পররাষ্ট্রমন্ত্রী : সোমবার ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার

আগের সংবাদ

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কি কখনো থামবে না?

প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মৃত্যু সব সময়ই কষ্টদায়ক এবং হৃদয়বিদারক হওয়া সত্ত্বেও আমরা সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে মৃত্যুর সঙ্গেও খানিকটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলে ফেলেছি। মৃত্যু এখন আমাদের আর আগের মতো বেদনাকাতর করে তোলে না; চোখের কোণে নিজের অজান্তেই অশ্রæ উৎপাদন করে না; কিংবা ভেতরে মানবিক খারাপ-লাগা বলে যে একটা অনুভূতি আছে, সেটাও খুব একটা তীব্রভাবে আর কাজ করে না। চতুর্দিকে নিত্য মৃত্যুর ঘটনা দেখে মৃত্যু সম্পর্কিত আমাদের অনুভূতিগুলো খানিকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। কেননা চারপাশে কারণে-অকারণে প্রতিদিন এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এবং সংবাদপত্রে প্রতিদিন এত মানুষের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়, মৃত্যু মানুষের মধ্যে যে ধরনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়ার কথা, সেটাও অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমান্বয়ে এত লম্বা হচ্ছে, আমাদের ভেতরে যে মাত্রার প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়ার কথা এবং যে মাত্রার বেদনাবিধুর অনুভূতি থাকার কথা, সেটা আমাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। কেননা মৃত্যু এখন আমাদের নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এটা স্বীকার্য, আমার এই কথাগুলোর মধ্যে খানিকটা ক্ষোভ আছে, খানিকটা বিক্ষোভ আছে, খানিকটা যন্ত্রণা আছে এবং খানিকটা প্রতিবাদের ভাষা আছে। কেননা একটা দেশে ক্রমাগতভাবে ক্রমবর্ধমান হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে; কিন্তু কোনোভাবে এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। ফলে এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান এবং আমাদের অনুভূতি ক্রমহ্রাসমান। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে আর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের যন্ত্রণা এবং কাতরতা ক্রমান্বয়ে কমছে। এটা একটি সমাজের পতনের অন্যতম স্মারকচিহ্ন। মনে রাখতে হবে, যে সমাজের মানুষ অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে, সে সমাজ কোনোদিন মানবিক সমাজ হতে পারে না। মানুষের মৃত্যু যে সমাজের ভেতর একটি বেদনাতুর অনুভূতির সৃষ্টি করে না, সে সমাজ কোনোদিন একটি মানবিক সমাজে উঠতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা ঠিক সে দিকে ধাবিত হচ্ছি।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত মার্চ (২০২৪) মাসে অর্থাৎ এক মাসে ৫৬৫ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ভাবা যায়, একটি দেশে এক মাসে এত মানুষ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়; কিন্তু আমাদের মধ্যে এটা কোনো তীব্র অনুভূতির সৃষ্টি করে নেই। ৫৬৫ জন মানুষের মৃত্যু কেবল সংবাদপত্রের মামুলি ‘নিউজ আইটেম’ প্রকাশিত হয়েছে এবং পরের দিন সেটা অন্য শিরোনামকে জায়গা দিতে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা জরুরি, ৫৬৫ কেবল একটি সংখ্যা নয়, ৫৬৫টি জীবন এবং সে জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো হাজারো মানুষের জীবন ও পরিবারের অবস্থা, পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কি কোনো চিন্তা করেছি? আমাদের মধ্যে কোনো অনুভূতি কি তৈরি হয়েছে? আমরা কি কোনো মানবিক অনুভূতি দিয়ে সেই জায়গায় নিজেকে দাঁড় করে পরিস্থিতিকে একবার বোঝার চেষ্টা করেছি? করিনি, কারণ আমরা মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করে মৃত্যুকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়ে আমাদের অনুভূতিগুলোকে আবেগহীন, বিবেকহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন করে তুলেছি। আমরা শুধু সড়ক পথের দুর্ঘটনার কথা বলছি; কিন্তু রেলপথে এবং নৌপথে মৃত্যুর সংখ্যা একেবারেই কম নয়। একই সময়ে রেলপথে ৩৮টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত এবং ৮৬ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে সাতটি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৫৯৭টি দুর্ঘটনায় ৬১২ জন নিহত এবং ১৩৩১ জন আহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমান্বয়ে আরো লম্বা হবে। এখানে লেখাবাহুল্য, এ সংখ্যার নির্ধারণের গবেষণা পদ্ধতি হচ্ছে, দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌপথের দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংগঠনটি। ফলে সংবাদপত্রের নজরের বাইরে থাকা অনেক ঘটনা এখানে লিপিবদ্ধ হয়নি। প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, ‘প্রকাশিত এই তথ্য দেশে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র নয়। এটি কেবল গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য। দেশে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গণমাধ্যমে স্থান পায় না। তাই এসব তথ্য আমাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব হয় না। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রাথমিক উৎসস্থল দেশের হাসপাতালগুলোতে দেখলে এমন ভয়াবহ তথ্য মেলে।’ প্রতিবেদনের দাবি অনুযায়ী এই পরিসংখ্যান যদি মোট ঘটনার ৩০ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে এই সংখ্যা আমরা তিন গুণ হিসেবে ধরে নিতে পারি। অর্থাৎ মার্চ মাসে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজারের ওপরে। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০ হাজার সরকারি ও ৬ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত প্রায় তিন লাখের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। অথচ গণমাধ্যমে তার ১০ ভাগের এক শতাংশ তথ্যও প্রকাশিত হয় না বলে আমরা ঘটনার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরতে পারি না।
তাহলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু কেন এসব দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মৃত্যুর মিছিল ক্রমান্বয়ে ক্রমবর্ধমান হচ্ছে প্রতিবেদনে তার কিছু ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে- ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ, দুর্বল প্রয়োগ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনিয়ম-দুর্নীতি ব্যাপক বৃদ্ধি, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার যানের ব্যাপক বৃদ্ধি ও এসব যানবাহন সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল, সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কে বাতি না থাকা, রাতের বেলায় ফগ লাইটের অবাধ ব্যবহার, সড়ক-মহাসড়কে নির্মাণ ত্রæটি, ফিটনেস যানবাহন ও অদক্ষ চালকের হার ব্যাপক বৃদ্ধি, ফুটপাত বেদখল, যানবাহনের ত্রæটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা, উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি এবং অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানো।’ এসব কারণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এখানে আছে প্রশাসনিক অদক্ষতা, মনিটরিংয়ের অভাব, দুর্নীতি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতার অপব্যবহার, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, আমাদের আইন না মানার স্বভাবসুলভ প্রবণতা এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। প্রতিবেদনের এসব মৃত্যুর ঘটনা কীভাবে এড়ানো যায়, তারও কিছু সুপারিশ দেয়া হয়েছে, ‘দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রাথমিক উৎস থেকে সড়ক দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ডাটা ব্যাংক চালু করা, স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের মতো ছোট ছোট যানবাহন আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা, দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, ডিজিটাল পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস প্রদান, রাতের বেলায় বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেল চালকদের রিফ্লেক্টিং ভেস্ট পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক করা, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা, রাতের বেলায় চলাচলের জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে পর্যাপ্ত আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা, ব্লাক স্পট নিরসন করা, সড়ক নিরাপত্তা অডিট করা, স্টার মানের সড়ক করিডোর গড়ে তোলা এবং দেশে সড়কে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর চলমান গতানুগতিক কার্যক্রম অডিট করে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা চিহ্নিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকারিতা জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা।’ সুপারিশমালাগুলো যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে একটু সদিচ্ছা থাকলে, মানবিক অনুভূতি থাকলে, খানিকটা দায়িত্বজ্ঞান থাকলে এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করলে এর অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এখানে একটা কথা বলা জরুরি, আমরা সবকিছুর জন্য সরকারকে এবং রাষ্ট্রকে দায়ী করার একটা প্রবণতা লক্ষ করি; কিন্তু আমরা সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের নিজেদের দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করছি কিনা, সে প্রশ্ন আমরা নিজেদের কখনো করি না। ফলে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে সাধু সাব্যস্ত করার জন্য আমাদের যে জাতিগত ঐতিহ্য, সেটাও এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ বলে আমি মনে করি।
পরিশেষে বলব, এক মাসে প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু, এটা কোনোভাবেই একটি সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। এই দেড় হাজার মানুষ আমাদেরই কারো ভাই, কারো বন্ধু, কারো পিতা-মাতা, সন্তান, আত্মীয় ও পরিজন। ফলে আমাদের সচেতনতাই আমাদের পরিবারকে রক্ষা করতে পারে। আমাদের দায়িত্বশীলতাই আমাদের পরিবারকে রক্ষা করতে পারে। তাই আমরা যে যেখানে, যে অবস্থায়, যে পদে, যে পর্যায়ে এবং যে পজিশনে থাকি না কেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হবে। এটা কোনো দাবি-দাওয়ার বিষয় নয়, এটা দায়িত্বশীলতার বিষয় সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি এবং সমাজের মানুষের প্রতি কর্তব্যকর্মের বিষয়। অন্যথায় এই মিছিলে নিজের অজান্তেই আমি-আপনিও একজন সারথি হয়ে যেতে পারি যে কোনো সময়। এ নিষ্ঠুর বাস্তবতা কারো জন্য কাম্য নয়।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়