প্রস্তুতি ম্যাচ : ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টাইগারদের হার

আগের সংবাদ

রাজনীতিতে সমঝোতার উদ্যোগ! : বৈরিতার পারদ নিম্নমুখী, আ.লীগের ৫ সদস্যের কমিটি, প্রতিনিধি দল গঠন করছে বিএনপি

পরের সংবাদ

ঝুঁকি প্রবল, প্রস্তুতি কম > বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা > মৃত্যুকূপ হবে রাজধানী > দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা নিয়ে সংশয়

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান : ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল। এরই মধ্যে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা ও মাঝারি মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে জনমনে। কেননা বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বা ভূস্তরের ভেতরের গঠন-বৈশিষ্ট্য, সিলেটের জৈন্তা এলাকার ডাউকি ফল্ট, বিভিন্ন ধরনের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের আলামত এবং এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের ইতিহাসক্রম থেকে ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, ক্রমশ বড় ভূমিকম্পের দিকে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। যে কোনো সময় ৭ কিংবা এর বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে। ভূমিকম্পের এমন ঝুঁকি থাকলেও মোকাবিলার প্রস্তুতি তেমন নেই। বিশেষত, রাজধানী ঢাকায় বহু পুরনো ও অপরিকল্পিত ভবন থাকা, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা এবং গ্যাস-বিদ্যুতের অপরিকল্পিত লাইন ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা- উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে মৃত্যুকূপে পরিণত হতে পারে রাজধানী। দেশকে পড়তে হবে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, সবশেষ গত সোমবার ৫ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। এটিসহ চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১০টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এগুলোর প্রায় প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল মঙ্গলবার নেপালে পরপর দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৬ এবং ৬ দশমিক ২। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে দেশটিতে আঘাত হানে এ দুটি ভূকম্পন। এটিও এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পন হওয়ার আলামত উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের মতো বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে যে পরিমাণ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্পে এসব ভবন ধসে পড়লে শহরগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। গ্যাস লাইন থেকে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিস্ফোরণও। এসব বিষয় মাথায় রেখে প্রস্তুতি নেয়ার এখনই সময়। স্বেচ্ছাসেবী তৈরি, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানো, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে বিল্ডিং কোড মেনে নতুন করে করা হলে ক্ষতি অনেকটা এড়ানো যাবে বলে

মত তাদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী ভোরের কাগজকে বলেন, ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০০ থেকে ১৫০ বছর পরপর ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশে যে কোনো সময় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। এজন্য আমাদের প্রস্তুতি প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অবশ্যই আমরা ওই পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না। এজন্য ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণে জোর দিতে হবে। রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে প্রতিটি ভবন পরিদর্শন করে চিহ্নিত করতে হবে- কোনটি কোনটি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে রানা প্লাজা ধসের পরে যে কার্যক্রমটি চালু করা হয়েছিল, ভবনকে লাল, হলুদ ও সবুজ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল। লাল মানে ঝুঁকিপূর্ণ, হলুদ মানে কম ঝুঁকিপূর্ণ, আর সবুজ মানে ঝুঁকিমুক্ত। আবারো সে ধরনের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী আরো বলেন, বর্তমানে অনুমান নির্ভরভাবে বলা হয়ে থাকে ২৫-৩০ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এর কোনো ভিত্তি নেই। নিয়ম অনুযায়ী ভবন পরিদর্শন করে জরিপ করা যেতে পারে। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে নতুন করে করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এজন্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তদারকির ব্যবস্থার পরামর্শ দেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলার ঘাটতি পৃথিবীর সব দেশেই রয়েছে। এটি আসলে বাস্তব অবস্থার সময় বোঝা যাবে। তবে, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে তীব্রতা ও মাত্রার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তীব্রতা যদি বেশি হয়, তাহলে কারোর ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। এক্ষেত্রে জাপান দীর্ঘ বছর ধরে চেষ্টা করে তাদের ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে। যা আমেরিকার মতো দেশ এখনো পারেনি। আমাদের বর্তমানে যে অবস্থা রয়েছে, সেক্ষেত্রে ভূমিকম্প মোকাবিলার মতো সব ভবন গড়ে তুলতে ৫০-৬০ বছর লেগে যেতে পারে। এজন্য বর্তমানে যে ভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোর মান ঠিক রাখতে আরো তৎপর হতে হবে। তবে, বাংলাদেশে যে একদমই ভূমিকম্পন সহনশীল ভবন নেই সেটি বলা যাবে না। বর্তমানে অনেক ভালো মানের বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মো. মিজানুর রহমান বলেন, ভূমিকম্প মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসকে যেভাবে গড়ে তোলা উচিত, সেভাবে এখনো গড়ে তোলা যায়নি। কারণ ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ঢাকার অনেক ভবন দেবে যাওয়া, বিদ্যুতের তার থেকে অগ্নিকাণ্ড এবং গ্যাসের পাইপলাইন ফেটে বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে। যার নমুনা, দিন দিন ফায়ার সার্ভিসকে আরো উন্নত করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের উদাহরণ টেনে ডিজি বলেন, ৪০০ বছরের ভূমিকম্পের ধরন দেখে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, দেশে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কম। এজন্য ৮ মাত্রার সহনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা অনেকটা নিরাপদ। সুতরাং স্থাপনা নির্মাণে বাইরের চাকচিক্যের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করার আগে অবকাঠামোগত মান বজায় রাখার পেছনে গুরুত্ব দিতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাইম মো. শহিদউল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, ভূমিকম্পের মতো বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বড় একটি বাহিনীর প্রয়োজন হয়। যেটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোনো দেশেই রাখা হয় না। এই অভাব পূরণ করতে পারে একমাত্র স্বেচ্ছাসেবকরা। এজন্য ২০০৯ সালে প্রথম ধাপে ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এই কাঠামোতে ৩ বছরের মধ্যে প্রতি শহরে ২০০ জন ও প্রতি ওয়ার্ডে ২০০ জন করে স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু এটি দীর্ঘ সূত্রতার মধ্যে চলে যায়। যার ফল, এখনো ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবকই তৈরি হয়নি। সারাদেশে আমরা মাত্র ৫৪ হাজার করতে পেরেছি। অথচ ২০০৯ সালের পরিকল্পনা অনুসরণ করলে এখন স্বেচ্ছাসেবক তৈরি হতো ৩ লাখেরও বেশি।
তিনি বলেন, স্বেচ্ছাসেবক তৈরিতে শুধু প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। প্রয়োজন পর্যাপ্ত সরঞ্জামেরও। প্রাথমিক ট্রেনিং নেয়ার ৩ বা ৬ মাস পরপর তাদের আবারো সরঞ্জাম দিয়ে কাজ করিয়ে আরো পরিণত করতে হবে। পাশাপাশি মডার্নাইজেশন অফ ফায়ার সার্ভিস বাস্তবায়ন করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের জনবল কমপক্ষে ৩০ হাজার করতে হবে। এখন কিছু টাকা খরচ করে স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করলে দুর্যোগে বোঝা যাবে এর বিরাট সুফল।
ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, রাজউকের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর ৯০ হাজার ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৪ হাজার ভবনের অনুমোদন দেন তারা। ৭০ হাজার ভবন অনুমোদন নিচ্ছে না। অর্থ্যাৎ প্রতি বছর হাজার হাজার ভবন নির্মাণ হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতেই। এই ভবনগুলোর বাস্তব অবস্থা কারোই জানার সুযোগ হচ্ছে না। এই জায়গাটিতে জোর দিতে হবে। কেননা বড় ভূমিকম্প হলে কি ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হবে সেটি আমরা কেউ জানি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজধানীতে ১২ হাজার মানুষের বিপরীতে একজন ফায়ার কর্মী। আর সারাদেশে ১১ হাজার ৭০০ জনে একজন করে ফায়ার কর্মী রয়েছেন। আমেরিকাতে ৯০০ জনে একজন করে ফায়ার কর্মী রয়েছেন। তবে কত মানুষে কতজন ফায়ার কর্মী থাকবেন সেটা নিয়ে আন্তজার্তিক কোনো হিসাব নেই। আমরা তো ২০৪১ সালে উন্নত দেশে যেতে চাচ্ছি। তাহলে তো ৯০০ জনে না হোক একহাজার জনে একজন লাগবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সিলেট অঞ্চলে স¤প্রতি ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগেরই উৎস সীমান্তের ওপারে মেঘালয় ও আসামে। ভূকম্পনের প্রধান উৎস হচ্ছে সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার ডাউকি ফল্ট। এই ফল্টের কারণেই দফায় দফায় ভূমিকম্প হচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দুটি ডাউকি প্লেট পরে গেছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে ছোট ছোট কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। দশবারো বছরের মধ্যে যে কানো সময় বড় ভূমিকম্প হবে।
তিনি আরো বলেন, ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় এক লাখ ভবন ধসে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি তাই হয়, পুরান ঢাকার চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ হবে। সেখানে উদ্ধার কাজই বন্ধ রাখার ঘোষণা দিতে হবে। অনেক ফায়ার স্টেশনও অচল হয়ে যাবে। উদ্ধারকাজ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, ভূমিকম্পের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নেই। বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে উদ্ধার সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে আমাদের আরো প্রস্তুতি ও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়