মুজিবুল হক চুন্নু : মানুষ ভোট দিতে পারবে এই আস্থা নেই

আগের সংবাদ

শিক্ষা বাঁচানোর উপায় কী : হরতাল-অবরোধে আটকে আছে প্রায় ২ কোটি পাঠ্যবই, ঢাকায় শুক্র-শনিবার ক্লাস-পরীক্ষা

পরের সংবাদ

সাগর-রুনি ও আমাদের সাংবাদিক সমাজ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সাগর ও রুনি- এই নাম দুটি সবার কাছেই কমবেশি পরিচিত। এই পরিচয় কোনো স্বাভাবিক ঘটনার মধ্য দিয়ে হয়নি, লোমহর্ষক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে হয়েছে এবং যে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন দাখিলের দিন ১০৩ বারের মতো পিছিয়েছে। জানা নেই, তদন্ত প্রক্রিয়ায় এমন রেকর্ড অন্য কোনো হত্যাকাণ্ডের বেলায় এর আগে ঘটেছে কিনা। কিংবা এমন রেকর্ড আছে কিনা। সাগর ও রুনি নিজেদের বাসায় ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভবত সেই সময়ে বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের আটক করে বিচার প্রক্রিয়ায় আনা হবে। কিন্তু তার দৃপ্তকণ্ঠের সেই আশ্বাস এত বছর পরও বাস্তবের মুখ দেখেনি। তেমন কিছুই ঘটেনি, ঘটতে দেখা যায়নি। উপরন্তু এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে, আসামি শনাক্ত করতেই বছরের পর বছর সময় লেগেছে, লেগে যাচ্ছে। প্রথমে থানা ও পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বিষয়ে কাজ শুরু করে। তারপর তদন্তভার ডিবিকে দেয়া হয়। ডিবি থেকে র‌্যাবের ওপর তদন্তের বিষয়টি ন্যস্ত করা হয়। যতদূর মনে পড়ে, হাইকোর্টের নির্দেশে র‌্যাবকে তদন্তভার দেয়া হয়। রহস্য উদঘাটনে আলামত বিদেশেও প্রেরণ করা হয়। কিন্তু কোনো কিছুতে আর রহস্য উদঘাটিত হয় না। রহস্য উদঘাটিত হতে চায় না। তদন্ত প্রক্রিয়ায় এই দীর্ঘসূত্রতা জনমনে অনেক ধরনের সংশয় ও ধারণার জন্ম দিয়েছে, যা ব্যক্তি, গোষ্ঠী নিজেদের মতো করে তা রচনা ও উপস্থান করে আসছে, আজো করছে। ফলে বিচার প্রক্রিয়ার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার বিষয়টি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠছে। আস্থা ও ভরসা কমে যাচ্ছে। এতে বাজারে নানা ধরনের গল্পের প্রচলন ঘটে গেছে। অনেকে মনে করেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার আদৌ হয়তো হবে না।
আমাদের দেশে রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এসব সংস্থা ও সদস্যরা অত্যন্ত চৌকস, দক্ষ ও যোগ্যতা-মেধাসম্পন্ন নিঃসন্দেহে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে তারা প্রশংসনীয় উদ্যোগের স্বাক্ষর রেখেছে, রেখে চলেছে। অপরাধ নির্মূলে, অপরাধীকে বিচার প্রক্রিয়ায় আনতে তাদের দক্ষতা, কৌশলের দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এসব সংস্থার আধুনিকরণ করা হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারও করা হয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মান অনুসরণে, তেমনটাই জানা সবার। আজকাল কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীকে ধরা আর কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে থাকছে না। যা হোক, রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য যেটা অত্যন্ত জরুরি, সেটা করার যেমন যৌক্তিকতা রয়েছে, তেমন রয়েছে অপরাধ নির্মূলে যথাযথ ও যথাসময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলা কিংবা ঘটনাটিকে কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা কখনোই অপরাধীকে শনাক্ত করতে সহায়তা করতে পারে না, অপরাধও নির্মূল করতে পারে না। বরং বিচারকার্য সম্পন্ন করতে না পারার ঘটনাটি অপরাধীদের কাছে পুনরায় অপরাধ করার সহায়ক হয়ে দেখা দেয়, অপরাধের নানা উদ্ভাবনী চিন্তার পথ উন্মোচন করে এবং সে সঙ্গে নতুন অপরাধীর জন্ম দেয়। আর সমাজ অপরাধমুক্ত হয় না। এই বিবেচনায় বলাবাহুল্য, আইন ও বিচার প্রক্রিয়াকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখা অত্যন্ত জরুরি। আইন ও বিচার প্রক্রিয়া নিজ বিধিমতে ও গতিতে সক্রিয় ও সচল থাকলে, রাষ্ট্র ও তার জনগণ নিরাপদ হয়। আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধা বাড়ে, যেখানে সংশয় থাকে না। এ কথা না বললেই নয়, সাগর ও রুনির হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হতে না পারা কিংবা এর দীর্ঘসূত্রতা জনমনে সংশয় ও শঙ্কা দুটোই জাগিয়ে রেখেছে।
সাগর ও রুনি পেশাগতভাবে দুজনই সাংবাদিক ছিলেন। রীতিমতো তারুণ্যে উজ্জ্বল দুই তরুণ সাংবাদিক। একমাত্র শিশু সন্তানের সামনে তাদের হত্যা করা হয়। তাদের হত্যাকাণ্ডের পর সাংবাদিক মহলে ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও অপরাধীদের শাস্তি দাবি দেখা গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ক্রমেই তা ধীরে ধীরে ¤øান হয়ে আসে, যা সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করেছিল বটে। সাধারণত দেখা যায়, কোনো সাংবাদিক লাঞ্ছিত হলেই সাংবাদিক সমাজে সম্মিলিতভাবে তাৎক্ষণিক তার প্রতিবাদ করা হয়, অবস্থান ধর্মঘট, কর্মবিরতি পালনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। প্রচারমাধ্যমের প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বিচার প্রক্রিয়ার ওপর ফলোআপ সংবাদ প্রচার করা। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও সক্রিয় থাকে, যাতে অপরাধের কারণ বা রহস্য উদঘাটন করা সহজ ও সম্ভব হয়। সোজা কথায়, অপরাধীদের ধরা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত সাংবাদিকদের নানা কর্মসূচি চলে। কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্য, সাগর ও রুনি নির্মমভাবে খুন হওয়ার পরও সাংবাদিক সমাজে তেমন কোনো লাগাতার ও শক্ত কর্মসূচি নেয়া হয়নি। দেখা যায়নি কঠিন প্রতিক্রিয়া, বিচার প্রক্রিয়া কার্যকর করার জন্য। কারণ কী? কারণটা সাংবাদিকরাই ভালো বলতে পারবেন এবং পারেন। এটা তো সবার জানা, সাংবাদিক সমাজের প্ল্যাটফর্ম আছে, জাতীয় ও স্থানীয় ক্লাব আছে, নানা সংগঠনও আছে। কিন্তু তাদের কাছে সাগর ও রুনির অবস্থান কতটা গুরুত্বসহকারে রয়েছে, সেটা জানা নেই। এ পর্যন্ত ১০৩ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন পরিবর্তিত হলো। আলামত দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও রহস্য উদঘাটিত হচ্ছে না। একজন সংশয় প্রকাশ করে বলছিলেন, কখন না জানি শুনতে হয়, সাগর ও রুনি একজন আরেকজনকে হত্যা করেছে, হত্যাকারী আর কেউ না এবং এর পেছনে ওদের ব্যক্তিগত বেপরোয়া আচরণই দায়ী। এই দেশে তো কত রকম ঘটনার জন্ম হয় প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। মৃত ব্যক্তির দিকে দোষারোপের আঙুল দেখানোর ঘটনাও তো কম নয়। বিশেষ করে মৃত নারী হলে তাকে নিয়ে গল্প বলার বা বানানোর সুযোগ থাকে, সুযোগ বাড়ে। এই সুযোগ তৈরি হয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতার অভাবে। আর সমাজের নারী ও পুরুষের ভারসাম্যহীন অবস্থান এই জাতীয় নেতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এসব কথা কে না জানে। যাই হোক, সমাজে বিরাজমান যে কোনো ধরনের নেতিবাচক আচরণ, অন্যায়, অনৈতিকতা, অপসংস্কৃতি, অরাজকতা নির্মূলে প্রচারমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অতীতে এমন অজস্র ঘটনা আছে, সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনে মিডিয়া আপসহীন ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে। মিডিয়াকে দিনবদলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। দেশপ্রেম জাগাতে পারে মিডিয়া। ন্যায়সঙ্গত মনোভাব তৈরিতে প্রচারমাধ্যমের মতো শক্তিশালী আর কোনো মাধ্যম নেই। সেই প্রচারমাধ্যম এখন যেন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণে বেশি নিবেদিত, যেখানে তার স্বার্থই উদ্ধারের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। একসময়ে সাংবাদিকতা পেশা ছিল জনকল্যাণ আর দেশপ্রেমের। ধীরে ধীরে সাংবাদিকতার পোশাক বদলেছে, বদলেছে আদর্শের ধরন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আগে পত্রিকার মালিক হতেন সাংবাদিকতা যার পেশা ও নেশা সেসব মানুষ। বড়মাপের আদর্শ নিয়ে তারা চলতেন, জীবনযাপন করতেন। নির্ভীক সাংবাদিকতা ও দেশপ্রেমই ছিল তাদের পেশার মূলমন্ত্র। তারপর পত্রিকার মালিক হতে শুরু করলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা, যাদের প্রচার, প্রসার এবং সর্বোপরি নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেদের মতো করে সংবাদ প্রচারের চাহিদা সৃষ্টি হয়। তারা সেই কাজটি ঘুরেফিরে করেন। এরা সাংবাদিকদের অর্থের বিনিময়ে পকেটজাত করতে দ্বিধা করেন না। ফলে যে সাংবাদিক একসময়ে আপসহীন হিসেবে স্বীকৃতি পান, তাকেই দেখা যায় অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যুতে নীরব ভূমিকায় থাকতে কিংবা পক্ষপাতিত্ব করতে।
যদি জরিপ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, কোটিপতি ও অঢেল বিত্তবানদের তালিকায় অনেক সাংবাদিকই জায়গা করে নিয়েছেন। সমাজে অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু আদর্শচ্যুত হয়ে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যাওয়া কখনোই সমাজের জন্য কল্যাণকর হয় না। বরং সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলে। সমাজ তাদের কাছ থেকে ন্যায়সঙ্গত পরামর্শ বা অভিমত পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এসব সাংবাদিকের সমাজে গ্রহণযোগ্যতাও কমে যায়। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, প্রচলিত রাজনীতি সাংবাদিকদের ভেতর বিভাজন টেনে দিয়েছে এবং সেটা বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে। ফলে এই পেশাও রাজনৈতিকভাবে দ্বিখণ্ডিত, বিভাজিত। কোনো সংবেদনশীল ইস্যুতে এরা আর এক হয় না। এটাই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত হতাশার ও দুর্ভাগ্যের বিষয়।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়