প্রতিবন্ধী তরুণদেরও রাজনীতিতে অংশ নেয়া প্রয়োজন : প্যানেল আলোচনায় ছাত্রনেতারা

আগের সংবাদ

অবস্থান স্পষ্ট করল আওয়ামী লীগ : বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করার কোনো সুযোগ নেই

পরের সংবাদ

কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে > বাস্তবায়নে এগিয়ে আ.লীগ > কথা রাখেনি বিএনপি > ছায়া সরকার হতে পারেনি জাপা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : নির্বাচনের আগে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। কথার ফুলঝুরিতে তুলে ধরা হয় চটকদার প্রতিশ্রæতি। উন্নয়নের নানা চমক জাগানিয়া স্বপ্ন দেখিয়ে জনগণের সেবক হতে চান তারা। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক ঘোষণা, অনেক প্রতিশ্রæতি থাকে; কিন্তু ইশতেহারে ঘোষিত লক্ষ্য ও আদর্শগুলো বাস্তবায়নের জন্য কোনো সময়রেখা থাকে না। জবাবদিহিতা থাকে না। ক্ষমতাসীনদের কাজে ও আচরণে ইশতেহারে ঘোষিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলোর প্রতিফলন তেমন ঘটে না। আর বিরোধী দলগুলো সংসদে আসন পেলেও তাদের ইশতেহারে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না; কারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার লক্ষ্য রেখেই ইশতেহার লেখা হয়। এজন্য নির্বাচনী ইশতেহারের আইনি ভিত্তি দেয়া, নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ইশতেহার তৈরির আগে তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে জনগণের মতামত নেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে (২০১৮ সালে) ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইশতেহারে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকারসহ ৩৩টি অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ (আ.লীগ)। ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকে ‘এগিয়ে যাব একসঙ্গে, ভোট দেব ধানের শীষে’- স্লোগানকে সামনে রেখে ১৯ দফা প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। আর ‘গণতন্ত্রের বিকাশ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার’ লক্ষ্যে ‘সৌভাগ্যের’ প্রতিশ্রæতি স্লোগানে ১৮ দফার নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার কথার ফুলঝুরি। বেশি থাকে আগের ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নের আশ্বাস। তবে আগের ইশতেহারের সঙ্গে নতুন ইশতেহারের তুলনা থাকে না। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতায় যাওয়াই রাজনৈতিক দলের মূল বিষয়। ক্ষমতায় গেলে দেশের জন্য কী করবেন- সেজন্য ইশতেহার দেন। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে ইশতেহার তৈরি করা, বাস্তবায়ন করা- সেই চর্চার সংস্কৃতি

গড়ে ওঠেনি, সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি সরকারি-বেসরকারি উভয় দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটা ইশতেহার দিতে হবে, তাই দেয়া।

সাফল্যের পাল্লা ভারি আওয়ামী লীগের : ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে প্রাধান্য পেয়েছিল তরুণদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর এবং কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা, সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল। সেই সঙ্গে ঘোষণা ছিল মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা, সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ব্লু-ইকোনমি-সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন, নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা দিয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।
ইশতেহার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগানে গ্রামে গ্রামে এখন বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি। পদ্মা সেতু চলাচলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বেড়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিল্প, শ্রমিকদের কল্যাণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, যোগাযোগ, পরিবেশ, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, শিশু ও বয়স্কসহ মুক্তিযোদ্ধা এবং শারীরিকভাবে অক্ষমদের কল্যাণ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রের অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন হয়েছে। একসঙ্গে ১০০ সড়ক ও ১০০ সেতু উদ্বোধন হয়েছে। মেট্রোরেল চলাচলের মধ্য দিয়ে নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছে সরকার। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল খুলে দেয়া হবে ২৮ অক্টোবর। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলে তারুণ্যের শক্তিকে দেশের সমৃদ্ধির কাজে লাগাতেও সফল হয়েছে। ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৭০৯ মার্কিন ডলার, বর্তমানে তা ২ হাজার ৮২৪ ডলারে পৌঁছেছে।
এদিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-২০২০) সরকার ১ কোটি ২৯ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। তবে প্রতিশ্রæত ১ কোটি ২৯ লাখের বিপরীতে ৯৫ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরেছে সরকার। প্রতিশ্রæতির চেয়ে ৩৪ লাখ কম কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ বছরে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫) ১ কোটি ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চায় সরকার। এর মধ্যে ৮১ লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে দেশের ভেতরে। বাকি ৩২ লাখ মানুষ যাবে দেশের বাইরে। সম্প্রতি (৫ জুলাই) জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বিগত এক যুগে পেশাজীবী, দক্ষ, আধাদক্ষ ও স্বল্পদক্ষ ক্যাটাগরিতে ৮১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪২ জনের বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়েছে। গত এক যুগে প্রায় ১০ লাখ নারীকর্মী বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।
সংসদ উপনেতা, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার ইশতেহার ধরে ধরে উন্নয়নের পথে হাঁটছে। আমার গ্রাম আমার শহর হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে। শিক্ষা খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য আমাদের। স্বাস্থ্য খাতে কমিউনিটি হাসপাতালে বিনামূল্যে ৩১ ওষুধ দেয়া হয়- যা বিশ্বে সাড়া জাগানিয়া।
আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, ইশতেহার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ বরাবরই অটল। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই দল জনগণকে দেয়া কথা রেখে আসছে প্রতি মেয়াদেই। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার সরকারে আসার আগে দলটির নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার। দেশ ডিজিটাল হয়েছে। প্রতিশ্রæতির বাইরেও কাজ করেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারি মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক সংকট থেকে উত্তরণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অস্থিতিশীল বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মেগা প্রকল্প, খাদ্য, পুষ্টি, কৃষি, গ্রাম ও শহরে সুষম উন্নয়নে গুরুত্ব রয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা বড় চ্যালেঞ্জ। ধর্মীয় জঙ্গি, নারী ও শিশু পাচার, মাদক নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জ। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বল দিক রয়েছে সত্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হাতে এসব অপরাধ-অপকর্ম দমন করতে হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, রাজনীতিতে অপশক্তি দমন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদ কার্যকর রয়েছে। পদ্মা সেতু উন্নয়নের আইকন। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, পায়রা বন্দর ও ১০০ অর্থনৈতিক জোন তৈরির কাজ চলছে। এজন্য দরকার উন্নয়নের অঙ্গীকার, দেশপ্রেম এবং আপসহীনতা- যা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রয়েছে। তবে এখনো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে উন্নয়ন এগিয়ে নেয়ায় আত্মবিশ্বাসী সরকার।
এদিকে ২০১৪ সালে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামের ২৬ দফার ইশতেহারেও উন্নয়ন, সুশাসনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রতি বছর মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশের কথা বলা হয়েছিল। তবে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আয়ের হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারে অবনমন, রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহার, মত প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অভাব, বিচারহীনতা, সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় স্বার্থের দ্ব›দ্ব, ব্যাংকিং খাত ও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে মনে করে টিআইবি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি দল তাদের তিন মেয়াদে সুশাসনের ক্ষেত্রে যে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছিল, সেই ধারাবাহিকতা তারা বজায় রেখেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক বক্তৃতাই হোক; আর প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাই হোক- শূন্য সহিষ্ণুতার ঘোষণাটি তারা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের জায়গাটি তুলে ধরেছেন। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের জন্য যে প্রস্তুতি ও কৌশল প্রয়োগ দরকার ছিল, তার প্রয়োগ আমরা দেখিনি। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি দমন প্রতিরোধক কার্যক্রম সে পরিমাণে আমরা দেখতে পাই না। এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি- যার ফলে বলা যায় দুর্নীতি দমন হয়েছে। অন্যদিকে, যাদের ওপর দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি বিরোধী চর্চা দেখতে পাইনি। বরং তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, লাভবান হয়েছেন এবং যোগসাজশ রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমেনি। সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে দুদকের পূর্ব অনুমতি লাগবে। এটি বৈষম্য। যেখানে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম সেখানেই তাদের সুরক্ষা দেয়া হলো। মানিলন্ডারিং দুদকের হাত থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সৃষ্টির কারণে দুর্নীতি হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুশাসনের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে; কিন্তু সেগুলো রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত। এটি ধারাবাহিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, বিচারিক ব্যবস্থা ও সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো রাজনৈতিক বলয়ে প্রভাবিত- যার কারণে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার বিষয়গুলো যথাযথভাবে কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। সুশাসনের যে সূচকগুলো আছে তার প্রতিটি সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে।
এদিকে বাকস্বাধীনতা, সড়ক দুর্ঘটনা, দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির মতো বিষয়গুলো সরকার ঠেকাতে পারছে না- এমন অভিযোগ কারো কারো। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত ও ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছেন। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২১১ জন। ২০২০ সালে ৫ হাজার ৪৩১। ২০২১ সালে ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং ২০২২ সালে সড়কে মারা গেছেন ৬ হাজার ৫৪৮ জন। অন্যদিকে গত ১২ বছরের মধ্যে গত আগস্টে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল খাদ্যপণ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপ এবং বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যায়নি। এছাড়া বাজারে চাহিদা কত, সরবরাহ কত, উৎপাদন কত, আমদানি কতটুকু করতে হবে, কখন করতে হবে, আমদানিটা উন্মুক্তভাবে হচ্ছে কিনা- এসব তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে বড় ধরনের দুর্বলতার কারণে খাদ্য পণ্যের দামে ঊর্ধগতি ঠেকানো যায় না।
আর বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) বার্ষিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানে ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এই সূচকে ২০২২ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬২তম- যা ২০২১ সালে ছিল ১৫২তম। তবে আরএসএফের প্রতিবেদনকে ‘আপত্তিকর’ ও ‘বিদ্বেষপ্রসূত’ বলে মন্তব্য করে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সে সময় বলেছিলেন, প্যারিসের এই সংগঠনটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে অসত্য, ভুল ও মনগড়া রিপোর্ট করে।
তবে সরকারের দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। করোনার মধ্যেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আশ্রায়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন মানুষ গৃহ পাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বেড়েছে।
কথা রাখেনি বিএনপি : ২০১৮ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রæতির মধ্যে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয় করা, শিক্ষিত তরুণদের চাকরি নিশ্চিত করা, সংবিধান সংশোধন করে নি¤œ আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার অঙ্গীকার করে বিএনপি। ২০০১ সালে দলীয় ইশতেহারে ত্রিশটিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার করেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির প্রতিশ্রæতির মধ্যে সংসদের আসন সংখ্যা বাড়েনি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের হিসাব দেয়া হয়নি, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়নি, রাষ্ট্রায়ত্ত রেডিও-টিভির স্বায়ত্তশাসন হয়নি, গঙ্গার পানি চুক্তি পরিবর্তন হয়নি, স্থায়ী পে-কমিশন হয়নি, পার্বত্য চুক্তির নতুন সমাধান হয়নি, ইন্টারনেট ভিলেজ হয়নি, সবার জন্য বিদ্যুৎ হয়নি, প্রবাসী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও তৈরি পোশাক শিল্পে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন হয়নি, সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি কথা রাখলে তখন দুর্নীতি, দলীয়করণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো ঘটত না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির সূচকে বিএনপির শাসনামলে পরপর চার বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে। অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করেনি। গণতন্ত্রায়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, ক্ষমতার ভারসাম্য- এসব ক্ষেত্রে তাদের কোনো প্রতিশ্রæতিই বাস্তবের মুখ দেখেনি। উল্টো তাদের সময় দুর্নীত ও অর্থ পাচার বেড়েছে।
তবে বিএনপির দাবি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও বিএনপি প্রায় সমার্থক। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, বিএনপি যখনই দেশ সেবার দায়িত্ব পেয়েছে তখনই দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং নারী আসন বাড়ানোর পাশাপাশি সব সেক্টরেই আমরা কাজ করার চেষ্টা করেছি। বিএনপির আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাতের কোঠায় পৌঁছেছিল। কৃষি খাতে বৈপ্লবিক উন্নতি হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় হয়েছে।
‘ছায়া সরকার’ হতে পারেনি জাতীয় পার্টি : ১৮ দফা অঙ্গীকারে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, দুই স্তর বিশিষ্ট সরকার কাঠামো, নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করে বর্তমান ব্যবস্থার বদলে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে জয় পরাজয় নির্ধারণের ব্যবস্থা করা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় সংসদে ৩০টি আসন সংরক্ষণ করা, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ‘তিন মাসের মধ্যে’ সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি সমূলে নির্মূল করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্র্টি (জাপা)। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পার্টির নেতারা বলেছিলেন, সত্যিকারের বিরোধী দল হতে চায় জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে সংসদে কতটা ভূমিকা পালন করতে পেরেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেন, বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি বিভিন্ন ইস্যু সংসদে তুলে ধরছে। বিরোধী দলের ভূমিকা সম্পূর্ণ গঠনমূলক। জাতীয় পার্টি সরকারের ভালো কাজের যেমন প্রশংসা করেছে; তেমনি মন্দ কাজের সমালোচনা করতেও ছাড়ছে না। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না। সংসদ বর্জন ও অযৌক্তিক ওয়াকআউট না করেও সংসদের ভেতরে জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বলছি। সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছি। হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, রাস্তা বন্ধ করে মানুষকে কষ্ট দেয়ার রাজনীতি জাতীয় পার্টি করে না। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সংসদে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করে; জাপাকে এ ভূমিকায় সফল দাবি করে জি এম কাদের বলেন, একাদশ সংসদে প্রতিটি বিলেই বিরোধী দল গঠনমূলক সংশোধনী ও জনমত যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব করেছে। যার কারণে সরকার কোনো কোনো সময় বিরোধী দলের সংশোধনী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারকে বিরোধী দলের সঙ্গে সহমত পোষণ করতে হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ছায়া সরকার’ হতে পারেনি জাতীয় পার্টি। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, জাতীয় পার্টি দুর্বল বিরোধী দল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী বিরোধী দল। তা নাহলে চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকে না। সরকারি দলের বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি থাকে। বিরোধী দল সেগুলো নিয়ে কথা বলবে। জনগণের স্বার্থে কথা বলবে; কিন্তু বর্তমানে বিরোধী দল এত দুর্বল- যা আমাদের দুর্ভাগ্য।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সংস্কৃতিটাই আমাদের প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রে যে এজেন্ডা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বাস্তবায়ন করে; সেই এজেন্ডা নিয়ে বিরোধী দলে থেকেও কাজ করতে পারে। কারণ বিরোধী দল ছায়া সরকার। কিন্তু আমাদের দেশে যারা বিরোধী দলে থাকে, তারা মনে করে সব হারিয়ে ফেলেছি। একটা সময়ে ছিল সংসদ বর্জন। এখন সংসদে সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল নেই। ছায়া সরকারের ভূমিকা কার্যকর করতে দেখি না। কনসেপ্টটাই তৈরি হয়নি। বিরোধী দল প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেনি। বাইরের দেশগুলোতে ছায়া সরকার খুব শক্তিশালী। ছায়া মন্ত্রিপরিষদ থাকে। তারা সরকারের ভুলগুলো তুলে ধরে এবং জবাবদিহিতার জায়গা নিশ্চিত করে।
ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, বিরোধী দল ছায়া সরকার। মত প্রকাশ, বাকস্বাধীনতা, সরকারের কর্মকাণ্ড নিখুঁত পর্যালোচনা করা বিরোধী দলের কাজ। এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করে বিরোধী দল- সেটা তারাও বলতে পারবে না। ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আবেগের রাজনীতি আলাদা; কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা, সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা- দুটি ভিন্ন জিনিস। সমালোচনার জন্য সংসদে থাকতে হবে। সেখানে সরকারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবে বিরোধী দল। সেই ইতিহাস থেকে আমরা অনেক দূরে। এখন বিরোধী দলের রাজনীতি হয়ে গেছে রাজপথ কাঁপানোর। মানুষ এতে মশলা পায়। অথচ তাদের বড় কাজ সংসদে, সেখানে যায় না। গেলে ওয়াকআউট করে। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে যায়নি। কিন্তু সংসদে যায় না ২০১১ সাল থেকে।
প্রয়োজন জবাবদিহিতার সংস্কৃতি : বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ইশতেহার দিয়েই ভোট সংগ্রহ করে থাকে। সেজন্য এটিকে অবশ্যই আইনি ভিত্তি দেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে ইশতেহার গুরুত্ব না পাওয়ার পেছনে নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা চাওয়ার অভাব একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোকে এই ইশতেহার ধরে তারা কোনো প্রশ্ন করে না বলেই রাজনীতিকরা সেই সুযোগটা নেন।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নেই বলেই প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না কেউ। ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ প্রাধান্য পায়, জনগণের স্বার্থ নয়।
ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো কোনো প্রাইভেট কোম্পানি নয়। তাদের প্রশ্ন করা যায়, কিন্তু বাধ্য করা যায় না। আমাদের মতো দেশগুলোতে ইশতেহার করার জন্য অনেক সময় দেয়া হয়। কিন্তু ইশতেহারে শুধু অঙ্গীকার করা হয়- কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এ সম্পর্কে কিছু বলা হয় না। অনেকের মনে হবে, এটি অসম্ভব; কিন্তু অসম্ভব নয়। ভোটার আকৃষ্ট করার জন্য চটকদার ভাষা থাকে। রাজনীতিবিদরাও জানেন, জবাবদিহিতা কাজ করে না। নির্বাচন পরবর্তী জবাবদিহিতা এখনো কথার কথা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়