ডিএমপির আদাবর থানা : ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামি পালিয়েছে হাজতখানা থেকে

আগের সংবাদ

নাশকতার জবাব ভোটে দিন : ঢাকায় নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

নৌকা নেই, তাই আমেজ কম

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীককে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এসব আসন থেকে দলীয় প্রতীক নৌকার প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে দলটি। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বড় একটি অংশ অনেকটাই হতাশ। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। কিছু আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায়, দলটির নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। তারা প্রচার-প্রচারণা, মিছিল ও সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু লাঙ্গলের পক্ষে যেতে চাইছেন না নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, একই আসনে বারবার লাঙ্গলকে ছাড় দেয়ায় সাংগঠনিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ছে দল। আর লাঙ্গলের প্রার্থীরা বিজয়ী হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না। এলাকার উন্নযনেও তারা খুব একটা ভূমিকা রাখেন না।
লাঙ্গলকে ছাড় দেয়া বেশ কিছু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদেরও কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর বেশির ভাগই ঈগল, ট্রাক, কাঁচি ও কেটলি প্রতীকে লড়ছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন দলটির নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ। ফলে তৃণমূলে কিছুটা সরগরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। আর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষ নেয়ায় অনেকটা বেকায়দায় পড়েছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। নিজেদের জয়ের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তারা। তাই দলটির হাইকমান্ড আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছে- যেন শেষ পর্যন্তও তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্ব›িদ্বতা থেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কিছুই করার নেই বলে জানানো হয় জাতীয় পার্টিকে।
জানা গেছে, যে ২৬টি আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেসব আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেন লাঙ্গলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন- সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে দলটির হাইকমান্ড থেকে। পদবিধারী নেতারা যেন কোনোভাবেই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে না যায়, সে ব্যাপারেও দেয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষেও কাজ করতে পারবেন না। দলের শীর্ষ পর্যায়ের এমন নির্দেশনার পর দ্বিধাদ্ব›েদ্ব পড়ে গেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা এখন প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষেও অবস্থান নিতে পারছেন না। নেতাকর্মীদের অনেকেই চুপচাপ থাকছেন। কেউ কেউ আবার দলের নির্দেশনা মেনে লোক দেখানো হলেও লাঙ্গলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন, লিফলেট বিতরণ করছেন, মানুষের কাছে ছোট চাইছেন। তবে ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশই নীরব ভূমিকায় থাকছেন। কারণ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে তারা প্রকাশ্যে নামার সুযোগ পাচ্ছেন না। যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও। ভোটাররা মনে করছেন, প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতা না থাকলে ভোটের আমেজে ভাটা পড়বে। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ারও আগ্রহ খুব একটা থাকবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুড়িগ্রাম সদর আওয়ামী লীগের একজন নেতা ভোরের কাগজকে বলেন, টানা তিনবার আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশে আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লাঙ্গলকে জিতিয়ে আনতে মাঠে দিনরাত পরিশ্রম করি। বিজয়ী হওয়ার পর লাঙ্গলের এমপি আমাদের নেতাকর্মীদের প্রতিপক্ষ ভাবেন।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না। এবার প্রথমে নৌকার প্রার্থী দেয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছি। ভেদাভেদ ভুলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৌকার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। চারিদিকে উৎসবের আমেজ বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৌকা প্রত্যাহার করায় সেই আমেজে ভাটা পড়ে। আবার জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে মানসিকভাবে আমাদের নেতাকর্মীরা অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা লাঙ্গলের পক্ষে কাজ করতে চাইছেন না। ভোটাররাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী যিনি আছেন, তার পক্ষে কেউ কেউ কাজ করলেও এখন দলের নির্দেশে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এরকম পরিস্থিতিতে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোটা অনেকটাই দুষ্কর হয়ে পড়বে।
এদিকে নৌকা না থাকলেও লাঙ্গলের আসনগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াতে নেয়া হচ্ছে নানা কৌশল। জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের যেসব নেতা সক্রিয় আছেন তাদের নিয়ে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করা হচ্ছে। জোর দেয়া হচ্ছে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর দিকে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি এলাকা ও মহল্লায় মাইকিং করা হচ্ছে, প্রতিটি অলি-গলি পোস্টার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা ছুটছেন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে।
রংপুর-১ আসনের ভোটার জহিরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে জানান, ২০০৮ সালে ভোটার হয়েছি। সমর্থন করি আওয়ামী লীগকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একটিবারও সংসদ নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিতে পারিনি। লাঙ্গলকেই ভোট দিতে হয়েছে। এবার নৌকার প্রার্থী ঘোষণা করায় আশা করেছিলাম স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার মতো অনেকেই খুশি হয়েছিলেন- এবার নৌকায় ভোট দিতে পারব। কিন্তু তা আর হলো না, আবার লাঙ্গলকেই ছেড়ে দেয়া হলো আসনটি। তাই ভোটে এখন আগ্রহ কমে গেছে। তবে, ভোটে আগ্রহ কিছুটা কমলেও আসনটিতে বর্তমান এমপি মশিউর রহমান রাঙ্গা এবার ট্রাক প্রতীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। এখানে লাঙ্গল প্রতীক পেয়েছেন সাবেক এমপি হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। আর গঙ্গাচড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান বাবুল লড়ছেন কেটলি প্রতীকে। এই তিন প্রার্থীই প্রচার-প্রচারণায় কেউ কারো চেয়ে কম নয়। সেক্ষেত্রে এখানে নির্বাচন কিছুটা জমে উঠেছে। তিন প্রার্থী থাকায় ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বাড়তে পারে। তবে নৌকা থাকলে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো যেত বলেও মনে করেন জহিরুল।
নীলফামারী-৪ জলঢাকা আসনটিও ছেড়ে দেয়া হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। আবদুস সোবহান নামের একজন ভোটার জানান, বিএনপি না এলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলে শক্ত প্রতিদ্ব›িদ্বতা হতো। যেহেতু শক্ত প্রার্থী নেই, তাই ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছি। সাধারণ ভোটার তো আছেনই, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন কিনা, সেটাও এখনি বলা যাচ্ছে না।
রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ ভোরের কাগজকে বলেন, রংপুর লাঙ্গলের ঘাঁটি। প্রান্তিক মানুষের বসবাস এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। তারা লাঙ্গলকে ভালবাসেন। প্রতিটি নির্বাচনেই লাঙ্গলকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেন, এবারো করবেন। তিনি বলেন, এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু তাদের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে। জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত একজন (মশিউর রহমান রাঙ্গা) নির্বাচন করছেন। তবে লাঙ্গলের বিজয়ে রাঙ্গা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবেন না। এই প্রার্থীর আশা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবেন। তাদের বেশির ভাগই লাঙ্গলকে ভোট দেয়ার জন্যই ভোট কেন্দ্রে যাবেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ভোরের কাগজকে বলেন, সারাদেশেই নির্বাচন জমে উঠেছে। যেসব আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয়া হয়েছে, সেসব আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলের সিদ্ধান্ত মেনেই লাঙ্গলের পক্ষে কাজ করছেন। অনেক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্তিশালী অবস্থানে আছেন। নির্বাচন প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক হচ্ছে। আমরা ভোটারদের আগ্রহ দেখছি। আশা করছি, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।
ভোটারদের আগ্রহ কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টির মধ্যে বোঝাপড়ার কারণে সমঝোতা হওয়া আসনগুলোতে দুই দলেরই নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে গেছে- এটা আমার কাছে মনে হয় না। হয়তো নির্বাচনকালীন যেমনটা আমরা দেখি, সেটা একটু কম দেখা যেতে পারে। কিন্তু সর্বোপরি আমি বলব, দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটা অংশ রাজনীতি এবং রাজনীতিবিরোধী যে শক্ত বক্তব্য দিয়ে আসছেন, সেই বক্তব্যের একটা কুপ্রভাব একেবারেই তৃণমূল পর্যায়েও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়েছে। এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যেহেতু মতামত তৈরি করতে সক্ষম, সেটির একটা প্রভাব গোটা সমাজে লক্ষ্য করা যায়। ফলে রাজনীতি মাত্রই খারাপ- এরকম একটা বক্তব্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেটিরই সম্ভবত একটা প্রতিফলন আমরা দেখি। জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া শুধু এই ২৬টি আসনেই নয়, সারাদেশেই এরকম একটা প্রভাব পড়ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়