ইউরোপীয় কাউন্সিল : জাতিসংঘ ‘অথর্ব ও খোঁড়া’ হয়ে গেছে

আগের সংবাদ

পাল্টাপাল্টি আল্টিমেটাম! : বিএনপিকে ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম আ.লীগের, ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে খালেদার মুক্তি চায় বিএনপি

পরের সংবাদ

মুখে স্বস্তির ভাব, মনে উদ্বেগ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড়

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। দৃশ্যত সবাই মার্কিন ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ মার্কিন চাওয়ার সঙ্গে সরকারি দল, রাজপথের বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ- কারো চাওয়ারই অমিল নেই। তবে মুখে স্বাগত জানালেও উদ্বেগ রয়েছে সব মহলেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাইরে থেকে কোনো ওহি নাজিল নয়; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানো বেশি জরুরি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি অনুযায়ী- যারাই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত, তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। দৃশ্যত নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। যদিও নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেছেন, ভিসানীতি সরকার টু সরকারের বিষয়। নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ে কিছু করার নেই।
সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, মুখে না বললেও এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- উভয় দলই চাপে পড়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ক্ষমতাসীনরা যেমন নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না; তেমনি বিএনপিও নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের বিঘœ সৃষ্টি বা আন্দোলনের নামে জ¦ালাও-পোড়াও করতে গেলে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। সেক্ষেত্রে কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে এখন তাদের আরো সতর্ক হতে হবে। আবার নিষেধাজ্ঞা এড়াতে হলে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও বুঝেশুনেই কাজ করতে হবে। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে কোনো ধরনের বাধা দেয়া বা নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষ থাকার তাগিদ অনুভব করবেন।
তবে সরকারি দল বলছে, মাকিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা বিরোধী দলের জন্য সতর্কবার্তা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও স¤প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ বিষয়ে বলেন, কোনো একটা নীতি নিয়ে কারো পুলকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই নীতি তাদের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য হবে, যারা নির্বাচনে বাধা দেবে।
নির্বাচনসংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। আর ২০১৮ সালে নামকাওয়াস্তে অংশ নিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন ভালো না হওয়ার দায় পুরোটাই নিতে হয়েছে সরকারি দলকে। তাই আগামী নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার একধরনের দায় তৈরি হয়েছে সরকারি দলের ওপর। এ ব্যাপারে সরকারপক্ষের সাফ জবাব,

সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচনে সরকার বদ্ধ পরিকর। কারো হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, আমরা জানি কীভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেমন গণতান্ত্রিক দেশ, তেমনি আমরাও। আওয়ামী লীগের ভোটাররা মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত নয়। কারণ তারা বেশির ভাগ উন্নয়নশীল এই দেশেই থাকতে চায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ভাবছে না।
গত শুক্রবার ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী’ ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের কিছু সদস্যের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের কথা জানায়। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বলেন, এখন পর্যন্ত কাকে নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলো আমরা জানি না। যেহেতু জানি না, সুতরাং সেখানে আমার মন্তব্য করার এখতিয়ার নেই। আর ভিসানীতি তাদের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে কাকে যেতে দেবে, কাকে দেবে না, এটি তাদের ব্যাপার। সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই, মন্তব্য নেই।
এদিকে মার্কিন ভিসানীতির কোনো প্রভাব বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর ওপর পড়বে না বলে জানিয়েছেন ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, যাদের ওপর ভিসানীতি আসবে তারাই শুধু আমেরিকায় যেতে পারবে না। কিন্তু দুই লক্ষাধিক সদস্যের পুলিশবাহিনীর কজনই বা আমেরিকায় যান। খুবই নগণ্যসংখ্যক যান। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মনে করি, এই ভিসানীতির কারণে পুলিশবাহিনীর কাজে কোনো প্রভাব পড়বে না।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি তাদের পক্ষে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করছেন, এটি তাদের এক দফা আন্দোলনের আরেক ধাপ অগ্রগতি। সামনে আরো নিষেধাজ্ঞা আসবে। এই সরকার নির্বাচন করতে পারবে না। সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, এক দফা আন্দোলনের জন্য বড় টনিক হিসেবে কাজ করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন তাদের আন্দোলনের সুবিধা হবে। পুলিশ এবং অন্যরা তাদের বাধা দিতে ১০ বার চিন্তা করবে। ফলে আন্দোলনের গতি পাবে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেক আশা করে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। মনে করেছিলেন, একটি সুরাহা হবে। অথচ, তিনি ওখানে থাকতেই বাংলাদেশের প্রতি স্যাংশন জারি করল আমেরিকা। এই ভিসানীতি দেশের জন্য সম্মানের নয়। আজকে শুধু আমেরিকা নয়, দেশের মানুষও এ সরকারকে স্যাংশন দিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন প্রতিহত করতে চায়, যদি জ্বালাও-পোড়াও করে; তাহলে সেটাও নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। মার্কিন ভিসানীতির পরও যদি বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পথেই হাঁটে, তাহলে সেটা তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। আবার ভিসানীতির ভরসায় বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে গেলে তাদের এতদিনের আন্দোলন নৈতিক ভিত্তি হারাবে। বিএনপি মহলে তাই উল্লাসের স্রোতের পাশে অস্বস্তির চোরা স্রোতও রয়েছে। আওয়ামী লীগের অস্বস্তির চেয়ে বিএনপির অস্বস্তি কম নয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, যারা বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করবে তারাই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও কর্মসূচির কোনো সুযোগ থাকবে না। বিরোধী দল যদি এসবের আশ্রয় নেয়, তাহলে তারা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে রাজনীতির দেশীয় সুরাহার ওপর; তবুও ভিসানীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, কয়েক মাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিসানীতির ঘোষণা দিয়েছিল, তখন একটা চাপা অস্বস্তি ও আতঙ্ক ছিল একদিকে, অন্যদিকে ছিল উল্লাস। এখন ভিসা বিধিনিষেধ কার্যকর শুরুর ঘোষণা আসার পর সেরকম মনে হচ্ছে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ‘রফা’র ভিত্তিতে।
অধ্যাপক শান্তনু বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উভয় দলের ক্ষেত্রেই একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করেছে। তবে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ওই ওহি নাজিল দিয়ে কিছু হবে না। যে মতবিরোধ রয়েছে- রাজনৈতিক দলের ‘দেশীয় সমাধান’ ছাড়া তার সমাধান সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারি দলকে নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা ও সঠিক ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। আর বিরোধী দলকে সংবিধান ও গণতন্ত্র সমর্থন করে না এমন কোনো দাবিতে অনড় না থেকে সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। কারণ মার্কিন বার্তা সবার জন্যই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়