তফসিল বাতিলের দাবি স্বতন্ত্র প্রার্থী ঐক্য পরিষদের

আগের সংবাদ

জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী? নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল খারিজ

পরের সংবাদ

বেকারত্ব হ্রাসে উদ্যোক্তা উন্নয়নের অপরিহার্যতা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের সর্বোচ্চ জনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। সরকারি তথ্যমতে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১৬৯ জন মানুষ বাস করে। জনঘনত্বের হার যেখানে ১৯৭১ সালে ছিল ৪৬৩ জন। যদিও বেসরকারি হিসাবে জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৩/১৪শ জন বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের পর মাইক্রোনেশিয়ায় জনঘনত্ব ৭৭৮ ও ভারতে ৪৩৫ জন। পক্ষান্তরে আমেরিকায় জনঘনত্ব ৩৭, অস্ট্রেলিয়ায় ৩, কানাডায় ৪ ও চায়নায় ১৫২ জন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি গড়ে ১ দশমিক ১ শতাংশ হয়, সে হিসাবে দেশে জনঘনত্বের হার ২০৩০ সালে ১২৫৬ ও ২০৪০ সালে ১৪৪১ জন দাঁড়াবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেশে জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। যাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ বয়সে তরুণ, যেটির সংখ্যা ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার ৯৫ জন। অন্যদিকে ১৫-৫৯ বছরের জনসংখ্যার হার প্রায় ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১০ কোটি ৫০ লাখ। যাদের ইউএনডিপির ধারণায় কর্মক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারি নিয়মানুযায়ী ৫৯ বছর সরকারি কর্মচারীরা অবসরে যায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে দেশের অধিকাংশ মানুষ ৭০-৮০ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে। এই বয়সি জনগণের কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতার যথার্থ ব্যবহার করা উচিত। তাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং জাতীয় অর্থনীতি অধিকতর সমৃদ্ধ হবে।
জনমিতি বিভাজন অনুযায়ী যে কোনো জাতি বা দেশে গোল্ডেন ইয়ার বা সোনালি যুগ একবার আসে। জনসংখ্যার বয়স বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য গোল্ডেন ইয়ার হবে ২০৩০ এবং তা ২০৩৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বর্তমানে দেশে পরনির্ভরশীল জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩৮ ভাগ। যা ক্রমে হ্রাস পেয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ ভাগে দাঁড়াতে পারে। সে সময়ে পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার থাকবে বেশি। গত শতকের ষাট ও নব্বইয়ের দশকে হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান জনমিতি বিভাজনের সুবিধা পেয়েছে এবং এসব দেশ সেই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে বিস্ময়কর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করতে পেরেছে।
অনেক দেশ জনমিতি বিভাজনের সময়কালের দীর্ঘ সময় পেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি দীর্ঘ নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ এ সুযোগ পাবে মাত্র এক দশক। এই এক দশক কর্মক্ষম মানুষকে আমরা কীভাবে জাতীয় উন্নয়ন পরিক্রমায় ব্যবহার করতে পারব- সেটির ওপর আগামীর বাংলাদেশের বাস্তবতা নির্ভর করবে। অর্থাৎ আগামী এক দশক হবে বাংলাদেশের রূপান্তরের দশক। কাজেই আগামী এক দশক জনমিতির বিভাজনের সুবিধা গ্রহণ করে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্যচিত্রে লক্ষ করা যাচ্ছে- দেশের সার্বিক বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৩৫ ভাগ অর্থাৎ ২৫ লাখ ৮২ হাজার কর্মক্ষম মানুষ বেকার। যেখানে উচ্চ শিক্ষিত ১২ শতাংশ বা ৮ লাখ, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ৪.৯৪, মাধ্যমিক স্তরে ২ দশমিক ৮২, প্রাথমিক স্তরে ১ দশমিক ৬৯ এবং শিক্ষিত নন ১ দশমিক ৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিক্ষিত বেকারত্বের হারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গাণিতিক হারে প্রতি বছর ২২-২৩ লাখ কর্মক্ষম মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশের উপর্যুক্ত অর্জন করছে, সেই হারে আমরা তাদের কর্মসংস্থান দিতে পারছি না। প্রচলিত কর্মব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ৭-৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হলেও অবশিষ্ট কর্মক্ষম মানুষ সম্পূর্ণ বা অর্ধ বেকার থেকে যাচ্ছে।
৮ম পঞ্চবার্ষিকীতে সরকারের মূল লক্ষ্য তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে রাষ্ট্র এই বিশাল কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে? এই ব্যাপক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন। তা হলে আমাদের জানতে হবে- উন্নয়নটা কী? অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের মতে, স্বাধীনতাই উন্নয়ন। অর্থাৎ উন্নয়ন অর্থবহ হয় স্বাধীনতায়। উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে- উন্নয়ন মানুষের ওপর কীরূপ প্রভাব বিস্তার করছে, তার ওপর নির্ভর করে এর বিচার করা প্রয়োজন। উন্নয়ন শুধু মানুষের উপার্জনের পরিবর্তন নয়; তার অভিরুচি, সামর্থ্য ও তার স্বাধীনতার মানের পরিবর্তন।
অধ্যাপক সেনের ধারণার প্রেক্ষিতে এটি স্পষ্ট যে, একটি রাষ্ট্র বা সমাজের উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নকে নির্দেশ করে না, এটি উন্নয়নের একটি বাহ্যিক ধারণা মাত্র। প্রকৃত উন্নয়ন হলো- একটি রাষ্ট্র বা সমাজের জনগোষ্ঠী তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-জ্ঞানে কতটা সৃজনশীল ধারণা পোষণ করেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্ঞান বিজ্ঞানকে ধারণ করে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কতটা উদ্বুদ্ধ- সেটার মাপকাঠির নির্দেশ দেয়। এরিস্টটল বলেছিলেন, প্রতিটি বস্তু বা বিষয়ের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে। যেখানে শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্য থাকে মানুষের সুপ্ত উদ্ভাবনী শক্তিকে জাগৃত করা এবং সেই শক্তি মানুষ, দেশ, জাতি ও সভ্যতার কল্যাণে নিবেদিত হওয়া। কেননা সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির উন্নতি মানুষের মানবিকতা উন্নয়নের সমানুপাতিক হওয়ায় লব্ধ জ্ঞানের আঙ্গিকে কল্যাণমুখী নতুন নতুন ধারণার বিকাশ এবং সেটি প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। যেটি অবশ্যই জবাবদিহিমূলক টেকসই উন্নয়ন ধারণাকে সর্বদা ধাবিত করে এবং উন্নয়ন অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি অর্জনে অন্যতম মূল ভূমিকা পালন করে। উন্নয়ন পরিক্রমায় মানুষের সৃজনশীল উদ্ভাবনী ধারণার বিকাশ ও চর্চার জন্য উদ্যোক্তার গুরুত্ব রয়েছে।
ব্যবসা ও উদ্যোক্তা অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহার করা হয়, যদিও উভয়ই অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও মূল্য সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। তবুও দুটি ধারণার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ব্যবসায় লাভের বিনিময়ে পণ্য বা পরিষেবা প্রদানের জন্য একক ব্যক্তি বা সংস্থার উদ্যোগ ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা জড়িত। অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঝুঁকি নেয়ার ইচ্ছা, উদ্ভাবনের ওপর ফোকাস ও নতুন উপায়ে মূল্য তৈরি করার একটি নির্দিষ্ট মানসিকতা থাকে। উদ্যোক্তা গতানুগতিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের বাইরে গিয়ে উদ্ভাবনের মাধ্যমে কাজ করে। উদ্যোক্তারা সাধারণত একটি ব্যবসার প্রাথমিক পর্যায়ে জড়িত থাকে, অনিশ্চয়তা মাথায় রেখে তাদের উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধির জন্য ঝুঁকি নেয়। একজন উদ্যোক্তা হলেন এমন একজন, যিনি বাজারের ব্যবধান চিহ্নিত করেন এবং তা যাচাই করে বাজারে নতুন ও অভিনব ধারণাগুলো প্রবর্তন করেন।
উদ্ভাবন হলো সমস্যা সমাধান, চাহিদা মেটাতে বা বিদ্যমান সমাধানগুলোর উন্নতির জন্য নতুন ধারণা, পণ্য, পরিষেবা বা পদ্ধতি তৈরি করার প্রক্রিয়া। এতে সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার প্রয়োগ ও অভিনব পদ্ধতির বিকাশ জড়িত। অন্যদিকে উদ্যোক্তা হলো মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে একটি ব্যবসা বা উদ্যোগ তৈরি ও পরিচালনা করার কাজ। এটি প্রায়ই বাজারে উদ্ভাবনী ধারণা আনতে সুযোগগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি ঝুঁকি নেয়া ও সংস্থানগুলোকে সংগঠিত করে। উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তার মধ্যে অভিন্ন সত্তা বিদ্যমান। অর্থাৎ মিথস্ক্রিয়া। উদ্যোক্তারা প্রায়ই বাজারে সুযোগগুলো চিহ্নিত করে এবং সেটি বাস্তবায়নের জন্য উদ্ভাবনী ধারণা প্রয়োগ করে। অর্থাৎ উদ্যোক্তারা উদ্ভাবনী ধারণা বাজারে আনতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি- গণমুখী উদ্ভাবনের বাণিজ্যিক রূপান্তরই উদ্যোক্তা। অর্থাৎ সফল উদ্যোক্তার কাজ হচ্ছে উদ্ভাবনের বাণিজ্যিকীকরণ ও প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগতি অর্জনের জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবনের অনুসন্ধান। এ ধারণা থেকে বলা যায়- A developing country like Bangladesh, fostering entreprenurship is not only an option, it is an imperative, which will profound impact on employment & economy. অর্থাৎ বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল একটি দেশের প্রেক্ষাপটে উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করা শুধু বিকল্প নয়, এটি অপরিহার্য। যা দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে।
উদ্যোক্তা বিকাশে রাষ্ট্রীয় নীতি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত ও অনুসরণ করা শুধু সময়ের দাবি নয়; বরং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম হিসেবে গণ্য করা উচিত। যেখানে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুসৃত হতে পারে।
১। উদ্যোক্তা বিকাশের জন্য সমাজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে শিক্ষা ব্যবস্থার মান ও প্রাসঙ্গিকতা উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য ব্যক্তির প্রয়োজনীয় সমাজ, অর্থনীতি ও দক্ষতা নিশ্চিতকল্পে টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং এবং কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।
২। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্যোক্তা বা এন্টারপ্রিউনিয়ারশিপ কোর্স মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রবর্তন জরুরি। প্রজেক্ট বেইজড লার্নিং পদ্ধতি চালু করে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আগ্রহী করা এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন উদ্যোগে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করা। একই সঙ্গে উদ্ভাবন ও গবেষণালব্ধ ধারণার বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে মানুষের প্রয়োজনীয় প্রোডাক্ট তৈরিতে বেসরকারি খাত উৎসাহিত করা যেতে পারে।
৩। অনেক ভালো উদ্ভাবন বা ধারণার বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে মনুষ্য ব্যবহার্য পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অর্থ জোগান উদ্যোক্তাদের জন্য একটি মৌলিক বাধা। তাই উদ্ভাবনী স্টার্টআপ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সিড ফান্ডিংয়ের জন্য সরকার একটি ডেডিকেটেড তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড ও অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর নেটওয়ার্কের মতো উদ্যোক্তাদের প্রতিশ্রæতিশীল ও ডেডিকেটেড স্টার্টআপে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে। উদ্ভাবনী ধারণা বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের অত্যন্ত স্বল্প সুদে ঋণ অনুদান প্রাপ্তিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করা এবং ঋণ ও অনুদান প্রাপ্তি অধিকতর সহজীকরণে ডিজিটালাইজড করা।
৪। উদ্যোক্তা বিকাশ উৎসাহিতকরণের জন্য উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ (Entrepreneurship Ecosystem) সৃষ্টির জন্য উদ্যোক্তা ব্যবসায়িক নিবন্ধন ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজতর করা।
৫। উদ্যোক্তাদের বৈশ্বিক বাজারে সংযুক্ত করার জন্য উচ্চ গতির ইন্টারনেটের ন্যায় ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ অপরিহার্য বিবেচনায় শিল্পপার্ক, প্রযুক্তিনির্ভর ইনকিউবেটর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং কেন্দ্রের বিকাশে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। যাতে উদ্যোক্তারা স্বল্পমূল্যে ইনকিউবেটরের সেবা নিয়ে প্রোডাক্ট তৈরিকরণসহ মার্কেটিং সাপোর্টিং পায়। সরকারি উদ্যোগে তৈরি পণ্য দেশে বিদেশে বিক্রয়ের উদ্যোগ নিতে হবে।
৬। উদ্যোক্তা সহায়ক ইকোসিস্টেমের জন্য নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, মেন্টরশিপ সাপোর্টিং প্রোগ্রাম ও উদ্যোক্তাদের জন্য উপদেষ্টা পরিষেবা সহজতর করা। স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা প্রদানপূর্বক উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা।
৭। উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উদ্ভাবনী ও উদ্যোক্তা স্টার্টআপগুলোয় কর প্রণোদনা সুবিধার আওতায় গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য কর বিরতি, প্রাথমিক পর্যায়ের স্টার্টআপগুলোর জন্য করপোরেট করের হার হ্রাস ও বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত করা।
৮। উদ্যোক্তা বিকাশ এবং জনগোষ্ঠীকে সৃজনশীল ধারণায় উৎসাহিতকরণে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করে সহজলভ্য আয় যেমন দুর্নীতি, ঘুষ, অনিয়ম, ঋণখেলাপি, জবরদখল ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচিতে ভাড়া খেটে আয়ের ন্যায় অনৈতিক আয়ের পথ রোধ করতে হবে।
৯। নিম্ন আয়ের প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও শহুরে গ্রামীণ জীবনমানের বৈষম্য দূরীকরণে নারী, আধিবাসী, গ্রামীণ ও নগর জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোক্তা বিকাশে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
১০। বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন প্রায় ১০৮৪ রকম ব্যবসার ধরনের অনুমোদন দেয়। এই রকম বা ধরন নির্ধারণও হয়েছে অনেক বছর আগে যখন ব্যবসার রকমে খুব বেশি আধুনিকায়ন হয়নি। বর্তমানে অনেক উদ্যোগের নতুন নতুন ধরন আছে, যা সরকারি তালিকায় নেই। এজন্য সরকারকে উক্ত তালিকা সংশোধন করতে নতুন নতুন ব্যবস্থাগুলোকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করা।
১১। দেশে ব্যাপকভাবে উদ্যোক্তা গড়ে তোলার জন্য টিভিইটি গ্র্যাজুয়েটদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা প্রয়োজন। কেননা কারিগরি শিক্ষা দক্ষতার সঙ্গে পুঁজি বা অর্থ (ক্যাপিটাল) যুক্ত করা হলে স্বল্পমূল্যে উদ্বৃত্ত মান বা মূল্য তৈরি করবে।
১২। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও এসএমই ফাউন্ডেশনকে একীভূত করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘উদ্যোক্তা ও হালকা প্রকৌশল শিল্প কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
উপযুক্ত ধারণাগুলো অনুসৃত করে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় বাংলাদেশে উদ্যোক্তা কর্মসূচি আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে- (ক) কৃষি কার্যক্রম ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসা, কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চাষাবাদ কৌশলে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান এবং কৃষিপ্রযুক্তি স্টাপআপ ও মার্কেট অ্যাক্সেস সহজতর করার জন্য কৃষি উদ্যোক্তাদের বিকশিত করতে হবে। এছাড়া (খ) টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টর (গ) তথ্যপ্রযুক্তি ও আউটসোর্সিং খাত (ঘ) নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত ও সবুজ শক্তিতে প্রণোদনা (ঙ) নীল অর্থনীতি সৃষ্টি করতে পারে সাগরের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার ব্যবস্থা করতে হবে (চ) মাইক্রোফাইন্যান্স ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খাতে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, ফিনটেক স্টার্টআপ কার্যক্রমকে সহায়তা করে উদ্যোক্তা সৃষ্টি (ছ) হালকা শিল্প ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্প কারখানা গড়াসহ উৎপাদনে প্রণোদনা প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা গড়ে তোলা (জ) সরকারিভাবে সামাজিক এন্টারপ্রাইজ ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠাপূর্বক উদ্যোক্তাদের উৎপাদনে উৎসাহিত করে, মার্কেটিং সহযোগিতা প্রদান এবং (ঝ) নারী ও যুবকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ, মাইক্রোলোনের অ্যাক্সেস ও মেন্টরশিপ সার্ভিস প্রদানপূর্বক উদ্ভাবন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উদ্যোক্তা সংস্কৃতি সৃষ্টিতে/প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে, (ঞ) দেশের সব সার্ভিস সেক্টরে সেবাগুলোর মানোন্নয়ন ও নতুন নতুন সেবা খাত গড়ে তোলা হলে একদিকে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে এবং একটি বিশাল যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, (চ) দেশের পর্যটন শিল্প বিকশিত করে নানামুখী কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যেতে পারে।
উপরোক্ত আলোচনায় এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, উদ্যোক্তা নীতি বাংলাদেশের ন্যায় একটি অগ্রসরমান উন্নয়নশীল দেশের জন্য শুধু ধারণা নয়; এটি রূপান্তরকারী মন্ত্রও। উদ্যোক্তা ধারণা অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা আনতে পারে। যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবিমোচনই নয়, বরং চূড়ান্তভাবে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা ও পরিকাঠামো সেবা নিশ্চিতকরণে সরকারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ভবিষ্যতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোক্তা বিকাশের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারলে, সমৃদ্ধ জাতিসত্তা নির্মাণে বাংলাদেশ যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য উদ্যোক্তা নীতি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। যা উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃৃষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই গণমুখী উদ্যোক্তা নীতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসা অর্থাৎ (এসএমই) প্রতিষ্ঠা এবং বৃদ্ধির জন্য মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উদ্যোক্তা নীতি এমন একটি পরিবেশকেও প্রচার করে যেখানে নতুনদের ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে আগ্রহী এবং উৎসাহিত করে, যা নতুন পণ্য, পরিষেবা এবং শিল্প তৈরির দিকে পরিচালিত করে। অধিকন্তু, এই নীতিগুলো ব্যবসার বৃৃদ্ধি এবং কাজের সুযোগ তৈরি করে বেকারত্ব মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্যোক্তা নীতির মাধ্যমে অনুন্নত এলাকায় ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রচারের মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরো সুষম বণ্টনে অবদান রাখতে পারে। একটি বৈচিত্র্যময় ও গতিশীল সমাজে উদ্যোক্তা নীতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসতে সহায়তা করে এবং স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে তাদের ব্যবসায় উৎসাহিত করতে পারে। উদ্যোক্তা নীতি সমাজের সবার মাঝে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগগুলো জানার এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এবং একটি গণমুখী উদ্যোক্তা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্ম জগতের সৃষ্টি হবে। দেশের জনগণের বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এটাই অন্যতম পথ।

এ কে এম এ হামিদ : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়