বছরে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশে? বরং সে পথে না গিয়ে তারা ভারতের কাছে, চীনের কাছে ও আমেরিকার কাছে প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের দাবিতে।
বাংলাদেশ অবশ্যই ছোট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। কিন্তু গণতন্ত্র মানে কেবল শাসকের অভিপ্রায় নয়, বিরোধীদেরও তাতে প্রতিবাদের পূর্ণাঙ্গ অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর যৌথ আন্দোলন সহজেই হিংসাত্মক হয়, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। সেজন্য শাসকের দমননীতি জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাইরে আসার পথটিই রুদ্ধ করে দিয়েছে। এখানেই সমস্যা গভীর হচ্ছে। ভারত ও চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারকামী পরস্পর প্রতিযোগী দেশ। অথচ এই দুই দেশই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর পক্ষপাতী। বাংলাদেশের আমজনতা ভারতকে আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে প্রচার করে। কিন্তু আমেরিকার লাফালাফিতে ভারত প্রায় বাধ্য হয়ে আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি বার্তা দিয়েছে। তা হলো ‘বাংলাদেশের নির্বাচন সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সে দেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’ এই বিষয়ে চীনের বক্তব্য প্রায় একই। তা হলো ‘সংবিধান ও আইন অনুযায়ীই বাংলাদেশের নির্বাচন চায় চীন। ওই নির্বাচন নিয়ে বাইরের কোনো দেশের হস্তক্ষেপ চায় না চীন। বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।’
কিন্তু ‘নাই কাজ তো খই ভাজ’ নীতি নিয়ে আমেরিকা নাক গলাচ্ছে এই নির্বাচনে। প্রথমে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিরোধী নেত্রীর সঙ্গে সংলাপ শুরুর কথা বলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা তার প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন ও কথা বলার সময় বিরোধী দলের সঙ্গে শর্তহীনভাবে সংলাপের বিষয়ে আশা প্রকাশ করেন। এরপর আমেরিকা বিবৃতি দিয়ে বলেছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনে যারাই বাধা দেবে, তাদের ভিসা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠছে এই যে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার এত মাথাব্যথা কেন? তারা পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে নিশ্চুপ, ইসরায়েলের গাজার ওপর প্রতিদিনের বোমা বিস্ফোরণ নিয়ে নিশ্চুপ, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ নিয়ে নীরব; কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এত উৎসাহী কেন? সবচেয়ে বড় কথা গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে তাদের মুখ বন্ধ কেন? সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের সংজ্ঞা অনুযায়ী বিরোধী দল তারাই যাদের সংসদে আসন আছে। এর বাইরের দলগুলোকে আমেরিকার মতো দেশেও বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হয় না। অথচ এই বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার চাপ তারা দিলেন না কেন?
এককথায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজের দেশেই খুব চাপে আছেন। পরবর্তী মার্কিন নির্বাচনে তার প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে আবার উঠে আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জো বাইডেন নিজেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বা গণতন্ত্রীকরণের লড়াইয়ের সৈনিক হিসেবে সবসময় তুলে ধরতে চান। সেখানে তিনি পড়েছেন গভীর গাড্ডায়। গাজা ভূখণ্ডে সাধারণ মানুষ নিধন বা পাকিস্তানে বালুচিস্তানে বিদ্রোহী নিধন সবই হচ্ছে মার্কিন অস্ত্রে। সেখানে কোথায় তাদের মানবাধিকার রক্ষা? ইতোমধ্যে রাশিয়াও তাদের বক্তব্য জানিয়েছে। মস্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ‘বাংলাদেশের ভোট নিয়ে আমেরিকা পরামর্শ দেয়ার কে? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভোট নিয়ে শেষ কথা বলবে সে দেশের জনগণ। আমেরিকার মাথাব্যথা কিসে!’
বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। তখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র?্যাব ও ছয়জন কর্মকর্তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন। চলতি বছরের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতির কথা জানায়। যেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবারের নির্বাচনে থাইল্যান্ড, নেপাল, ভারত, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ডাচ, ইরাক, ফিলিস্তিন, জর্জিয়া, উগান্ডা, নরওয়ে, বুলগেরিয়া, কঙ্গো থেকে আগামী ৭ জানুয়ারির ভোট পর্যবেক্ষণ করতে প্রতিনিধি দল আসছে। কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশ গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে আমেরিকা পাঠাচ্ছে দুটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানকে। ভোটের আগে পরের সহিংসতা ও ত্রæটিগুলো মূল্যায়ন করতেই নাকি পাঠানো হয়েছে ছোট এই ‘যৌথ কারিগরি মূল্যায়ন দল’। প্রতিষ্ঠান দুটি বাংলাদেশে থাকবে ৬-৮ সপ্তাহ। অতএব বোঝা যাচ্ছে আমেরিকা এই নির্বাচন নিয়ে তাদের পূর্বের বক্তব্যে অবিচল।
জো বাইডেন আজীবনই ইসরায়েলপন্থি। নিজে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের হলেও তিনি বিশ্বাস করেন, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখা তার দায়িত্ব। টাইম সাময়িকীর ভাষায়, বাইডেনই হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় ইসরায়েলপন্থি প্রেসিডেন্ট’। বাইডেনের এই অবস্থান তাকে ইসরায়েলে অসম্ভব জনপ্রিয় করলেও নিজ দেশে তিনি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ইসরায়েলের বেপরোয়া বোমাবর্ষণের ফলে বেসামরিক মানুষ, বিশেষত নারী ও শিশু, বিপুল সংখ্যায় হতাহত হচ্ছে। এসব খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই ব্যাপক প্রতিবাদ ওঠে। প্রতিবাদ ওঠে বিশ্বজুড়ে। জাতিসংঘের ভেতরে অবিলম্বে ‘মানবিক’ যুদ্ধবিরতির দাবি উঠলে বাইডেনের নির্দেশে শুধু সে প্রস্তাবে ভেটো দেয়া হয়নি, হামাস নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। সাম্প্রতিক জনমত জরিপ থেকে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির পক্ষে (৬১ শতাংশ)। ডেমোক্র্যাট ও স্বতন্ত্র ভোটাররা তো বটেই, এমনকি রিপাবলিকানদের মধ্যেও ৪৯ শতাংশ মানুষ যুদ্ধবিরতির পক্ষে রায় দিয়েছেন। ফলে নিজের দেশে জো বাইডেন গভীর গাড্ডায়।
এটা তার প্রত্যাশিত ছিল না। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে তিনি গোঁয়ার্তুমির অবস্থান নিয়েছেন। আমেরিকায় বাংলাদেশি বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনসংখ্যা কম নয়। চীন, ভারত বা অন্যান্য বহু দেশ নিয়ে ট্যাঁ ফোঁ করার ক্ষমতা আজ আর তার নেই। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশ নিয়ে তাদের হাত গুটিয়ে নিয়েছে প্রায় ১০ বছর হলো। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে বা প্রগতির ধ্বজা ওড়াতে প্রভূত সাহায্য করলেও কখনো তাদের অভ্যন্তরীণ বা বাণিজ্যিক বিষয়ে নাক গলায়নি। বরং বাংলাদেশকে বিভিন্ন মঞ্চে সর্বাধিক সম্মানের আসনে বসিয়েছে। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা খুবই একা হয়ে পড়েছে। তার ওপরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে আছেন তাতে এই নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার অবস্থান তাদের মুখপোড়ার পক্ষে যথেষ্ট।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়