পেঁয়াজ-সবজির দামে স্বস্তি, মাছ চড়া

আগের সংবাদ

ভোটের জন্য প্রস্তুত খুলনা কার ভাগ্যে ছিঁড়বে শিকে

পরের সংবাদ

বিপাকে রোহিঙ্গারা, বিপাকে বাংলাদেশ : ভূ-রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে কমল খাদ্য সহায়তা > এক বেলা খাবারের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ কমে ৯ টাকা

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার গতি তো নেইই; উল্টো রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। হঠাৎ খাদ্য সহায়তা কমে যাওয়ায় নতুন এক সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঠিকঠাকমতো খাবার না পেলে রোহিঙ্গাদের কারণে পুরো পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে। এতে পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। প্রসঙ্গত, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। তারা প্রায় ছয় বছর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাস্তুচ্যুত হয়ে পালিয়ে এসেছিল।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশ দরাজ প্রশংসা পেয়েছিল; সেই বিশ্ব সম্প্রদায়ই যেন রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে শাস্তির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা দিয়েছে, নিরাপত্তার জন্য পুলিশ দিয়েছে। কথা ছিল- বাংলাদেশ আশ্রয় দিলেও খাদ্য দেবে বিশ্ব সম্প্রদায়। কিন্তু এখন এটিও তারা বাংলাদেশের ঘাড়ে তুলে দিয়েছে। তহবিল স্বল্পতার অজুহাতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। তবে এই ঘোষণার নেপথ্যে ‘ভূরাজনীতির খেলা’ রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। সবমিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ‘সুবিধার’ নয় বলেও আশঙ্কা তাদের। প্রসঙ্গত, গত ১ জুন থেকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি রোহিঙ্গাদের জন্য জনপ্রতি মাসিক খাদ্য বরাদ্দ ১০ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলার করেছে। এর আগে ১২ ডলার থেকে কেটে ১০ ডলার করা হয়েছিল। দেখা গেছে, প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৫ টাকা হিসেবে ৮ ডলারে একজন রোহিঙ্গা পাবেন মাসে সাড়ে ৮শ’ টাকারও কম। এই সাড়ে ৮শ টাকাকে প্রতিদিন তিন বেলা খাবার হিসাবে ভাগ করলে ‘মিল’ (এক বেলা খাবার) প্রতি বরাদ্দ দাঁড়ায় ৯ টাকার মতো।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরিস্থিতির চাপে ঘাটতি খাদ্যের পুরোটাই বহন করতে হবে বাংলাদেশকে। এতে দেশটি চরম খাদ্য ঘাটতিতে পড়তে পারে বলে জানা গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করতে আজ বেলা ৩টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকে বসছেন সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের’ সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমবিষয়ক এই সভা হবে। উপস্থিত থাকবেন জননিরাপত্তা বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট পদস্থ কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদেরও উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. কামরুল হাসান বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে ভোরের কাগজকে বলেন, ডব্লিউএফপি রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্যসহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। ঘাটতি সহায়তা বাংলাদেশকে পূরণ করতে বলা হয়েছে। আমরা তাতে সম্মতি দিইনি। তাদের চিঠি দিয়ে বলেছি, রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব সম্প্রদায়ের। খাদ্যসহায়তা কমানো নয়; বরং বাড়ানো উচিত। এ রকম পরিস্থিতিতে কী হয়, তা সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের ফলে আরো বেশি রোহিঙ্গা কাজ খোঁজার জন্য মরিয়া পদক্ষেপ নেবে। এতে তারা নানা ফাঁকফোকর দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর কাজ না পেলে নানা অপকর্ম ঘটাতে পারে- এতে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতে পারে। এছাড়াও তীব্র পুষ্টিহীনতায় পড়বে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নেবে। তাদের বেপরোয়া আচরণ বাড়বে। মারামারি, খুনোখুনিসহ অসন্তোষ ও অরাজকতা বাড়বে। ক্যাম্পে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার পাশাপাশি অসামাজিক কার্যকলাপ বহুগুণে বাড়বে। একপর্যায়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এমনিতেই কাজ ও খাদ্যের জন্য রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে বিপজ্জনকভাবে নৌকা যোগে পাড়ি দিচ্ছে। ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮ বছর বয়সি শরণার্থী আরিফ উল্লাহ বলেন, বিদ্যমান খাদ্য ভাতাই যথসামান্য ছিল। এখন এটি আরো ছাঁটাই করার ফলে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব? মোহাম্মাদ রেজুয়ান খান নামের একজন রোহিঙ্গা বলেছেন, পরিস্থিতি নি¤œমুখী হতে থাকলে তাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য চুরি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তিনি বলেন, জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা তাদের অনাহারে ঠেলে দিয়েছে। রেশন কাটার কারণে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবিলম্বে

প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ শরণার্থীরা বেঁচে থাকার জন্য সহায়তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে।
এর আগে গত সপ্তাহে শরণার্থী শিবিরে চারদিনের পরিদর্শনের সময় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ডেপুটি হাইকমিশনার কেলি টি ক্লেমেন্টস বলেন, শরণার্থীরা তাদের মৌলিক চাহিদার জন্য মানবিক সহায়তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তবে, এই সহায়তার জন্য ন্যূনতম তহবিল আর পাওয়া যায় না। এর ফলে সহায়তা কমাতে হচ্ছে।
জানা গেছে, মানবিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য এ বছর ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বেশি আবেদন করেছে। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মাত্র ২৪ শতাংশ অর্থায়ন করা হয়েছিল। এদিকে ক্রমবর্ধমান অপরাধ, কঠোর জীবনযাপন এবং মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা আরো বেশি রোহিঙ্গাকে নৌকায় করে বাংলাদেশ ছেড়ে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে প্ররোচিত করছে। ফলে তাদের জীবন আরো ঝুঁকির মুখে পড়ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সমুদ্রে ৩৪৮ জন রোহিঙ্গা মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর তহবিল কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোও রোহিঙ্গাদের প্রতি ক্রমশ বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা শিবিরের শরণার্থী মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের অবস্থা কেবল খারাপ হচ্ছে। আমাদের এখানে কি ভবিষ্যৎ আছে- প্রশ্ন তাহেরের।
জানা যায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা শুরু করলে তাদের জন্য খাদ্য, পুষ্টিসহ অন্যান্য অতি জরুরি সহায়তা দিয়ে আসছে ডব্লিউএফপি। দাতাগোষ্ঠী ও অংশীদার সংস্থাগুলোর সহায়তায় এই জরুরি সহায়তা দেয়া হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা থাকলেও বাস্তবে এ সংখ্যা ১১ লাখের ওপরে। সবাইকে ভাউচারের মাধ্যমে প্রতি মাসে ১২ মার্কিন ডলার সমমূল্যের খাদ্যসহায়তা দেয়া হতো। এই ভাউচার ব্যবহার করে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো সব ক্যাম্পে অবস্থিত ডব্লিউএফপির আউটলেট থেকে খাবার বেছে নিতে পারে। কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তহবিল ঘাটতির কারণে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্য সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে জাতিসংঘ। ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে ডব্লিউএফপি খাদ্যসহায়তা কাটছাঁট করছে। একইভাবে গত মার্চে ডব্লিউএফপির ১২ ডলারের খাদ্যসহায়তার পরিমাণ কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়। রোহিঙ্গা সংকটের প্রায় ৬ বছর পর প্রথমবার কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে আনে সংস্থাটি। মাত্র তিন মাসের মাথায় একই কারণে আবারো গত ১ জুন থেকে ১০ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলার করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের দৈনিক রেশনের ৩৩ শতাংশ কমবে। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের প্রত্যেককে মাত্র ৮ ডলার (৮৪০ টাকা) সমমূল্যের ফুড ভাউচার দেয়া হবে প্রতি মাসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জাপান সফরকালে এনএইচকে টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জ্বালানি ও খাদ্যের খরচ বেড়েছে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়