মুজিবুল হক চুন্নু : মানুষ ভোট দিতে পারবে এই আস্থা নেই

আগের সংবাদ

শিক্ষা বাঁচানোর উপায় কী : হরতাল-অবরোধে আটকে আছে প্রায় ২ কোটি পাঠ্যবই, ঢাকায় শুক্র-শনিবার ক্লাস-পরীক্ষা

পরের সংবাদ

পরিবহন খাতের সর্বনাশ : অবরোধ-হরতালে ৩৭০টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সব মিলিয়ে ক্ষতি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেব দুলাল মিত্র : হরতাল অবরোধে গাড়ি পোড়ানো এখন একধরনের নিয়মে পরিণত হয়েছে। যারা এ ধরনের কর্মসূচি দেয় তাদের প্রথম টার্গেটই থাকে যানবাহনে বিশেষ করে বাস-মিনিবাসে আগুন দেয়া। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার দিন এবং এরপর থেকে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দিয়ে আসছে। সেদিনের পর থেকে গত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৩৭০টি বাস-মিনিবাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এতে ৩৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একের পর এক বাস-ট্রাক পোড়ানোর ঘটনায় পরিবহন মালিকরা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একের পর এক গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় জীবন-জীবিকায় ছন্দপতন হওয়ায় হাজার হাজার পরিবহন শ্রমিকও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হরতাল-অবরোধকারীরা যাত্রীবাহী ট্রেনেও আগুন দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্ল্যা বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের সমাবেশ, হরতাল ও অবরোধে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আমরা সরকার ও দেশের মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে হরতাল অবরোধেও বাস চলাচল অব্যাহত রেখেছি। জনবিরোধী এ অবরোধে মালিক-শ্রমিকরা কখনো সাড়া দেবে না; ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছে। কিন্তু দিন দিন ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। আমরা ভীতির মধ্যে আছি। অবরোধের দিনগুলোতে গাড়ি চলাচল যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় তার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ জানানোর পর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমরাও বাসে নিজেদের লোক দিয়ে নজরদারি শুরু করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে পরিবহন সেক্টরে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। আমরা সব কাগজপত্র সরকারের কাছে দেব।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, হরতাল অবরোধে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ এ দেশের একটি রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে রেল ও সড়ক পরিবহনে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবেই দিতে হবে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সরকারকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে আরো অনেক দিকে এর প্রভাব পড়ে। পরিবহন মালিকদের ব্যাংক লোন থাকে। বাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে আয় বন্ধ হয়ে যায়, তারা লোন পরিশোধ করতে পারে না। পরবর্তীতে এই ক্ষতি পোষাতে ট্রিপের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। বেশি টাকা উপার্জনের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এর ফলে দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে। প্রান্তিক পরিবহন শ্রমিকরা মাসিক বেতন পায় না। বাস বন্ধ হয়ে গেলে তাদের রুটি-রুজিতে বড় ধরনের টান পড়ে। এতে মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এভাবে নানান ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর প্রতিরোধে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি বাস বা যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধের জন্য এক্সটিংগুইশার রাখতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগে এটা ব্যবহার করতে পারলে বাসের ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৩৭০টি বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসবের মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঢাকায় ৮৫টি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে পরিবহন মালিকদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৭ কোটি টাকা। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় ৩৪টি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এগুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১০ কোটি ২০ লাখ টাকা। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ১৬টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে। এগুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার। ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের মধ্যে ১৩৫টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। শুধু অগ্নিসংযোগে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে

২৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এছাড়া ভাঙচুরে ক্ষতি হয়েছে ২৩৫টি গাড়ির। এগুলোর আর্থিক ক্ষতি ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
মালিক সমিতি সূত্র আরো জানায়, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের বাইরেও পরিবহন সেক্টরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি। যানবাহন বন্ধ থাকলেও পরিবহন মালিকদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ দিনে রাজধানী ঢাকায় হরতাল অবরোধ উপেক্ষা করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে ঢাকায় ৮০ শতাংশ গণপরিবহন চলাচল করেছে। তবে ২০ শতাংশ গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। এই ২০ শতাংশ গণপরিবহন চলাচল না করায় ২৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটে চলাচলরত বাসের মধ্যে ৬০ শতাংশ বন্ধ ছিলো। এর ফলে ক্ষতি হয়েছে ৬ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। সারাদেশে ৬০ শতাংশ ট্রাক চলাচল করতে না পারায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৮০৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে পরিবহন সেক্টরের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৮৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
পরিবহন মালিক ও সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কর্মকর্তা হাজী আবুল কালাম বলেন, একটি বাসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ফলে একজন মালিক পথে বসে যায়। আয়ের পথ বন্ধ হলে শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়ে। সব মালিকদেরই ব্যাংকের লোন আছে। বাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাংকের লোন পরিশোধ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সবদিক থেকেই একজন মালিককে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনতে হয়। ক্ষতিগ্রস্ত একটি বাস মেরামতসহ সব কাজ শেষে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ২০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি টাকা লাগে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ বাবদ এই টাকা পাওয়া যায় না। মালিককেই সব দায় বহন করতে হয়।
একাধিক মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কয়েকদিন আগে হরতাল সমর্থকরা গাজীপুরে বাসার পাশে পার্কিংয়ে রাখা একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। মালিক বাসের সামনে এসে বাসে আগুন জ¦লতে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তিনি ব্যাংক থেকে ২৯ লাখ টাকা লোন নিয়ে বাসটি রাস্তায় নামিয়েছিলেন। এখন তিনি একেবারেই পথে বসে গেছেন। এ ধরনের অনেক মালিক আছে। একটি বাসের একাধিক মালিকও রয়েছেন। তাদের বাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা আরো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় চলাচলরত বাস-মিনিবাসের মালিকের সংখ্যা ৩ হাজারের মতো। এসব মালিকরা সবাই চলমান অবরোধ ও হরতালের ঘটনায় আতঙ্কগ্রস্ত পড়ে পড়েছেন। তারপরও নিরূপায় হয়েই রাস্তায় বাস নামাতে হচ্ছে। বাস না নামালে যেমন মালিকরা পথে বসবে, তেমনি বিভিন্ন যানবাহনের হাজার হাজার পরিবহন শ্রমিক অনাহারে দিন কাটাবে। এসব বিবেচনা করেই তারা রাস্তায় বাস নামাচ্ছেন। ফলে নগর পরিবহনের শ্রমিকরা কিছুটা ভালো থাকলেও দূরপাল্লার পরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের অবস্থা আরো খারাপ। ৬০ শতাংশ দূরপাল্লার বাস চলাচল একেবারেই বন্ধ। রাজধানীর টার্মিনালগুলো ফাঁকা। বাস চালানোর প্রস্তুতি নিলেও যাত্রী না পাওয়ায় বাস চলাচল করতে পারছে না। শুধু হরতাল বা অবরোধের দিনই নয়, আগের দিন থেকে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। গত শনিবার সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পোড়ানো শুরু হয়। গুলিস্তান ও আগারগাঁওতে দুটি বাসে আগুন দেয় হরতাল সমর্থকরা। ব্যস্ততম দুই সড়ক মুহূর্তে খালি হয়ে যায়। সব মিলিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেনসহ ১১টি যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ শনিবার সন্ধ্যা থেকে ১৫ ঘণ্টায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা ১১টি যানবাহনে আগুন দেয়।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি, পিকআপ দুষ্কৃতকারীদের মূল টার্গেটে পরিণত রয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়