বিরোধীদের এক করতে তৎপর বিএনপি

আগের সংবাদ

পরিবহন খাতের সর্বনাশ : অবরোধ-হরতালে ৩৭০টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সব মিলিয়ে ক্ষতি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

পরের সংবাদ

জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী? নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল খারিজ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি ও এস এম মিজান : এক দশক ধরেই প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী। শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। এরপর থেকে রাজনীতিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি জামায়াতকে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৮ অক্টোবর আরামবাগে সমাবেশ করে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো এই রাজনৈতিক দলটি। এর আগে গত ১০ জুন সমাবেশ করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। রাজনীতিতে পুনর্বাসনের আশায় সমাবেশ করেছিল বলে মনে করেন অভিজ্ঞমহল। সেই সঙ্গে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করারও একটি বিশেষ কৌশল ছিল যুদ্ধাপরাধী দলটির। তবে তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি পড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকরা। জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ- গতকাল রবিবার হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল খারিজ হওয়ায় এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের আর রাজনৈতিক অধিকার রইল না। আদালতের রায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্তির পথে আরো এক ধাপ এগিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে একাধিকবার উঠে আসা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার দাবি করেছেন তারা।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে ১০ বছর আগে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ। ফলে, নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল থাকল। এর পরিপ্রেক্ষিতে দলটির আর কোনো অস্তিত্ব থাকল না। তাই জামায়াত এখন থেকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। কোনো মিছিল মিটিং করতে পারবে না। তিনি বলেন, যদি জামায়াত কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে- তাহলে আমরা আদালত অবমাননার আবেদন নিয়ে আপিল বিভাগে যাব।
‘ডিসমিসড ফর ডিফল্ট’ : রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আপিলকারী পক্ষের কোনো আইনজীবী না থাকায় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ গতকাল রবিবার এ আদেশ (ডিসমিসড ফর ডিফল্ট) দেন। পাশাপাশি জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা ও দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের পৃথক আবেদন শুনানির জন্য হাইকোর্টে যাওয়ার পরামর্শ দেন আদালত। আদালতে জামায়াতের বিরুদ্ধে করা আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী তানিয়া আমীর ও আহসানুল করিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। এর আগে, গত ১২ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীকে

দেয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ১৯ নভেম্বর (গতকাল) শুনানির জন্য তারিখ ধার্য করেছিলেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে জামায়াতকে বিরত রাখতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে রিট আবেদনকারীদের করা আবেদন শুনানির জন্য একই দিন ধার্য করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিষয়টি আপিল শুনানির জন্য ওঠে। গতকাল শুনানির শুরুতে আদালতে জামায়াতের করা আপিলের পক্ষে নিয়োজিত সিনিয়র আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধার তথ্য জানিয়ে ছয় সপ্তাহ সময়ের আবেদন জানিয়ে আইনজীবী মো. জিয়াউর রহমান বলেন, শুনানি মুলতবির আবেদন দেয়া হয়েছে। তখন আইনজীবী মো. জিয়াউর রহমানের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আবেদন (সময় আবেদন) রিফিউজ (প্রত্যাখ্যান) করছি। আপনি প্লেস (আপিল) করেন। একপর্যায়ে আদালত বলেন, আপিলকারীর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড কোথায়? তখন মো. জিয়াউর রহমান বলেন, অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন। তিনিও উপস্থিত নেই। পরে আদালত বলেন, ডিসমিসড ফর ডিফল্ট।
আদালতের রায়ের পর রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেন, তারা (জামায়াত) বারবার সময় চেয়ে কালক্ষেপণ করছেন। সেজন্য আপিল বিভাগ তাদের আবেদন ডিসমিসড ফর ডিফল্ট করেছেন। ফলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল থাকল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপিল তারা করেছে। কিন্তু তারা শুনানি করতে ইচ্ছুক নয়। তারা গত ১২ বছর ধরে দেরি করার চর্চা করছে। আদৌ যদি তাদের কোনো গ্রাউন্ড থাকত, তাহলে তারা শুনানি করত। তারা নিজেরাই জানে তাদের কোনো ম্যারিট নেই। এ কারণে তারা বারবার সময় চেয়ে কালক্ষেপণ করে আসছে।
জামায়াত যা বলছে : জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরের বক্তব্যের বিরোধীতা করে জামায়াতের দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিল খারিজ হলেও সংবিধান অনুযায়ী দলটি স্বাভাবিক রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আদালতে নিবন্ধনের বৈধতা নিয়ে মামলা ছিল। আদালত নিবন্ধন নিয়ে মতামত দিয়েছেন। তবে স্বাভাবিকভাবে জামায়াতের রাজনীতি বহাল থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতি করার সুযোগ জামায়াতে ইসলামী পাবে, অব্যাহত আছে।
জামায়াতের আইনজীবী জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের সিনিয়র আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধা রয়েছে। আর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীনও অনুপস্থিত। এজন্য ছয় সপ্তাহ সময় চেয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের আইনজীবীরা উপস্থিত নেই, সেহেতু আদালত এটা ডিসমিস ফর ডিফল্ট করেছেন। অর্থাৎ আইনজীবী উপস্থিত না থাকার কারণে খারিজ করেছেন। এ অবস্থায় পরবর্তীতে আপিল শুনানির আইনি কোনো সুযোগ আছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রেস্টোর (ফিরিয়ে আনা) আবেদনের সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে এটা আদালতের এখতিয়ার। আপিল খারিজের পর এখন পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া কী হবে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, এখন জামায়াতের পরবর্তী নির্দেশনার আলোকে আইনি কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
রাজনীতি হারিয়েছে, এখন প্রয়োজন বিচার : একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াত রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে মন্তব্য করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যাসহ সব ধরনের অপরাধ করেছিল। বিচারে অনেক শীর্ষ নেতা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, রায় কার্যকর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার বিষয়ে অনেক আগেই জামায়াতের জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। এটা না করে অনেক আগেই তারা এ রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। আর কোনোদিনই এই দলটি এ দেশে রাজনীতি করতে পারবে না। তবে এই দলের কোনো নেতা কী নামে রাজনীতি করবে তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু জামায়াতের আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধের এই গবেষক। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর ছেলেও বলেছেন, জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। এখন ট্রাইব্যুনালের উচিত হবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এ দেশের জনগণ রগকাটা জামায়াত-শিবিবের রাজনীতি চায় না। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চায়। রাজনীতি হারিয়েছে। এখন প্রয়োজন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। ইতিহাসবিদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্ট্রি অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ দেশের নানা স্তরের, নানা পেশার মানুষ জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে লড়াই করেছে। অগণিত মানুষ দিনের পর দিন দাবি জানিয়েছে। আজ উচ্চ আদালতের রায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ সমুন্নত হয়েছে। মানুষ যুদ্ধাপরাধী দলের বিচার চায়। শিক্ষাবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। সন্ত্রাসী সংগঠন। ট্রাইব্যুনাল বারবার পর্যবেক্ষণে বলেছে। তারা রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছে আদালত স্পষ্ট করেছেন। এখন অন্য নামে তারা আসতে চাইলে সেটি সময় এবং পরিস্থিতি তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে জামায়াত নামক ঘৃণ্য দল আর নেই- এটিই স্বস্তি। এখন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এদের বিচার করা প্রয়োজন। ট্রাইব্যুনাল নিশ্চয়ই জনগণের আকাক্সক্ষার মূল্যায়ন করবে।
প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর দলটির পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল করা হয়। হাইকোর্টের রায়ের আলোকে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
পরবর্তীতে এক দশক পর রাজধানীতে প্রকাশ্যে সমাবেশের অনুমতি পায় জামায়াত। সেই সমাবেশে জামায়াত নেতারা হাইকোর্টের রায়ে বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে বক্তব্য দেন। গত ১০ জুন দেশের পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। পরবর্তীতে এসব প্রতিবেদন যুক্ত করে মিছিল, সভা, সমাবেশসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে জামায়াতকে বিরত রাখতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে এবং জামায়াতের আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ অন্যরা আপিল বিভাগে পৃথক আবেদন করেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়