আশুলিয়ায় ফার্নিচার গুদামে বিস্ফোরণ, দগ্ধ ৩

আগের সংবাদ

বাতাসে আগুনের হলকা!

পরের সংবাদ

কিশোর গ্যাং : সমাজের অবক্ষয় ও করণীয়

প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সমাজে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা আমাদের মধ্যকার সৌহার্দ, সম্প্রীতি, ঐক্য এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রধান উপাদানগুলোকে ক্রমেই গ্রাস করছে। সমাজ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। কার্যত সমাজের অচলায়তন ও অধঃপতনের ক্রমধারা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে। যদি আমরা এখনই এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, বলাই বাহুল্য যে এর খেসারত অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে। বলছি, নব্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সমস্যা ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে। এই সমস্যা এতটাই গুরুতর যে, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন! সরকারপ্রধান সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ‘ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে কিশোর গ্যাং মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন, যা প্রশংসার দাবিদার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপরতা চালাচ্ছে, কিন্তু তারপরও রোধ করা যাচ্ছে না।
ঢাকার একটি এলাকায় পূর্বে কিশোর গ্যাং লক্ষ করা যায়। এখন সেই কিশোর গ্যাং ঢাকায় প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়েছে। সারাদেশে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে কিশোর গ্যাং, যারা মানুষ হত্যাসহ প্রায় সব অপরাধের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। তবে বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে কিশোর অপরাধ ও গ্যাং ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মূলত রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণেই উদীয়মান কিশোররা বেপরোয়া হয়ে পড়ছে।
অতীতে একটা সময়ে সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার ও স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের ভূমিকা ছিল। তারা কিশোরদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে প্রশ্রয় দিতেন না। এখন মুরব্বিদের হারানোর জায়গাটি নিয়েছেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সুবিধাবাদীরা। তারা কিশোরদের ব্যবহার করেন। ‘বড় ভাই’ নামে সমাজে পরিচিত তারা। যারা কিশোর গ্যাংয়ের নামে অপরাধ কার্যক্রম চালায়, চাঁদা তোলা এবং আধিপত্য বজায় রাখার জন্য কিশোরদের ব্যবহার করে। আবার এই অর্থের একটা অংশ কিশোরদের জন্য ব্যয় করা হয়। এই কিশোর অপরাধীরা পরবর্তীতে হয়ে যায় সন্ত্রাসী। তবে এই সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই, আছে বড় ভাইদের ছত্রছায়া। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত কয়েকজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘কিশোর গ্যাং’ প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য কিশোর গ্যাং পরিস্থিতির ভয়াবহতা জানান দিচ্ছে। পুলিশের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, সারাদেশে ১৭৩টি ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৭৮০টি। এবং এসব মামলায় প্রায় ৯০০ জন আসামি আছে। ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৭টি। ২০২২ সালের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের দেড় বছর অতিক্রম করেছে। এই সময়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। গত ১০ এপ্রিল, ২০২৪ চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের কবল থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হন একজন চিকিৎসক। এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরে ৫ থেকে ১৫ জন সদস্যের অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। নগরজুড়ে এদের সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০। ২০২৩-এর জুলাই থেকে চলতি বছরে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ২০০ জনের বেশি গ্রেপ্তার করেছে র?্যাব-পুলিশ। বর্তমানে বিচারাধীন ২ হাজার ২৩২টি মামলার বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং সংক্রান্ত।
পুলিশের অনুসন্ধানের বাইরেও ঢাকায় আরো ১৪টি সক্রিয় কিশোর গ্যাং আছে। ২০২৩ সালে যাদের হাতে শুধু ঢাকাতেই ২৫ জন নিহত হয়েছেন। ২০২২-২৩ দুই বছরে তাদের হাতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে (ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ)। ঢাকার অদূরে সাভারেও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে। চলতি বছর মার্চ মাসে সেখানে ৪টি খুনের ঘটনায় সরাসরি সংশ্লিষ্টতা মিলেছে কিশোর গ্যাংয়ের। অর্থাৎ এদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অপরাধ প্রবণতার সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। নাম কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর সদস্যরা বেশির ভাগই ১৮ বছরের বেশি বয়সি। ২০২৩ সালে রাজধানীতে সংঘটিত ২৫টি খুনের সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এদের বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে রয়েছে- ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে ভাড়া খাটা, উত্ত্যক্ত করা, হামলা মারধর ও খুন। হিরোইজম এবং আধিপত্য ধরে রাখতেও বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘর্ষ, বিবাদ ঘটে হরহামেশাই।
যে কোনো সমস্যা নিরসনে সেটার মূলে যাওয়াটা জরুরি। এই যে গ্রেপ্তার, মামলা ও অভিযান চালিয়েও কিশোর গ্যাং সংখ্যা কমছে না, বরং নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। এমনকি গ্রেপ্তারে সহায়তাকারীর ওপর অভিযুক্তরা কর্তৃক হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ উদঘাটন করাটা এখন জরুরি। আমরা সমস্যাকে গুরুত্ব দিই ভালো কথা, কিন্তু সমস্যার গভীরে গিয়ে তা মূলোৎপাটনের উপায় বাতলে দেয়ার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু কিছু সংবাদ মাধ্যমে কিশোর গ্যাং অভিযুক্তদের ছবি ছাপিয়ে এবং টেলিভিশন চ্যানেলে ঘটনাগুলোর ভিডিও দেখানো হচ্ছে। এটা সমাধান কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলার যথাযথ উপায় নয়। এ ধরনের বিষয়গুলো প্রতিরোধে নিতে হবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যেমন অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে, সেটা বরং গণমাধ্যমে প্রচার করা জরুরি। তাহলে অপরাধীরা বুঝতে পারবে যে, তাদের পরিণতি কী হতে পারে।
যে কোনো সামাজিক সমস্যায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগ। এই সময়ে শিশু-কিশোররা অনলাইনে অনেক কিছু দেখে, যার ভেতর নেতিবাচকতা বেশি এবং তারা সহজেই সংগঠিত হয়। শহরগুলোতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শরীর চর্চা, খেলাধুলার সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চা থাকলে কিশোর-তরুণরা অপরাধ ও মাদক থেকে দূরে থাকে। আমাদের সেই ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। পথশিশু ও অভিভাবকহীনদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় এনে সুশিক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে সুফল মিলবে। কারণ ভালো নাগরিক হতে তাদের শিক্ষা ও ভালো পরিবেশ দরকার। এক্ষেত্রে শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিতে পারে।
আমি নিজে ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে ধূমপান ও মাদকবিরোধী কথা বলেই যাচ্ছি। একটা সময় বিষয়গুলোকে পাত্তা দেয়া হতো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা পাল্টে গেছে। দেশে তামাক উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’ এবং ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ গঠন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন এবং মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। সরকার মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে।
কিছু ছোট বিষয় থাকে; কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধূমপান ও মাদক গলার কাঁটা হয়ে গেছে কিশোর-তরুণদের জন্য। কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি এবং প্রায় সব সামাজিক অপরাধের মূলেই রয়েছে মাদক, যার শুরুটা হয় মূলত ধূমপান থেকে। দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর। অপরদিকে মাদকাসক্তির বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ধূমপান। ধূমপান হচ্ছে মাদকের রাজ্যে প্রবেশের মূল দরজা।
যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণ নেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণরা বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়ায়। বৈশ্বিকভাবেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, তরুণ বয়সেই বেশির ভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে কৌতূহলবশত বা পারিপার্শ্বিক প্ররোচনায় ভয়াবহ মাদক ও ধূমপানের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। এমনিতেই তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। উপরন্তু নাটক, সিনেমায়ও তরুণদের আইডল ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নায়ক, নায়িকাদের দ্বারা ধূমপানে, মাদকে উৎসাহিত করে এমন দৃশ্য অহরহ প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! সুতরাং বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে ভিন্ন দৃষ্টির কথা বলেছেন সেটার একটা দিক হচ্ছে প্রতিরোধ। যারা এই অপসংস্কৃতির সঙ্গে জড়ায়নি তাদের দূরে রাখা এবং জড়িতদের শোধরানোর সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে তার খোঁজ রাখা অভিভাবকদের অত্যাবশ্যকীয় কাজ। সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখা এবং ধর্মীয়, নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা, যা পরিবার থেকে একটি শিশুর ভিত্তি গড়ে দিতে সক্ষম। রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব দেয়া এবং তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ করা জরুরি। নীতি বাস্তবায়নে তাদের সার্বিক সম্পৃক্ততা ও সুফল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আগামীর বাংলাদেশ এগিয়ে নিতে যোগ্য নেতৃত্বের শঙ্কা যেন না থাকে, সে দিকটাতে আশু সুনজর দেয়া অপরিহার্য। কিশোরদের মধ্যে ‘গ্যাং অপসংস্কৃতি’ দূর করতে হবে। এজন্য শিশু-কিশোরদের মেধা ও সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক মনন বিকাশে পরিবার, সমাজ সরকারি সব পদক্ষেপের সঙ্গে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। নতুবা এর পরিণাম থেকে আমরা কেউ মুক্ত থাকতে পারব না। তাই আসুন, আমরা এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করি।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়