বিরোধীদের এক করতে তৎপর বিএনপি

আগের সংবাদ

পরিবহন খাতের সর্বনাশ : অবরোধ-হরতালে ৩৭০টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সব মিলিয়ে ক্ষতি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

পরের সংবাদ

পরীক্ষা নেই, বছরজুড়ে ম্যূল্যায়ন : নতুন কারিকুলাম বিতর্কের ফাঁদে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : নতুন ‘কারিকুলাম’ বিতর্কে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। বিশেষ করে পরীক্ষা পদ্ধতি উঠিয়ে দেয়ায় পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হচ্ছে। পাশাপাশি নবম শ্রেণি থেকে বিভাগ পদ্ধতি তুলে দেয়ায় বিজ্ঞান শিক্ষাও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছে। কারিকুলামের বিরুদ্ধে আন্দোলন চললেও শিক্ষা প্রশাসন এদেরকে কোচিং ব্যবসায়ী এবং নোট-গাইড বই সিন্ডিকেটের কারবার বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। প্রসঙ্গত, গত বছর প্রথম-দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তমে নতুন কারিকুলাম চালু হয়। আগামী জানুয়ারি থেকে তৃতীয়-চতুর্থ এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু হচ্ছে। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে হবে বছরজুড়ে মূল্যায়ন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন ‘কারিকুলাম’ নিয়েই আলোচনা। গত ১৪ বছর সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়াশোনার পর এখন অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় সবই থাকছে হাতে-কলমে শিক্ষা। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার নাম করে পাঠ্যবই রচিত হলেও তা থেকে শিক্ষার্থীরা কী পড়বে, শিক্ষকরা কী পড়াবেন এবং অভিভাবকরা কী করবেন- এর কোনো কিছুই অংশীজনরা বুঝতে পারছেন না। তাদের মতে, নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু পড়াশোনা নয়, মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে বিশৃঙ্খলা। সদ্যবিলুপ্ত সৃজনশীল শিক্ষায় ‘এ প্লাস’ পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা লড়াই করত। নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় এ প্লাসের পরিবর্তে ‘ত্রিভুজ’ পাওয়ার জন্য লড়াইয়ে নামছে। মূল্যায়ন ব্যবস্থারও পরিবর্তন চেয়েছেন তারা। অভিজ্ঞতাভিত্তিক এই শিক্ষা ব্যবস্থায় আগামী ১০ বছর পরে কোন ধরনের মানবসম্পদ বের হবে তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল ইসলাম মামুন বলেন, পুরনো শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার পেছনে কতটা অশুভ উদ্দেশ্য কাজ করেছে তা অনেকেই জানে না। সরকার যদি সত্যি সত্যি শিক্ষার মানের উন্নতি চাইত তাহলে তারা শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানিত ও আকর্ষণীয় করত, শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ না কমিয়ে বরং বাড়াত, বিনামূল্যে যে বইগুলো দেয়া হয় সেসব বইয়ের কাগজের মান, ছাপার মান, ছবির মান, বিষয়বস্তুর মান এত নি¤œমানের হতো না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি

সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম শুক্রবার এক সভায় বলেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বারবার শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনের কারণে অভিভাবক সমাজ চিন্তিত। নতুন কারিকুলামে শুধু ধর্ম শিক্ষা নয় বরং বিজ্ঞান শিক্ষাও সংকুচিত করা হয়েছে। ডিভাইস নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ায় শিশু এবং কিশোর শিক্ষার্থীরা ব্যাপকহারে অনৈতিকতার দিকে ধাবিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের জন্য প্রথমে ‘শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরাম’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। কিছুদিন পরে এতে অভিভাবক নয় এমন লোকজন জড়িত হলে সংগঠনটি ভেঙে গিয়ে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হয়। ‘শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরাম’-এর আহ্বায়ক ও ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অভিভাবক তাহেরা আক্তার রূপা গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের সংগঠনে কিছু অসাধু লোক ঢুকে যাওয়ায় আমরা আমাদের কার্যক্রম নির্বাচন পর্যন্ত স্থগিত রেখেছি। কেন আপনারা নতুন কারিকুলাম চাইছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। বাধ্য হয়ে সন্তানকে কোচিংয়ে পাঠাতে হচ্ছে। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর নিতে হচ্ছে গুগল থেকে। এর ফলে পড়াশোনা ডিভাইস নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দিয়ে আরো সর্বনাশ করেছে। অন্তত পরীক্ষা ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিক- এই আমাদের দাবি।
সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন কারিকুলামের বিরুদ্ধে আগামী ২৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যে সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে তা স্থগিত করে শুধু মানববন্ধন করা হবে। আপনারা নতুন কারিকুলামের কোন অংশের বিরোধিতা করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কারিকুলামের প্রধান শিক্ষাতাত্ত্বিক তিনটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিক স্তরে যেভাবে বই তৈরি হচ্ছে, শিখন শেখানো হচ্ছে, মাধ্যমিক স্তর সেভাবে নয়। ফলে এটা দুই স্তরের মিল নয়, চরম গোঁজামিল হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কারিকুলাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আগের কারিকুলাম থেকে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পরিবর্তন করার কথা বলা হয় এবং তা করার ক্ষেত্রে পূর্বশর্তগুলো রাখতে হয়। কিন্তু এই কারিকুলামের কোনো পূর্বশর্ত হাজির না করে আগেরটির খোলনলচে পালটে দেয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, এই কারিকুলামে পাঠ শেখার ও বই লেখার চেষ্টা করা হয়েছে এভাবে- শিক্ষার্থীদের প্রথমে অভিজ্ঞতা নিতে হবে, এরপর নিজে বা দলে করতে হবে, তারপর সেটার তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা শিখতে হবে এবং মূল্যায়নও সেভাবে সাজানো হয়েছে। এটা শিক্ষার সাধারণ ধারার পথ-পদ্ধতি নয়, এটা মূলত কারিগরি বা বিশেষায়িত কোনো ধারার পথ-পদ্ধতি। সাধারণ ধারার পথ-পদ্ধতি কেমন হবে তা এদেশের ব্রিটিশ শিক্ষাধারায় চলা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস সিক্স-সেভেনের একটা গণিত-বিজ্ঞান বই হাতে নিলেই বোঝা যায়।
কারিকুলাম অনুযায়ী প্রণিত পাঠ্যবইয়ের সমস্যা কোথায়- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল ইসলাম মামুন বলেন, নবম শ্রেণিতে উঠে শিক্ষার্থীরা মাত্র ৫৮ পৃষ্টার ৩ চ্যাপ্টার পদার্থবিজ্ঞান পড়বে। প্রথম চ্যাপ্টারে নিউটনের সূত্র, দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে তাপমাত্রা ও তাপ আর তৃতীয় চ্যাপ্টারে পড়বে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান যেখানে তরঙ্গ-পার্টিকেল ডুয়ালিটি, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার প্রিন্সিপল ইত্যাদি। ওই বইয়ের বাকি চ্যাপ্টারে আছে রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। একইদেশের ইংরেজি মাধ্যমের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ২১৬ পাতার ৮ চ্যাপ্টারের পদার্থবিজ্ঞানের বই পড়ে যেখানে থাকে ইউনিটস এবং মেজারমেন্ট, ইলেকট্রিসিটি, ফোর্সেস অ্যান্ড মোশন, রশ্মি এবং তরঙ্গ, আর্থ অ্যান্ড স্পেস, এনার্জি, ম্যাগনেটস অ্যান্ড কারেন্ট, এটমস অ্যান্ড নিউক্লিআই প্রভৃতি পড়বে। অর্থাৎ ইংরেজি মাধ্যমের সপ্তম শিক্ষার্থীরা যা পড়বে বা জানবে নতুন কারিকুলামে আমাদের বাংলা মাধ্যমের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও তা পড়বে বা জানবে না। আর নবম-দশম শ্রেণি বা ‘ও লেভেল’-এ আছে ২৭১ পাতার পূর্ণাঙ্গ পদার্থবিজ্ঞান বই, যেখানে আছে ৮টি ইউনিটে ফোর্স অ্যান্ড মোশন, ইলেকট্রিসিটি, ওয়েভস, এনার্জি রিসোর্সেস, সলিড্স, লিকুইডস অ্যান্ড গ্যাসেস, মাগনেটিজম অ্যান্ড ইলেক্ট্রোমেগনেটিজম, রেডিওএক্টিভিটি অ্যান্ড পার্টিকেল এবং এস্ট্রোফিজিক্স।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীবের মতে, এই বইয়ে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, পৃথিবী ও মহাবিশ্ব এবং পরিবেশ ও ভূমিরূপ অংশগুলো আছে। সব মিলিয়ে দুইশ পৃষ্ঠার মতো। পদার্থবিজ্ঞানের জন্য বরাদ্দ প্রায় ৫০ পৃষ্ঠায় রয়েছে তিনটি অধ্যায়- নিউটনের সূত্র, তাপমাত্রা ও তাপ এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান। এই বিন্যাস বেশ ইন্টারেস্টিং। নিউটনের সূত্র এবং তাপ থেকে লাফ দিয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে চলে যাওয়া। এই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অধ্যায়ে ১০ পৃষ্ঠার ভেতর রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্ট্যান্ডার্ড মডেল- সব কিছুই আছে।
এদিকে, নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন নামের সংগঠনটি গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে আগামী ২৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশের ঘোষণা দিলেও একদিন পরেই তা পরিবর্তন করে শুধু মানববন্ধনের ঘোষণা দেয়। তাদের দাবি, নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ত্রিভুজ চিহ্ন বাতিল করে আগের মতো নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নতুন এই কারিকুলামটি এ দেশের জন্য অনুপযুক্ত। নতুন এই কারিকুলাম সংস্কার করে অন্তত ৫০-৬০ নম্বরে দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন করা হোক। প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল, স্কুল পিরিয়ডে সব প্রজেক্ট সম্পন্ন করা এবং সব ব্যবহারিক ব্যয় স্কুলকে বহন করতে হবে। একই সঙ্গে নতুন কারিকুলাম বাতিল, নম্বরভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা চালু, নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন রাখাসহ ৮ দফা দাবি জানিয়েছে এই ফোরাম।
এদিকে অভিভাবকদের এ ধরনের কর্মসূচিকে বরাবরের মতোই কুচক্রী মহলের উসকানি বলে সতর্ক করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর নোট বই এবং কোচিং ব্যবসায় ধস নামবে। ব্যবসায় ধসের এই আশঙ্কায় তারা অভিভাবকদের মাঠে নামানোর অপচেষ্টা করছে। তবে শিক্ষকদের এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না বলেও মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়