নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী : ব্রডকাস্ট জার্নালিজম গণমাধ্যমের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়েছে

আগের সংবাদ

বাংলাদেশের পাশে থাকবে ফ্রান্স : শেখ হাসিনা-ম্যাক্রোঁ বৈঠক, দুই চুক্তি স্বাক্ষর , মানবাধিকার সুরক্ষা কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট ফ্রান্স

পরের সংবাদ

সাইডলাইন কূটনীতিতে বাজিমাত : সম্মানিত করেছে ভারত, চাপমুক্ত সরকার > পঞ্চবটীতে ভূ-রাজনীতির নতুন সমীকরণ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : দিল্লির ভারত মন্ডপমে জি-টোয়োন্টির ছিল দৃশ্যমান সম্মেলন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাড়ি ‘পঞ্চবটী’তে হয়ে গেল ভূ-রাজনীতির নতুন সমীকরণ। এখানেই হয়েছে হাসিনা-মোদি ও মোদি-বাইডেন বিশেষ বৈঠক। যেন আগে থেকেই অঙ্ক কষে রাখা, জি-টোয়েন্টির মঞ্চ হবে হাসিনা-মোদির। সবমিলিয়ে ভারত মন্ডপমের কারুকার্য দেখে যেমন বিষ্মিত হয়েছেন; তেমনি শেখ হাসিনার কৌশলের খেলায় মুগ্ধ হয়েছেন জি সম্মেলনে যোগ দেয়া নেতারা। সেখানে যেন বিশ্ব নেতাদের মধ্যমণি রূপে আবির্ভূত হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রসঙ্গত, সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রবিবার বিকালে নয়াদিল্লি থেকে দেশে ফিরেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সদস্য না হয়েও ভারতের আমন্ত্রণে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সম্মেলনের মঞ্চ বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। সেইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে কিছুদিন ধরে চলা টানাপড়েন নিরসনেও বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোটের এই সম্মেলন রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পাশাপাশি সাইডলাইনে সৌদি আরবের যুবরাজ, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গেও কথা হয়েছে তার। এর ফলে বাংলাদেশ অনেকটা চাপমুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। সবই এই সম্মেলনের কারণে হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি এই সম্মেলন থেকে ভারতও ব্যাপক লাভবান হয়েছে। এ কারণে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘ডিপ্লোম্যাসি’র পরিবর্তে লিখেছে ‘জি-২০ হলো মোদিপ্লোম্যাসি’। যার পুরো অংশজুড়েই শেখ হাসিনা। কারণ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিয়ে ‘সাইডলাইন কূটনীতি’তে পুরো আলো কেড়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি দিল্লিতে ‘গেøাবাল সাউথের একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ’ হিসেবেও বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব আনাম খানের মতে, সার্বিকভাবে বললে এ সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই প্রতিভূত হবে। ব্রিকস ও জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। বৈশ্বিক নেতৃত্বও এটি অনুধাবন করছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন দৃষ্টি আছে; ঠিক তেমনি বাজার ও বাণিজ্যের দিকেও তাদের দৃষ্টি রয়েছে। সবদিক থেকেই বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছে। একে বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাবে,

সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সম্মেলনই দেখিয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সেলফি কূটনীতি’ ব্যবহার করে কীভাবে মার্কিন চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার কৌশল নিয়েছেন। তাদের মতে, শেখ হাসিনাকে তুলে ধরার জন্যই যেন এই আয়োজন করা হয়েছে। সদস্য না হয়েও পুরো সম্মেলনজুড়ে শেখ হাসিনার মূল্যায়ন। শনিবার রাতে রাষ্ট্রপতির নৈশভোজে বারবারই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে জো বাইডেনসহ বিশ্ব নেতাদের কথা বলার দৃশ্য নজর কেড়েছে।
সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের মতে, জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং সম্মেলনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বাংলাদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় কূটনৈতিক অর্জন। পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রী একান্তে কথা বলেছেন, সেখানে ভূ-রাজনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সবমিলিয়ে এখানে একটি বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক বিষয় যুক্ত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশই পরাশক্তিগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে। অনেক কৌশলের সঙ্গে সেই চাপগুলোকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই জায়গায় বাংলাদেশ আরো বেশি দর কষাকষি সুযোগ পেয়েছে। কারণ বাংলাদেশ শুধু জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ বা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকই করেনি, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। সব মিলিয়ে কূটনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশ যা বলেছে অন্যরাও সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা এ-ও বলেছেন, জি-টোয়েন্টিতে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশকে তিনটি সুবিধা দিতে পারে। প্রথমত, এই সফর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ গেøাবাল সাউথের স্বার্থ প্রচার করবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ আরো বেশি অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে কূটনৈতিক পরিধিকে আরো প্রসারিত করতে পারে। এছাড়া ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই জোটের সদস্যও হতে পারে। কারণ ঢাকা এরই মধ্যে গেøাবাল সাউথ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নারী উন্নয়ন প্রকল্পের সমর্থনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। এসব বিষয় দেশটির ভাবমূর্তি বাড়িয়েছে। এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ কূটনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করার পাশাপাশি কূটনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করার মাধ্যমে ‘সাইডলাইন কূটনীতি’তে দারুণ সক্ষমতা দেখিয়েছে।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকাকে কেন এই বছরের শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিশ্লেষকরা কয়েকটি কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং রপ্তানি বাজার। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ভারতের জন্য অপার সম্ভাবনাময়। এছাড়া দেশটির উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর কাছাকাছি। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানের কারণে অশান্ত উত্তর-পূর্ব এখন শান্তিতে। এর ফলে ভারত সহজেই তার উত্তর-পূর্বের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমন করে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থান করায় ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট নীতি’ বাস্তবায়নে সহজ হয়ে ওঠে। এছাড়া দেশটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট হওয়ায় এর আঞ্চলিক গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে তোলে। এসব ইঙ্গিত করে ভারতের তরফ থেকে জি-২০তে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভারত জি-২০-এর মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। এজন্য প্রতিবেশী এলাকায় ভারতের অবস্থানকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এ কারণে ঢাকার সমর্থন অপরিহার্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা তৈরি হলে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সা¤প্রতিক চাপের পরিপ্রেক্ষিতে কথোপকথক হিসেবে ভারত কাজ করেছে। সাইডলাইন কূটনীতির ব্যবস্থা করে দ্বিপক্ষীয় পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভালো মিথষ্ক্রিয়া হয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী গ্রুপ অব টোয়েন্টি বা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশকে অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ করা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ভারত বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে। একইসঙ্গে ভারতের অঙ্গভঙ্গি বাংলাদেশের জন্য বেশ সম্মানের বলেও জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারতীয় বার্তাসংস্থা এএনআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সম্মেলনের পুরো সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে উৎসাহিত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর ফলে আমরা খুব গর্বিত এবং প্রধানমন্ত্রীও (শেখ হাসিনা) উল্লেখ করেছেন, ভারত আমাদের অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের সম্মানিত করেছে এবং আমরা ভারতের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের সম্মান দিয়েছে এবং একইসঙ্গে গেøাবাল সাউথের সমস্যাগুলো উত্থাপন করার জন্য সুযোগও দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ বিশেষ করে গেøাবাল সাউথের সমস্যাগুলো উত্থাপন করে আসছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনে নেতা, আমরা নারীর ক্ষমতায়নে নেতা, আমরা দুর্যোগ মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী সেই বিষয়গুলোকে জি-২০ নেতৃত্বের সামনে তুলে ধরেছেন।
এর আগে শুক্রবার ভারতে পৌঁছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একই দিন নয়াদিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেন। পরে দুই দেশ ডিজিটাল পেমেন্ট মেকানিজমের ক্ষেত্রে সহযোগিতাসহ তিনটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রকল্প ২০২৩ থেকে ২০২৫ এবং দুই দেশের মুদ্রার বিনিময় সহজতর করা নিয়ে ওই তিনটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও শেখ হাসিনা ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (সিইপিএ) বিষয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য উন্মুখ ছিলেন। এছাড়া বৈঠকে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও সংযোগ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক ও জনগণের মধ্যে সংযোগসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পূর্ণ পরিসর নিয়ে দুই নেতা আলোচনা করেন। এছাড়া সা¤প্রতিক আঞ্চলিক নানা ঘটনা এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতার মতো ইস্যুগুলো নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়