রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় দুজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু

আগের সংবাদ

সিসিক মেয়রের প্রতি প্রধানমন্ত্রী : মেয়র নয়, সেবক হিসেবে কাজ কর

পরের সংবাদ

মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই : নতুন উদ্যোগে আশার আলো

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান : ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানেও দেশে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে আসেনি। উল্টো দিন দিন বাড়ছে নিত্যনতুন সব মাদকের চোরাচালান। সেই সঙ্গে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যাও। বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, যতদিন দেশে মাদকের চাহিদা থাকবে, ততদিন মাদকের চালান বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়া মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। মাদকদ্রব্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের তথ্যমতে, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০-৯০ লাখ। চালু থাকা মাত্র ৩৬২টি নিরাময় কেন্দ্রে তাদের চিকিৎসা করাতে গেলে কয়েক দশক লেগে যাবে। সেই সঙ্গে নিরাময় কেন্দ্রগুলোর মান, চিকিৎসার নামে অতিরিক্ত টাকা নেয়া, নির্যাতনের অভিযোগের কারণে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে।
তবে নিরাময় কেন্দ্র ঘিরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) নতুন নতুন উদ্যোগ দেখাচ্ছে আশার আলো। বিশেষ করে প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয়

পর্যায়ে মাদক নিরাময় কেন্দ্র তৈরি,

নিরাময় কেন্দ্রে কর্মরতদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া, নজরদারি জোরদার, মাদকের চিকিৎসা নিলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থায় গতি আনা ও অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ মাদক নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশব্যাপী শুরু হতে যাওয়া কমপ্রিহেনসিভ অ্যাকশন প্ল্যান (সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা) এই কর্মযজ্ঞে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তখন একদম গ্রামপর্যায় থেকে মাদকাসক্ত খুঁজে মাদকাসক্তির স্টেজ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হবে। এতে করে কমবে মাদকসেবীর সংখ্যা। অর্থাৎ মাদকের চাহিদা ধীরে ধীরে কমিয়ে প্রত্যাশার জায়গায় আনা যাবে।
দেশে ৩৬২ নিরাময় কেন্দ্রে বেড ৫০২৫ : ডিএনসি সদরদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার তেজগাঁওয়ে ১২৪ বেডের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে রয়েছে ২৫ বেডের বিভাগীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। দেশের ৪৫টি জেলায় বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। ১৯টি জেলাতে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নেই। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে দেশের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৬২টি- যেখানে মোট বেড সংখ্যা ৫ হাজার ২৫টি। এর মধ্যে বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রের বেড রয়েছে ৪ হাজার ৮৪৬টি।
এর মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৮১ নিরাময় কেন্দ্রে বেড রয়েছে ২ হাজার ৫৯৭, চট্টগ্রামে ৪৪ কেন্দ্রে ৫৬৫, খুলনায় ১৭ কেন্দ্রে ২১৫, রাজশাহীতে ৫৫ কেন্দ্রে ৬৪৮, বরিশালে ৮ কেন্দ্রে ১৮০, রংপুরে ১৭ কেন্দ্রে ২৩০, ময়মনসিংহে ২৪ কেন্দ্রে ২৮০ এবং সিলেটে ১২ কেন্দ্রে সবচেয়ে কম ১৩০টি বেড রয়েছে।
চিকিৎসা নিয়েছে ৩ লাখ মাদকাসক্ত : পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাপ্রাপ্ত মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৩০ জন। আর বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা পাওয়া রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৯১ জন। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট চিকিৎসা নিয়েছে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৯২১ জন।
১৯ জেলায় নিরাময় কেন্দ্র নেই : ডিএনসির দেয়া তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশের ১৯টি জেলায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। জেলাগুলো হলো- শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বাগেরহাট, মাগুরা, নড়াইল, মেহেরপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট। আর বিভাগীয় পর্যায়ে সরকারিভাবে সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুরে এখনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র করা হয়নি।
নিরাময় কেন্দ্রে দেয়া হয় আর্থিক অনুদান : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মান বাড়াতে নিয়মিতই দেয়া হচ্ছে আর্থিক অনুদান। ডিএনসির পক্ষ থেকে ২০১৯-২০১০ অর্থবছরে ৯১টি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি টাকা, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে দেড় কোটি টাকা, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৪০ প্রতিষ্ঠানকে দেড় কোটি টাকা, সবশেষ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৮২ প্রতিষ্ঠানকে আড়াই কোটি টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
কারিকুলাম প্রশিক্ষণ পেয়েছে ২২০৪ মাদকাসক্ত : মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে কলম্বো প্ল্যানের আওতায় মাদকাসক্তি চিকিৎসা পাঠ্যক্রম বেসিক লেভেল কারিকুলামের ওপর ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬০টি ব্যাচে ২২০৪ জন প্রশিক্ষণার্থীকে (মাদক নিরাময় চিকিৎসা নেয়া) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফাইড এডিকশন প্রফেশনাল (আইক্যাপ-১) সনদ পেয়েছেন ৫২ জন।
নিরাময় কেন্দ্রে হচ্ছে ডোপ টেস্ট : রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ডিএনসির ৯৪৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারীসহ অন্যান্য সরকারি ও আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ৬ হাজার ৭৮০ জনের ডোপ টেস্ট করা হয়েছে। এদের মধ্যে যাদের মধ্যে মাদকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, তার তথ্য অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে।
মাদকে ফেরে ৮০ শতাংশ চিকিৎসা নেয়া রোগী : ডিএনসির সাবেক ডিজি মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, মাদক নিরাময় চিকিৎসার কনসেপ্ট আমাদের দেশে খুব বেশিদিন আগে গড়ে ওঠেনি। একসময় বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে চিকিৎসা দেয়া হতো। এখনো এমনটি হচ্ছে না, সেটি বলব না। তবে সময়ের সঙ্গে নিরাময় কেন্দ্রের মান বেড়েছে। এরপরও নানা কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ মাদকাসক্ত চিকিৎসা নেয়ার পরও মাদকের পথে ফিরে আসে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে অধিদপ্তর যে ইকো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সেটি আরো জোরদার করার বিকল্প নেই। পাশাপাশি পারিবারিক চিকিৎসা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সরকারি নিরাময় কেন্দ্রের বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে।
নতুন উদ্যোগে পাল্টে যাবে দৃশ্যপট : ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবদুল ওয়াহাব ভূঞা ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়নে এবং মাদকাসক্তিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মাদকের চাহিদা, সরবরাহ ও ক্ষতি হ্রাসে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। বিভিন্ন সংগঠন থেকে বলা হচ্ছে- দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ। এটি কীভাবে তারা জরিপ করেছে আমার জানা নেই। আমাদের পক্ষ থেকে যে জরিপ চলছে তাতে মাদকাসক্তের সংখ্যা অনেক কম বলে মনে হচ্ছে। তবে সংখ্যা যেমনটাই হোক, এটি নিরাময়ে মাদকাসক্তের পরিবারসহ সবারই উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, মাদকের তিনটি স্টেজ রয়েছে (প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি)। সব মাদকাসক্তের কিন্তু চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। যার চিকিৎসার প্রয়োজন, তার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। মাদকাসক্তের স্টেজ বুঝে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। এজন্য একটি কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ বিভাগীয় পর্যায়ে আরো ৩টি নিরাময় কেন্দ্র আমাদের রয়েছে। কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্র ২৫০ বেডে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে ২০০ বেডের ও জেলায় ১০০ বেডের নিরাময় কেন্দ্র হবে। পাশাপাশি ‘সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা’ যেটি আমরা শুরু করতে যাচ্ছি, সেটির আওতায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও নিরাময় চিকিৎসা দেয়া হবে। আর এই কাজটি হবে একদম গ্রামপর্যায় থেকেই। যার আসক্তির স্টেজ যে রকম, তাকে সে রকম চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হবে। তিনি আরো বলেন, দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংকট যাতে এই কার্যক্রমকে বাধা দিতে না পারে সেজন্য যারা নিরাময় কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের ইকো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ৯ মডিউলে দেয়া এই প্রশিক্ষণ অনুসরণ করলে আর সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিএনসি ডিজি বলেন, যারা মাদক ছেড়ে আলোর পথে আসবে, তাদের জন্য আমরা নানারকম প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকি। এজন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে।
মাদক নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে মো. আবদুল ওয়াহাব ভূঞা বলেন, প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে একটি কমিটি থাকে। ওই কমিটি নিয়মিত নিরাময় কেন্দ্র মনিটর করে। পাশাপাশি আমরাও করে থাকি। যদি কোনো নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়, তাৎক্ষণিক আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদের পক্ষ থেকে একটিই আহ্বান, পরিবারে মাদকাসক্ত থাকলে চিকিৎসা করান, নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে আমাদের জানান। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরও ৬টি নিরাময় কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়