ডেমরায় পুলিশের অভিযান, গুলিতে যুবক আহত

আগের সংবাদ

ডিমের বাজারে মুনাফার থাবা : ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন, আমদানি করা ডিমে চাহিদা মেটাবে মাত্র একদিনের

পরের সংবাদ

চিকিৎসার নামে লোক ঠকানো : অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান আজ থেকে > অব্যাহত রাখলে জনগণ উপকৃত হবে

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : ক্রান্তিকালেও অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে বাণিজ্যে প্রাধান্য দিয়েছে। নিবন্ধন ছাড়াই মানহীন অনেক সেবা প্রতিষ্ঠানে ভুল ও ভুয়া চিকিৎসা দিয়ে আলোচনায় এসছে। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীর প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার পরিবর্তে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য খাতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়গুলো নজরে এলে বিভিন্ন সময় অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিছুদিন এই অভিযান চললেও পরবর্তীতে তা গতি হারায়। ২০২০ সালে এমন অভিযানে নেমেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু মালিকপক্ষের চাপে মাঝপথেই ইতি টানা হয় অভিযানের। এরপরও বিচ্ছিন্নভাবে অভিযান চলেছে; কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার নামে লোক ঠকানোর ব্যবসা থামানো যায়নি। কখনো কখনো অভিযানের ধরন ও লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অবৈধ জেনেও অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে গত বছর ২৫ মে আকস্মিক ঘোষণা দিয়ে অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখার সুপরিশ করেছিলেন সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টজন। এমনকি এ কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়েছিল বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতিও। সে সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছিল- চিকিৎসাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফেরাতে অনিবন্ধিত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বন্ধের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এরপর কিছুদিন সাঁড়াশি অভিযান চলে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাসহ বন্ধ করে দেয়া হয়। লাইসেন্স নবায়নের সময়ও বেঁধে দেয় কিছু প্রতিষ্ঠানকে। তবে পরবর্তীতে এ অভিযানের গতি অনেকটা কমে আসে। এ সুযোগে আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠে অবৈধ সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বাড়ার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রোগীদের জিম্মি করে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। এই দৌরাত্ম্য রোধে অবৈধ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে আবারো অভিযানে নামছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ সোমবার থেকে সারাদেশে একযোগে এ অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ বিষয়ে জেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে অধিদপ্তর। গতকাল রবিবার দুপুরে এক জরুরি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেই, মেয়াদোত্তীর্ণ এবং অনিয়ম করছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা গত বছর অভিযান পরিচালনা করেছি। ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে ফের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের তথ্য পাচ্ছি। যারা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আমরা আবারো ব্যবস্থা নেব। সোমবার থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফের অভিযানে নামবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়েছে। একযোগে সারাদেশে এ অভিযান পরিচালিত হবে।
আহমেদুল কবীর বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীর জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) প্রয়োজন হয় না। তারপরও কিছু ক্লিনিক যাদের আইসিইউ প্রয়োজন নেই; তবুও রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে তারা আইসিইউতে রাখে। এসব বিষয়ে অধিদপ্তর নজর রাখছে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, কিছু ক্লিনিক এবং হাসপাতাল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে রোগীকে হাসপাতালে রাখছে এবং আইসিইউতে নিচ্ছে। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে এবং যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন নেই কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ সেসব হাসপাতালের বিরুদ্ধেই

আমাদের অভিযান পরিচালিত হবে। আমরা আমাদের রোগীদের জিম্মি করে কোনো অসাধু চক্রকে লাভবান হতে দেব না। যারা এ ধরনের কাজ করছে তারা দেশপ্রেমিক নয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময় বলে আসছেন, দেশে অনুমোদন ছাড়া কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাতে পারবে না। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে অনুমোদন নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা সূত্রে জানা গেছে, লাইসেন্স নিয়ে ১৯৮২ সাল থেকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে একবার লাইসেন্স নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আর তা নবায়ন করেনি। অনেক প্রতিষ্ঠান শুরুতে ১০ শয্যার অনুমোদন নিলেও পরে শয্যা বাড়ালে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানায়নি। অনেকে শয্যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ায়নি জনবল। সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও গত বছর অভিযান চালিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের লাইসেন্স পেতে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। ১০ শয্যার একটি ক্লিনিকের লাইসেন্স পেতে হলে ওই ক্লিনিকে কমপক্ষে ৩ জন এমবিবিএস ডাক্তার, ৬ জন নার্স ও ২ জন ক্লিনার থাকতে হবে। প্রত্যেকটি বেডের জন্য কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে। আপারেশন থিয়েটার হতে হবে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত। সেই সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি যা থাকতে হবে তার একটি তালিকাও দেয়া আছে। এর সঙ্গে থাকতে হবে ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন নম্বর, বিআইএন নম্বর, পরিবেশ ও নারকোটিকস বিভাগের লাইসেন্স। আউটডোর, জরুরি বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটার সব ক্লিনিকের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হাসপাতালের ধরন অনুয়ায়ী শর্ত নির্ধারণ করা হয়। হাসাপতাল বা ক্লিনিকের লাইসেন্সের আবেদন করার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি দল সরজমিন তদন্ত করে লাইসেন্স দিয়ে থাকে। লাইসেন্সের শর্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একই তবে লাইসেন্স ফির ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। এক ইউনিটের একটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সর্বনি¤œ ১০টি শয্যা থাকতে হবে। শয্যাসংখ্যা বেশি হলে আনুপাতিক হারে জনবল এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব ভোরের কাগজকে বলেন, সারাদেশেই সরকারি চিকিৎসাসেবায় ঘাটতির সুযোগ নিয়ে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কোনো নিয়ম না মেনে শত শত হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চাহিদা বাড়ছে। এখন এই চাহিদার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন স্থানে বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল বা ক্লিনিক গড়ে উঠছে। সেবার মানসিকতার চেয়ে ব্যবসায়িক চিন্তা বড় হয়ে উঠছে। তাই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার লক্ষ্যটাই প্রধান্য পাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক বেসরকারি ক্লিনিকগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা যথাযথ নজরদারি কাঠামো তৈরি হয়নি। রেগুলেটরি কোনো মেকানিজম নেই এবং আর্থিক সঙ্গতিও নেই। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়গুলো তদারকি করলেও নিবন্ধনের প্রক্রিয়া চালানো এবং নজরদারির জন্য তাদের প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই। তাই সার্বিকভাবে বিষয়গুলোর দিকে নজর না দিয়ে শুধু অভিযান চালিয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে না।
আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান মনে করেন, চিকিৎসার বেলায় অব্যবস্থাপনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব অবৈধ ক্লিনিক আছে, তাদের যে মান থাকা উচিত, তা নেই। সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই, কোনো ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। ল্যাবে যেসব যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোও মানহীন। রোগীরা প্রতারিত হবেন বা সঠিক চিকিৎসা পাবেন না, এরকম ক্লিনিক বা হাসপাতাল দরকার নেই। এসব বন্ধে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। অভিযান পরিচালনা করবে এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে কাক্সিক্ষত ফল পেতে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ দরকার। এটা যেন থেমে না যায়। এজন্য সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসম্মত করার কাজটি কখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ধারাবাহিকভাবে করেনি। এর আগে অনেকবার উদ্যোগ নিলেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে মানহীন চিকিৎসার কারণে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। আমরা চাই এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। অভিযান চালিয়ে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো বন্ধ করলে সমস্যার সমাধান হবে না। বেসরকারি খাতে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন তদারকি প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও সংঘবদ্ধ প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে।
জানা যায়, গত বছরের অভিযানে বন্ধ করে দেয়া কিছু প্রতিষ্ঠান ঊর্ধ্বতন মহলের প্রশ্রয়ে সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে। বন্ধ করে দেয়া অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নতুন নামে আবেদন করছে। এগুলো সবই চলে অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে গোপন আঁতাঁত করে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়