খালেদার গুলশান কার্যালয়ে পুলিশের তল্লাশি

আগের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হোক মূলমন্ত্র : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

পরের সংবাদ

রেল সুরক্ষায় জিরো টলারেন্স : র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আরএনবি, আনসার সমন্বয়ে টাক্সফোর্স > বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এন রায় রাজা : দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করতে দেশব্যাপী সহিংসতার অংশ হিসেবে এবার ট্রেনে নাশকতা শুরু করেছে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা। রেলের মতো একটি জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা- ট্রেন লাইন কেটে, ফিসপ্লেট খুলে, আগুন দিয়ে যারা হাজারো যাত্রীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে- তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে সরকারও। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে রেললাইনে নিরাপত্তা জোরদার করাসহ গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাক্সফোর্সও। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বনখড়িয়া এলাকায় ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। নাশকতায় জড়িতদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তারে অভিযানে নেমেছে টাস্কফোর্স।
গাজীপুরের বনখড়িয়া (চিলাই ব্রিজ) এলাকায় গত বুধবার ভোর সাড়ে ৪টা নাগাদ অন্তত ২০ ফুট ট্রেন লাইন গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে রাখে দুষ্কৃতকারীরা। ফলে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ১ জনের মৃত্যুসহ অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হন, যাদের মধ্যে চালকসহ ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ৭টি বগি দুমড়ে মুচড়ে যায়। ক্ষতি হয় প্রায় শত কোটি টাকার। এরপর গত বুধবার রাত ১০টা নাগাদ নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ফিসপ্লেট ক্লিপ খুলে নাশকতার চেষ্টা করছিল দুর্বৃত্তরা, ৭২টি ফিস প্লেট খুলে ফেলে তারা। পরে এলাকাবাসীর প্রতিরোধে পালিয়ে যায় নাশকতাকারীরা। বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় আন্তঃনগর ‘সীমান্ত এক্সপ্রেস’।
রেল সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে- যা দেশের ৪৬টি জেলাকে যুক্ত করেছে। এসব ট্রেন লাইন অধিকাংশই উন্মুুক্ত। এ বিশাল দৈর্ঘ্যরে রেলপথ বসতিহীন, ফাঁকা এলাকা দিয়ে খাল বিল পেরিয়ে সংযুক্ত করেছে এক জেলা থেকে আরেক জেলাকে। কোথাও কোথাও ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার রেলপথ গেছে জনবসতিহীন এলাকা পেরিয়ে। এইদীর্ঘ পথে নজরদারির ব্যবস্থা নেই। ফলে এ বিশাল দৈর্ঘ্যরে ট্রেন লাইন রক্ষা করা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে গত বুধবার থেকে গাজীপুরে আরএনবি, পুলিশ, র‌্যাব, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সদস্যকে রেলপথে টহল দিতে দেখা গেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর রেললাইনে এলাকায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করেছে তিনটি তদন্ত কমিটি। তারা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন, রেলকর্মী, ট্রেনযাত্রী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এদিকে যারা গ্যাসকাটার দিয়ে রেললাইন কেটে ফেলে এ নজিরবিহীন নাশকতার সৃষ্টি করে- তাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম চিরুনি তল্লাশি শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের ডিসি ও এসপি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যেখানে বাস আছে, রেললাইন আছে, যেখানে এরকম (নাশকতা) ঘটনা ঘটবে, সঙ্গে সঙ্গে জনগণ যদি মাঠে নামে এরা হালে পানি পাবে না। এরা ধ্বংস করতে পারে, এরা মানুষের জন্য সৃষ্টি করতে পারে না। এরা মানুষ খুন করতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবনে শান্তি-নিরাপত্তা দিতে পারে না। এরা মানুষের সর্বনাশ করতে পারে, মানুষের জীবনটা উন্নত করতে পারে না। কাজেই তাদের কাছ থেকে সাবধান। আর কোথাও যদি এই ধরনের রেলের স্লিপার তুলে ফেলে, আগুন দেয়, যখনই করতে যাবে সরাসরি তাদের ধরতে হবে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, গাজীপুরে রেললাইন উপড়ানোর মূল পরিকল্পনাকারীদের শিগগিরই চিহ্নিত করে ধরা হবে। ওই জায়গাটি এমন এলাকা; যেখানে জনবসতি নেই। একটা কুয়াশার রাত ছিল। এজন্য দুটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানার (মূল পরিকল্পনাকারী) যারা, সবাইকেই আমরা আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করব। তিনি বলেন, হাজার হাজার কিলোমিটার রেললাইন সারা বাংলাদেশে। নাশকতাকারীরা টার্গেট করেছে যেখানে মানুষ থাকে না। তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে এই ঘটনাটি ঘটাচ্ছে। রেল মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে চিঠি দিয়েছে। তারা নিরাপত্তার জন্য ফোর্স চেয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই আলোচনা করে লোকবল বাড়ানোর ব্যবস্থা করব। তিনি বলেন, রেললাইন উপড়ে ফেলা সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা দেশকে ভালোবাসে তারা এ কাজটি করতে পারে না। মন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালে আপনারা অগ্নিসন্ত্রাস দেখেছেন। তখনো রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল। জানমালের ক্ষতি তো হয়েছে, নিরীহ মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে। সেসব দৃশ্য দেখেছেন। এবারও আমরা সেটি লক্ষ্য করছি। তারা শুধু গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে না, রেললাইনও উপড়ে ফেলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গাড়িতে যত অগ্নিসংযোগ হয়েছে সেসব ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন অগ্নিসংযোগের একটা নতুন মাত্রা তারা শুরু করেছে। রাস্তার টোকাইদের তিন হাজার, দুই হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা করে এরা কন্ট্রাক্টে নিয়ে যায়। যারা নিয়ে যাচ্ছে টোকাইরা তাদের নাম আমাদের বলছে। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ইতোমধ্যে ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেছে। আমরা রেলকে নিরাপত্তা দিতে ব্যাপক ব্যবস্থা নিয়েছি। জাতীয় সম্পদ ধ্বংসকারীদের প্রতিহতে জিরো টলারেন্স নীতি নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছি।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, কোনো একটা সভ্য দেশে কেউ এভাবে ট্রেন লাইন গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে যাত্রীবাহী ট্রেনকে দুর্ঘটনায় ফেলতে পারে- এটা ভাবাই যায় না। যারা এসব করছে তারা মানুষ নয়, জানোয়ার, এদের কোনো দেশপ্রেম নেই। এদের শনাক্ত করে ফায়ারিং স্কোয়াডে দেয়া উচিত। রেলমন্ত্রী বলেন, দুর্ঘটনায় শুধু যে জাতীয় সম্পদ তারা ধ্বংস করছে তা নয়, তারা শত শত ট্রেন যাত্রীর জীবন নিয়ে খেলছে। এটা কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না।
দেশব্যাপী একটি দলের হরতাল অবরোধে কীভাবে ট্রেন নিরাপদে চালাবে রেলওয়ে? এমন প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, এত বিশাল ট্রেন লাইন পাহারা দিয়ে রাখা কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব হয় না। তবে আমরা ট্রেন লাইন পাহারা/ রক্ষার্থে রেলরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে আনসার, র‌্যাব, পুলিশসহ সব বাহিনীকে নিয়োজিত করার পাশাপাশি দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা রেল ও লাইনের নিরাপত্তা বাড়াতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত করতে চিঠি দিয়েছি। তাছাড়া রাতে দিনে রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা নিদ্রাহীনভাবে পাহারায় থাকবে, তাদের সঙ্গে র‌্যাব, পুলিশ, আনসার বিজিবিও থাকছে। ট্রেন চালক, গার্ডকে ধীর গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে, যত সম্ভব সাবধানতা অবলম্বনের নির্দেশনা দিয়েছি। তবে ট্রেনের আগে পাইলট ইঞ্জিন চালানোর মতো সক্ষমতা রেলের নেই, এতে দ্বিগুণ ইঞ্জিন লাগবে, তেলের খরচ হবে দ্বিগুণ। তা ছাড়া লোকোমাস্টার তো এত নেই। সে কারণে এটা করা সম্ভব হবে না। এমনিতেই রেল ভর্তুকিতে চলছে। দেশের সব নাগরিককে একত্রিত হয়ে বিএনপি ও সমমনা অগ্রণতান্ত্রিক দলগুলোর নির্বাচন বানচালের নামে এই নাশকতা রুখে দেয়ার আহ্বান জানান রেলমন্ত্রী। তিনি বলেন, তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সব বাহিনীর সমন্বয়ে রেলের সম্পদ ও লাইন দেখাশোনা করা হচ্ছে। স্থানীয় নাগরিকদের সচেতন হয়ে এ দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান রেলমন্ত্রী। সেই সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যারা নাশকতা সৃষ্টি করছে- যারা ইন্ধন দিচ্ছে তাদের ধরে চরম সাজা দেয়ার দাবি জানান রেলমন্ত্রী। যদিও গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলোর আগে পাইলট ইঞ্জিন চালানো হচ্ছে বলে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে সূত্রে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, ট্রেন একটি দ্রুতগতির বাহন। এটি লাইনের যে কোনো ত্রæটির জন্য দুর্ঘটনাকবলিত হতে পারে। কোনো দেশে ট্রেন লাইনের এই বিস্তৃত এলাকা সংরক্ষিত করা খুবই কঠিন। তবে আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। ট্রেন লাইনের আশপাশে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে লোকবল, তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে নিরাপদ হতো যদি আমরা নতুন যেসব ট্রেন লাইন করব বা করছি, যেমন কক্সবাজার থেকে দোহাজারী করলাম, এটাকে ওপর দিয়ে ভায়াডাক্ট করতে পারতাম। এটাকে আমরা আরো একটু খরচ করে হলেও উপর দিয়ে নিয়ে গেলে এসব দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তেমন থাকতো না। তাছাড়া পাথর নিক্ষেপ বা লাইন উপড়ে ফেলার সম্ভব হতো না। লাইন ও যাত্রীরা নিরাপদ থাকতো। তাছাড়া ব্রিটিশ আমলের সেই ১৪৪ ধারা লাইনের পাশে এখনো নাকি জারি আছে, তার কার্যকারিতা দেখি না। মান্ধাতার আমলেই রয়ে গেছে রেলওয়ে, লাইন সংরক্ষণ, নজরদারি ও কর্মীদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। এছাড়া কর্মীদের উন্নততর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না, সিগন্যালগুলো ম্যানেজ করতে পারছে না রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, এটা আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তিনি বলেন, ৩ হাজার কি.মি. রেললাইন ঠিকমতো দেখভাল করতে অপারগ রেলওয়ে; কর্মী নেই, লোকবল নেই, এসব বিষয় সমাধান করতে হবে। সঙ্গে রেললাইনের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। প্রতিটি ট্রেনের বগিতে বেসিক ফায়ার ফাইটার সেফটি ব্যবস্থা রাখা দরকার। সেই সঙ্গে প্রতিটি দূরপাল্লার ট্রেনের লাইন ঠিক আছে কিনা- তা সময়মতো পরীক্ষারও পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিহত করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ৩ শতাধিক বাস পোড়ানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনটি ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েক কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়। গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইলে ঘা?রিন্দা রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কমিউটার ট্রেনে আগুন দেয় দুষ্কৃতকারীরা। এর ফলে ইঞ্জিনের কাছাকাছি দুটি বগি পুরোপুরি এবং একটি বগি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮ নভেম্বর রাতে জামালপুরের সরিষাবাড়ী রেলস্টেশনে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনের দুটি বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে ট্রেনের দুটি বগি পুড়ে যায়, আরো একটি বগির আংশিক ক্ষতি হয়। গত ২৮ নভেম্বর পাবনার ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন ইয়ার্ডে ঢাকা মেইল ট্রেনের একটি বগিতে আগুন দেয়া হয়। ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন প্ল্যাটফর্মের উত্তর পাশে রেল ইয়ার্ড ওয়াশফিডে এ ঘটনা ঘটে। আগুনে ঢাকা মেইল ৯৯ আপ ট্রেনের ৫৫৫৬ নম্বর কোচের বগির ১১টি সিট পুড়ে যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়