‘রাজাকারদের জনসংখ্যা বেড়েছে’

আগের সংবাদ

চাপ কমলেও সতর্ক থাকবে আ.লীগ

পরের সংবাদ

সরকারি চিকিৎসক সংকটের সঙ্গে আছে পদোন্নতি বঞ্চনা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : নানা সংকটের মধ্যেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চলছে চিকিৎসাসেবা। এর মধ্যে চিকিৎসক সংকট দীর্ঘদিনের। করোনা মহামারির সময় এই সংকটের তীব্রতা বেশি অনুভূত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু চিকিৎসক নিয়োগও দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও সংকট কাটেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩২ হাজার ৪৯৬টি সরকারি চিকিৎসক পদ সৃষ্টি করা আছে। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৬৪৮টি পদে চিকিৎসক পদায়িত হয়েছেন। বাকি ৫ হাজার ৮৪৮টি পদ খালি আছে। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড সেটআপ অনুযায়ী, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে আরো ৮ হাজার ৩শটি পদ সৃজন করা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ১ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী দেশে চিকিৎসক সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।
অধিদপ্তর বলছে, প্রতি বছর সরকারি চিকিৎসকের একটি অংশ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে অধ্যয়নরত থাকেন। তাই প্রান্তিক সেবাকেন্দ্র, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক সরকারি চিকিৎসক অবসর গ্রহণ করে থাকেন, যা প্রতিনিয়ত চিকিৎসক-শূন্যতা তৈরি করছে।
স¤প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক প্রকাশিত এক গবেষণায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র উঠে আসে। সেখানে অনুমোদিত পদের বিপরীতে শূন্য পদের বিষয়ে বলা হয়, জেলা হাসপাতালে ৩০ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৩ শতাংশ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য। জেলা হাসপাতালে ৫১ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৭ শতাংশ জুনিয়র বা সিনিয়র কনসালটেন্টের পদ শূন্য। জেলা হাসপাতালে ৬৫ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৮ শতাংশ মেডিকেল অফিসার বা সহকারী সার্জনের পদ শূন্য।
এই সংকটের মধ্যে পদ শূন্য থাকার পাশাপাশি চিকিৎসকদের মধ্যে আছে পদোন্নতি বঞ্চনাও। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে প্রায় দীর্ঘ ৩ বছর পদোন্নতি না হওয়ার পর গত

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সহকারী, সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন চাওয়া হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে। প্রায় ৮০টি বা ততোধিক বিষয়ে প্রায় ৪ হাজার ৫শ জন যোগ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এতে আবেদন করেন। শুধু গাইনিতেই আবেদন করেছেন ৯১৩ জন। এরপর দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষ করে বেশ কিছু বিষয়ে সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক এবং কনসালটেন্ট পদে পদোন্নতি দেয়া হয়, যা আবেদনের তুলনায় খুবই সামান্য।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজগুলোতে অধ্যাপকসহ দুই উচ্চপদে চিকিৎসক ও শিক্ষক সংকট রয়েছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও অবস, পেডিয়াট্রিকস এবং অর্থপেডিকস বিভাগে মোট ৩৬৮টি অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদ শূন্য।
এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদোন্নতিজনিত সমস্যার ফলে সিনিয়র পদগুলোতে সংকট দেখা দেয়। অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েও পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি জুনিয়রদের সময়মতো পদোন্নতি হয়ে গেলে এই সংকট কাটিয়ে উঠা সহজ হবে।
চিকিৎসক সংকট এবং পদোন্নতি বঞ্চনা নিরসনে ‘পদের অতিরিক্ত পদায়নের’ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি)। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ ভোরের কাগজকে বলেন, ক্রমবর্ধমান রোগীর উন্নত চিকিৎসাসেবা ও মেডিকেল কলেজে শিক্ষার মান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। যেহেতু পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সব বিষয়ে সহকারী, সহযোগী অধ্যাপক ও কনসালটেন্ট পদে ‘পদের অতিরিক্ত পদায়নের’ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা না হলে যোগ্য প্রার্থীর পদোন্নতিবিহীন কাজের ফলাফল স্বরূপ স্বাস্থ্য খাতে তাদের কাজের প্রতিফলনে হতাশার ছাপ সুস্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলবে অদূর ভবিষ্যতে।
সংকট কাটাতে আরো ৬ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের জন্য জরুরিভিত্তিতে প্রস্তাব দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও গবেষণা পরিচালক ডা. আফরিন মাহমুদ। ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলমের অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবনাটি পাঠানো হয়। প্রস্তাবনায়, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে সহকারী সার্জন পদে নিয়মিত বিসিএস ছাড়াও ৩ ধাপে বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে ২ হাজার করে মোট ৬ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও গবেষণা পরিচালক স্বাক্ষরিত প্রস্তবনার শুরুতে বলা হয়েছে, বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিকিৎসক সংকট নিরসন, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নসহ নানাবিধ কারণে ৬ হাজার জন চিকিৎসক নিয়োগের প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবনার পক্ষে মোট ৭টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো হলো- দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ, ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ, বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতালসমূহকে জেলাভেদে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ কার্যক্রম চলমান আছে। ওই কার্যক্রম শেষ হলে সেবা প্রদান অব্যাহত রাখতে চিকিৎসক (এমবিবিএস ও বিডিএস) নিয়োগ প্রয়োজন। বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প, ৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। পরবর্তী সময় স্বাস্থ্যসেবা চলমান রাখতে আরো চিকিৎসক (এমবিবিএস ও বিডিএস) নিয়োগ প্রয়োজন। ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ এর লক্ষ্য অর্জন এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করণে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য জনবল নিয়োগ প্রয়োজন। প্রতি বছর সরকারি চিকিৎসকের একটি অংশ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে অধ্যয়নরত থাকেন। তাই প্রান্তিক সেবাকেন্দ্র, উপজেলা ও জেলাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক সরকারি চিকিৎসক অবসর গ্রহণ করে থাকেন। যা প্রতিনিয়ত চিকিৎসক শূন্যতা তৈরি করছে। ৩৯তম ও ৪২তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলেও এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তা যথেষ্ট নয়। ৩৯তম ও ৪২তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরপরও প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য সরকারি চিকিৎসক অত্যন্ত অপ্রতুল।
চিকিৎসক নিয়োগ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম জানান, চিকিৎসক সংকট কাটাতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রীর নির্দেশে পিএসসিতে একটি চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে। ৬ হাজার চিকিৎসকের চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে। তবে এই নিয়োগ ধাপে ধাপে হবে। ৪২তম স্পেশাল বিসিএসে বেশ কিছু চিকিৎসক এখনো নিয়োগের অপেক্ষায়। সেখান থেকেও কিছু চিকিৎসক নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সেটিও পর্যায়ক্রমে নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়