করমণ্ডল এক্সপ্রেস : চেন্নাইগামী ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত শতাধিক, বাংলাদেশি যাত্রী থাকার আশঙ্কা

আগের সংবাদ

দেয়াল

পরের সংবাদ

সিগন্যালের ভুলেই দুর্ঘটনা : শোকে কাতর পুরো ভারত > তিন ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ২৮৮, আহত সহস্রাধিক

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ ডেস্ক : ‘তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন আমার উপড়ে এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ে। কোনোভাবে সেখান থেকে বের হয়ে দেখি অনেকে আটকে আছে বেশকিছু কোচের নিচে, যাদের গগনবিদারী আর্তনাদ আর চিৎকার কেবল চারদিকে।’ কথাগুলো ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী স্বপন কুমারের। তার মতো অনেকে ভয়াবহ সেই মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন গত শুক্রবার রাতে। সারি সারি লাশ আর অন্ধকারে ভেসে আসা আর্তনাদে ভড়কে গেছেন উদ্ধার কাজে হাত বাড়ানো ব্যক্তিরাও। ভারতের ওড়িশা রাজ্যে ৩টি ট্রেনের পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ২৮৮ জন নিহত হয়েছেন। আরো প্রায় ১০০০ জন আহত বলে জানিয়েছে বিবিসি। তাদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৫৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কারণ সিগন্যাল ব্যবস্থায় বড়সড় ত্রæটি। বিভাগীয় তদন্তের পর প্রাথমিকভাবে গতকাল শনিবার এমন রিপোর্টই জমা পড়েছে দেশটির রেল কর্তৃপক্ষের কাছে। রেল সূত্রে জানা গেছে, ওই রিপোর্টে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, সেখানে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য সমস্ত দায় চাপানো হয়েছে সিগন্যাল ব্যবস্থা ওপরে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এই লাইনে সিগন্যাল ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ‘রুট রিলে ইন্টারলকিং সিস্টেম’ এর মাধ্যমে। এর পুরোটাই স্বয়ংক্রিয়। তবে অতি বিশেষ প্রয়োজনে ‘ম্যানুয়ালি’ও এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেক্ষেত্রে নানাবিধ সতর্কতা মানতে হয় সংশ্লিষ্ট রেলকর্মীকে।
এই ‘রুট রিলে ইন্টারলকিং সিস্টেম’ এ বড়সড় ত্রæটির কারণেই দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস- যা পরে বেলাইন হয়ে পেছন থেকে ধাক্কা মারে বাহানগা বাজার স্টেশনের লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়িকে। একই সঙ্গে বেলাইন হওয়া করমণ্ডলের

কয়েকটি কামরা গিয়ে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে এবং বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের সঙ্গে পাশাপাশি সংঘর্ষ হয়।
ভারতের ইতিহাসে ভয়াবহতম এই ট্রেন দুর্ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে শোক প্রকাশ জানিয়েছেন ভারতের প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতিটি পরিবারকে ২ লাখ রুপি ও আহতদের ৫০ হাজার রুপি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি ও গুরুতর আহতদের ২ লাখ রুপি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দুর্ঘটনায় বাংলার যে সব মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তাদের পরিবারকে ৫ লাখ, গুরুতর আহতদের ১ লাখ এবং আহতদের ৫০ হাজার রুপি ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এদিকে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল শনিবার রাজ্যে একদিনের শোক পালন করা হয়।
এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের ওড়িশায় ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানিতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
দোষীদের কড়া শাস্তির ঘোষণা মোদির : বালাসোরের বাহানগা বাজারে ট্রেন দুর্ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, এটা দুঃখজনক ঘটনা। আহতদের চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি রাখবে না সরকার। খুবই গুরুতর ঘটনা এটা। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। দোষীদের কড়া শাস্তি দেয়া হবে।
শুক্রবার রাতেই রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল শনিবার সকালে নয়াদিল্লিতে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসেন তিনি। বৈঠকে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। এর পরেই তিনি হেলিকপ্টারে বালাসোরের উদ্দেশে রওনা দেন। রেলমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন তিনি। এরপর বালাসোর হাসপাতালে যান। সেখানে দুর্ঘটনায় আহতদের সঙ্গে দেখা করেন। কথা বলেন চিকিৎসকদের সঙ্গেও।
দুর্ঘটনাস্থলে মমতা : দুর্ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গতকাল শনিবার হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। পরিস্থিতি নিজ চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে রেলমন্ত্রীকে পাশে নিয়ে সমালোচনা করে মমতা বলেন, ‘রেলের সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যাত্রীদের প্রতি রেলের আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ ছিল।’
যেভাবে ৩ ট্রেনের সংঘর্ষ : ৩টি ট্রেন- দুটি যাত্রীবাহী, একটি মালবাহী। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই ৩ ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনাস্থল পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে আর ওড়িশার ভুবনেশ্বর থেকে ১৭০ কিলোমিটার উত্তরে বালাসোরে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, প্রথমে করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে কাছে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি সেই মালগাড়ির উপরে উঠে যায়। ২৩টি বগির মধ্যে ১৫টি লাইন থেকে ছিটকে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে। সেই লাইন দিয়ে তখন আসছিল ব্যাঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগিগুলো গিয়ে পড়ে সেই লাইনের ওপর। ব্যাঙ্গালুরু-হাওড়া ট্রেনটির দুটি কামরাও তখন লাইনচ্যুত হয়।
শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। দুপুর ৩টার দিকে হাওড়ার নিকটবর্তী শালিমার স্টেশন থেকে ছাড়ে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস। এটি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ওড়িশার বালাসোরে পৌঁছায়, আধ ঘণ্টা পর বাহানগাঁ বাজারের কাছে ২৩ কামরার ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে।
ঘটনাস্থলে ট্রেনের ৪টি বগি কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কয়েকটি বগি একটি আরেকটির উপরে উঠেছিল। কিছু বগি বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মালবাহী ট্রেনের ওপরে একটি ট্রেনের ইঞ্জিন উঠে থাকতে দেখা যায়। রেললাইনসহ আশপাশের জায়গাগুলোয় ট্রেনে থাকা মানুষের জিনিসপত্র ছড়িয়ে রয়েছে। লাইনের পাশে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা সারি সারি মৃতদেহ। কিছুক্ষণ পরপর মৃতদেহগুলো গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রেনের বগির ভেতরে মানুষের স্যান্ডেল, কাপড় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উদ্ধারকাজ চলাকালে কয়েকজনকে পড়ে থাকা কাপড় ও দড়ির সাহায্যে টেনে বের করা হয়। দুর্ঘটনায় অনেকেরই হাত বা পা কাটা পড়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া কারো কারো জীবন বাঁচানোর জন্য হাত-পা কেটেও বের করতে হয়েছে।
করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী কৃষ্ণপদ বলেন, ‘মুহূর্তের মধ্যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার গায়ে তখন এসে পড়েছে আরো কয়েকজন। দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বুঝলাম, আমাদের কামরাটি উল্টে গিয়েছে পুরো। দুর্ঘটনায় পড়েছি।’
কলকাতার হাওড়া থেকে দ্রুতগামী এই ট্রেনে উঠেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এই বাঙালি, যাচ্ছিলেন চেন্নাই। দুর্ঘটনার বর্ণনায় কৃষ্ণপদ বলেন, ‘হঠাৎই বিকট একটা ঝাঁকুনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কামরা এক দিকে হেলে পড়তে থাকে। এস-৪ কামরা এতটাই কাত হয়ে যায় যে খোলা দরজা গলে বাইরে পড়ে যান দু’তিন জন। ওদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি। বুঝতে পারছি, আমিও হেলে পড়ছি খোলা দরজার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোহার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যায়। আমি গিয়ে পড়ি সেই দরজার উপর। এক মুহূর্ত আগে পড়লে আমিও ট্রেন থেকে বাইরে পড়ে যেতাম। কী বাঁচা যে বেঁচেছি, তা শুধু আমিই জানি।’
তিনি বলেন, ‘সেই মুহূর্তে চার দিক থেকে কেবল চিৎকার আর আর্তনাদের শব্দ। হঠাৎ খেয়াল হলো, কাকা কোথায়? খুঁজতে যে যাব, তারও উপায় নেই। কাঁধে, হাতে, পায়ে, কপালের কোণে চোট পেয়েছি। আর যেভাবে পড়ে আছি, একা ওঠার সাধ্য নেই।’
৩টি কোচে ২৬ জনের একটি বড় দলের সঙ্গে কেরালার দিকে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ আকিব, তাদের দলের বেশির ভাগই ছাত্র। আকিব বলেন, ‘আমরা এস-৪, এস-৩, এস-২ কোচের ভেতরে ছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এরপর কোচগুলো উল্টে যায়। তবে আমরা সবাই নিরাপদ ছিলাম।’
মৃতদেহ বের করতে ব্যবহার হয় ‘গ্যাস কাটার’ :
উদ্ধারকাজ চালাতে ও আহতদের চিকিৎসায় ভারতের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়। দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে রাতভর অভিযান চালান উদ্ধারকারীরা। দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ৩টি ট্রেনের বগির নিচে আটকে পড়া মানুষদের বের করে আনতে ওয়েল্ডিং গ্যাস কাটার ও ইলেকট্রিক কাটার ব্যবহার করা হয়।
ভুবনেশ্বরের কর্মকর্তারা বলেন, ১ হাজার ২০০ মানুষ উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। পাশাপাশি ২০০টি অ্যাম্বুলেন্স, ৫০টি বাস এবং ৪৫টি মোবাইল হেলথ ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করেছে। ট্রাক্টরসহ সব ধরনের যানবাহন ব্যবহার করে মৃতদেহগুলো হাসপাতালে নেয়া হয়।
ছিল না সংঘর্ষ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ‘কবচ’ : দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও সিগন্যালের সমস্যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই রুটে ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ‘কবচ’ ব্যবহার করা হতো না। রেলওয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা জানান, কবচ সিস্টেমটি এই রুটে নেই। বর্তমানে দিল্লি-হাওড়া এবং দিল্লি-বোম্বে রুটে কবচ স্থাপন করা হচ্ছে।
ভারতের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ ঠেকাতে ‘কবচ’ সিস্টেমটি স্থাপন করা হচ্ছে। যখন কোনো ট্রেন ভুলবশত সিগন্যাল পার করে ফেলে, তখন কবচ ওই ট্রেনের চালককে সতর্ক করে। এই কবচ সিস্টেম ট্রেনের চালককে সতর্ক করতে পারে, ট্রেনের ব্রেকের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং নির্দিষ্ট দূরত্বে আরেকটি ট্রেনের উপস্থিতি টের পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থামাতেও পারে। ভারতের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ২ হাজার কিলোমিটার পথে এই কবচ সিস্টেম স্থাপন করার কাজ চলছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়