আশুলিয়ায় ফার্নিচার গুদামে বিস্ফোরণ, দগ্ধ ৩

আগের সংবাদ

বাতাসে আগুনের হলকা!

পরের সংবাদ

আমলার মুজিব দর্শন ২

প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব এবং জীবিত বিশিষ্ট আমলাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মতিউল ইসলামের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের ‘দ্য বিগিনিং অ্যান্ড অব মাই লাইফলঙ্গ অ্যাসোসিয়েশন উইথ শেখ মুজিব’-এর পরবর্তী অংশের অনুসৃতি:
ব্যাংকে পেশাগত পর্যায়ের পদগুলোতে নিয়োগ যেন মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে হয় আমি তা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেছি এবং কঠোরভাবে তা পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করেছি। একটি ক্ষেত্রে অবশ্য আমাকে ব্যতিক্রম কিছু করতে হয়েছে যখন মন্ত্রিপরিষদের একজন সিনিয়র মন্ত্রী তার মনোনীত প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার জন্য আমাকে একাধিকবার অনুরোধ করেছেন এবং তৃতীয়বার হুমকি দিয়েছেন তার কথা না রাখলে আমাকে মারাত্মক পরিণতি মোকাবিলা করতে হবে।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করলাম আমার বড় ভাই টিসিবি চেয়ারম্যান পদে কর্মরত নুরুল ইসলামকে যেন এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করলেন এ কারণে যে, টিসিবি চালানোর মতো একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি নুরুল ইসলাম। যাক শেষ পর্যন্ত তিনি ৩ মাসের জন্য নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করার অনুমতি দিলেন। এ সময় তিনি এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক গঠন সম্পন্ন করে দিয়ে আসবেন। শিল্পায়নের কাঁচামাল এবং অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্যের আমদানি অব্যাহত রাখতে আমার সঙ্গে আলোচনা করে ডেফারড পেমেন্ট পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। বিদেশে নতুন সৃষ্টি করা এবং পুরনো দূতাবাসগুলো চালু রাখতে সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংককে বিদেশি ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে উচ্চতর সুদে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে।
আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মুদ্রারহিতকরণের দিকে না গিয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ধীরে ধীরে পাকিস্তানি নোট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিই, যাতে এ নিয়ে অর্থনীতিতে কোনো দ্বিধাদ্ব›েদ্বর সৃষ্টি না হয়। তবে একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করতে হয়েছে যখন পাকিস্তান বাংলাদেশে চালু একটি বিশেষ মুদ্রামানের নোট রহিত ঘোষণা করে।
১৯৭১-এর মার্চে প্রধানমন্ত্রীর লেনিনগ্রাদে রাষ্ট্রীয় সফরে আমিও তার সফরসঙ্গী, এ সময় অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের পাকিস্তানের একটি নোট রহিতকরণের বিষয়টি জানালেন এবং আমাদের পূর্বনির্ধারিত সময়সীমার জন্য অপেক্ষা না করে তাৎক্ষণিকভাবে এই নোট রহিতকরণের (ডিমনিটাইজেশন) সুপারিশ করলেন। ডেটলাইন আসতে তখন আরো ১০ দিন। আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে দেয়া বাঙ্কোয়েট থেকে দ্রুত বেরিয়ে হোটেলে চলে আসতে হলো এবং সেখান থেকে প্রেসিডেন্টকে সাইফার বার্তা পাঠালাম যাতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে যেন সেই নোট রহিত ঘোষণা করেন।
অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। কিন্তু পাট, বস্ত্র এবং চিনিশিল্প জাতীয়করণের প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্ভাব্য কারণ এটাই ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচন মেনিফেস্টো। মন্ত্রিসভা বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের দাখিল করা একটি কর্মপত্র আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন জমি ক্রয় কেমন করে উন্নয়ন ব্যয় হিসেবে বিবেচিত হবে? বেশ অদ্ভুত লাগল, ১৯৫৬-৫৭ সালের একটি বিতর্ক প্রধানমন্ত্রী এভাবে উত্থাপন করবেন ভাবার কথা নয়; ডক্টর মাহবুবুল আলমের নির্দেশনায় পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশন এ সময় ‘উন্নয়ন’ এবং ‘অ-উন্নয়ন’ ব্যয় নিয়ে বিতর্কের এটি ছিল বিষয়। সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে আমার তাৎক্ষণিক তৈরি জবাব : স্যার শিল্প স্থাপন উন্নয়ন ব্যয়, আর শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজন তিন ধরনের মূলধন ব্যয় : জমি, ভবন ও যন্ত্রপাতি। কাজেই জমি ক্রয়কেও উন্নয়ন ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তিনি আমার জবাবে সন্তুষ্ট হলেন।
সফরের দ্বিতীয় দিন কলকাতায় আমাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গভর্নমেন্ট হাউসের বাঙ্কোয়েট হলে ভোজনের আমন্ত্রণ জানালেন। আমি অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্যুটে প্রবেশ করলাম, তাকে নিয়ে বাঙ্কোয়েট হলে যাব, কিন্তু সেখানে দেখলাম উত্তেজনা- কী ঘটেছে? প্রধানমন্ত্রীর নতুনতম মুজিব কোর্টের গলা ঠিকভাবে সেট হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী তো আর খোলা গলায় বাঙ্কোয়েটে প্রবেশ করতে পারেন না। আমি পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে অন্য সবাইকে তাঁর রুম থেকে বের করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, সারসের মতো গলা যতটা সম্ভব উঁচু করুন। একই সঙ্গে আমিও কলারের দুই প্রান্ত চেপে কাছাকাছি আনছিলাম, হঠাৎ ক্লিক শব্দ হলে গলা ঠিকভাবে লেগে গেল। আমরা যখন বাঙ্কোয়েট হলে প্রবেশ করলাম জাতীয় সংগীত বাজতে শুরু করল।
১৯৭৩-এ আমার ডেপুটি সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে বাজেট ভাষণের খসড়া ডিকটেশন দিচ্ছিলাম, তিনি একই সঙ্গে তা বাংলাতে অনুবাদ করছিলেন। সে সময় উন্মত্তের মতো একটি দল আমার অফিসে ঢুকে পড়ল, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ১০০ লোক জমে গেল। তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করল, বেতন বাড়াবার জন্য আমাকে ঘিরে ধরল। আমি আলমগীরকে চলে যেতে বললাম, আমি একাই পরিস্থিতি মোকাবিলা করব। তারা জানালেন যে গত রাতে তারা এই দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, তিনি অর্থ সচিবের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিয়েছেন। মনে পড়ল গতকাল সান্ধ্য হাঁটার পর বাড়ি পৌঁছালে আমাকে বলা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী আমাকে খোঁজ করেছেন। কিন্তু আমি আর ফিরতি ফোন করিনি। এখন বুঝতে পারছি তিনি কেন আমাকে ফোন করেছিলেন।
আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশে তাঁর অফিসে ফোন করলাম। আমাকে বলা হলো তিনি সুইডেনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ব্যস্ত আছেন। আমি তাঁর একান্ত সহকারীকে বললাম, যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে, আগামীকালের বাজেট উপস্থাপন আর হচ্ছে না। দুই মিনিটের মধ্যেই ফোনের অপর প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী, আমি তাকে পরিস্থিতি বর্ণনা করলাম, আগত দলের নেতার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিলাম। তিনি তাই করলেন এবং জনতা সরে গেল।
কোনো কোনো সময় রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অর্থ ছাড়করণে তাঁর লিখিত আদেশ পালনে অসম্মতি জানাতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কখনো তাঁর আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে দ্বিধা করেননি। একটি মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর একটি পরিকল্পনার কথা জানালেন, একটি ভোগ্যপণ্য সংস্থা স্থাপন করবে, যার তত্ত্বাবধানে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ভোক্তারা যুক্তিসঙ্গত দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কেনাকাটা করতে পারবেন। যেহেতু প্রস্তাবটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এসেছে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। আমি নিজের ওপর দায়িত্ব নিয়ে জানালাম প্রকল্পটি মারাত্মক প্রশাসনিক সমস্যার মুখোমুখি হবে। সুতরাং আমরা বরং পাইলট স্কিম হিসেবে এটি গ্রহণ করে কেবল মহকুমা পর্যায়ে তা চালু করতে পারি, সেখানকার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের পরিধি আরো বিস্তৃত করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী তাতেই সম্মতি দিচ্ছিলেন, তখন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমার মতের বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব কোনো ধরনের সংশোধনী ছাড়া গৃহীত হতে হবে। প্রকল্পটি সেভাবে শুরু হলো, আর এর আয়ুষ্কাল ছিল খুবই কম।
অন্যদিকে আমি প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করতে খবরের কাগজ প্রকাশনার জন্য শেখ মনি এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ছাপাখানা আনতে শিল্পঋণ সংস্থা থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তা করেছি প্রয়োজনীয়, ব্যক্তিগত গ্যারান্টি এবং ঋণ শোধের জন্য ছাপাখানা বন্ধকের বিনিময়ে। এমনকি ছোট বিষয় যেমন একবার যখন বাজেট পেশ করার জন্য ১৩ তারিখ নির্ধারিত হলো, আমি আপত্তি করলাম; আমার কুসংস্কারের কারণে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদকে বলে তারিখ পরিবর্তন করলেন।
একদিন প্রধানমন্ত্রী আমাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলেন আমাদের বাজারে চালু ভারতে মুদ্রিত এক টাকার সব নোট এখনই অচল ঘোষণা করতে হবে, কারণ সীমান্ত এলাকাবাসী তাঁর রাজনৈতিক কর্মীরা জানিয়েছেন ভারতের ছাপা এ ধরনের কোটি কোটি জাল টাকা সীমান্তের এপারে পাঠানো হচ্ছে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, অনুগ্রহ করে গুজব রটনাকারীদের জিজ্ঞেস করুন তারা কখনো এক টাকা নোটের কোটি টাকা দেখেছেন কিনা। আরো বললাম, তাদের গুজব আর গপ্পো শোনার দরকার নেই। এক টাকার নোট হঠাৎ এখন বাতিল করে দিলে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক টাকার নোট সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের জন্য আমাদের ১০ দিন সময় দেয়া সমীচীন হবে। প্রধানমন্ত্রী আমার সুপারিশ গ্রহণ করলেন।
শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনের চরিত্রের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মহানুভবতা ও উদার মনোবৃত্তি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশকারী হিসেবে যখন ডা. মালেকের বিচার হচ্ছিল তখন তার পক্ষে ওকালতি করতে একজন কিউসি (কুইনস কাউন্সিল) নিয়োগ করতে ব্যাংক থেকে ২০ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য ডা. মালেকের ভাই আমার সহায়তা চান। সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা ছিল। আমি অনুরোধ অনুযায়ী দ্রুত ২০ হাজার টাকা ছাড় করতে ব্যাংকে নির্দেশ দিই। অন্য এক সময় ডা. মালেকের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য আকতারউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে আমার বাড়িতে এলেন। বললেন, তার স্বামীর হৃদরোগের সমস্যা দেখা দিয়েছে, কেন্দ্রীয় কারাগারে উপযুক্ত চিকিৎসা হচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে যোগসাজশের অভিযোগ ছিল। আমি তখন ওই স্বরাষ্ট্র সচিব বরাবর একটি দাপ্তরিক নোট জারি করি। কপি দিই স্বাস্থ্য সচিবকে, তাকে বলা হয় আকতারউদ্দিনকে হাসপাতালে স্থানান্তর করে মেডিকেল বোর্ড গঠনের মাধ্যমে যেন উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেদিন আদেশ কার্যকরী করে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। আমি অর্থমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করেই এই পদক্ষেপ নিই, কারণ আমার জানা ছিল, এসব পদক্ষেপ তাদের অনুমোদন পাবে।
কলকাতায় গভর্নমেন্ট হাউসে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষ করার পর আমাদের প্রত্যাবর্তনের দিন ব্রেকফাস্ট রুমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি সেক্রেটারির সঙ্গে আমার দেখা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবও সেখানে আসেন। আমি যখন কর্নেলকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বললেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ১৯৪৬ সালে বিহারে তাদের বাড়িতে তিনি গিয়েছেন। এটা বিস্ময়কর কেমন করে তাঁর স্মৃতি এভাবে কাজ করল। মিলিটারি সেক্রেটারি যখন আমাদের ‘খোদা হাফেজ’ বলে বিদায় নিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আমাদের এত দূরে ভারত পর্যন্ত আসতে হয়েছে ইসলামি কায়দায় সম্ভাষণ শোনার জন্য।
আমি অর্থ সচিব পদে দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক দিন পরই একটি দৈনিক সংবাদপত্রে খবর বের হলো মতিউল ইসলাম পাকিস্তানি মালিকানাধীন কোম্পানিতে চাকরি করতেন এবং তিনি একজন দালাল। আমি এক হাতে এই সংবাদপত্র এবং অন্য হাতে পদত্যাগপত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলাম, তিনি তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ডাকলেন। পরদিন সংবাদপত্রের একটি রিপোর্ট দেখলাম, পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তার এবং তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে।
তা সত্ত্বেও গণকর্মচারীর যে আচরণবিধি তার খেলাপ করলে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বকাঝকা করতে কখনো দ্বিধান্বিত ছিলেন না। প্রাইম মিনিস্টার ভিজিলেন্স টিমের একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী আমাকে শাসালেন। তিনি জেনেছেন যে আমি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মতো একটি প্রাইভেট কোম্পানির কাছ থেকে সরকারের অনুমতি না নিয়ে লন্ডনের রিটার্ন টিকেট নিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ আমাকে ও আমার স্ত্রীকে দুটি সৌজন্য রিটার্ন টিকেট দিতে চেয়েছিল। আমি তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি, বরং আমার টিকেটটা একজন অসুস্থ অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে লন্ডনে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার জন্য প্রদান করার কথা বলি। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী আমার স্ত্রীর টিকেট গ্রহণের বিষয়টি অনুমোদন করেন। আমার কাছে প্রস্তুত এই নথিটি আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাই। নথি দেখে তিনি রেগে যান। তার কাছে ভুল রিপোর্ট করা হয়েছে। পরদিন সংবাদপত্রে আরো একটি খবর- প্রধানমন্ত্রীর ভিজিলেন্স টিমের আরো এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর চেম্বারে যাই। তিনি তখন ছোট মাইক্রোফোনে সংসদীয় কার্যবিবরণী শুনছিলেন। এটা ছিল প্রধানমন্ত্রী কোয়েশ্চেন আওয়ার। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর পার্লামেন্ট সদস্যদের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। তারকা চিহ্নিত একটি প্রশ্ন এলো ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল’তে চাকরি হারানোদের চাকরিতে পুনর্বহাল করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। মনোরঞ্জন ধর তার জবাবে বললেন- একটি স্পেশাল কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা এ ধরনের কেইস পরীক্ষা করে পুনর্বহাল করা বা না করার ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রদান করেন। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীকে বললাম যে তাকে পরবর্তী সম্পূরক প্রশ্নটি মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
যেমন আমার মনে হয়েছিল পরবর্তী প্রশ্নটি তাই হলো- মতিউল ইসলামের পুনর্নিয়োগের আগে স্পেশাল কমিটি তার ব্যাপারে সুপারিশ করেছে কী? প্রধানমন্ত্রী রেগে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সংসদ অধিবেশন কক্ষের দিকে রওনা হলেন। কয়েক সেকেন্ড পরই মাইক্রোফোনে তার কণ্ঠ ভেসে এলো। তিনি বললেন, মতিউল ইসলামকে নিয়ে পুনর্নিয়োগের প্রশ্নটির আমি জবাব দেব। ইয়াহিয়া খান তাকে দুর্নীতির মিথ্যে অভিযোগে চাকরিচ্যুত করেন। কারণ সেই সরকারে তিনি ছিলেন আমার লোক। তারপর পিনপতন নীরবতা এবং এ বিষয়ে সংসদীয় কার্যক্রমের সেখানেই সমাপ্তি।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে,
নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়