‘প্রস্তাবিত বাজেট তামাকমুক্ত দেশ গড়ার অন্তরায়’

আগের সংবাদ

রাজনীতির ছায়ায় ব্যবসার জাল : জামায়াতের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক দেশ জুড়ে বিস্তৃত, গোপনে চলছিল সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, এবার প্রকাশ্যে মাঠে নামার হুংকার

পরের সংবাদ

দেয়াল

প্রকাশিত: জুন ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেদিন আবার লুনাদের দোতলা বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলাম। আকাশি রঙের ছিমছাম বাড়ি, পুরান আমলের একটা ধাঁচ আছে। যে বাড়িতে একসময় আমার আনাগোনা ছিল, সে বাড়ি এখন লুকিয়ে দেখতে হয়। কেউ কারণ জানতে চাইলে বলব- আসুন, এক কাপ চা খাওয়া যাক। বড় লম্বা ইতিহাস! শুনতে শুনতে ক্লান্তি আসতে পারে।
লুনার সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় ৬ বছর আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শেষদিনে যখন ফি হাজারখানেক টাকা বেড়ে যাওয়ার কথা শুনে বাড়িতে ফোন দিচ্ছিলাম, তখন নীল জামা পরা একটা মেয়ে সামনে এসে ২টা পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল। আমি চুপচাপ গিয়ে ফি জমা দিয়ে এসে দেখি লুনা গেটের পাশে দাঁড়ানো। ‘তোমার নাম কী? তোমার মোবাইল নম্বরটা দিলে রাতের মধ্যে টাকা পাঠিয়ে দেব।’ আমি বললাম।
‘আমি লুনা। সম্ভবত আমরা একই বিভাগের শিক্ষার্থী। আর টাকা পরে দিলেও হবে। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই।’ শান্ত গলায় বলল মেয়েটি।
সপ্তাহ দুয়েক পরে আমাদের ক্লাস শুরু হলো। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। ক্লাসে লুনার একটা বিষয় আমরা খেয়াল করেছিলাম। সেটা হলো লুনা কথায় কথায় সবার ব্যাকরণগত ভুল ধরত। লুনা হলো পুরান ঢাকার মানুষ এবং আমার ধারণা ছিল ওখানকার মানুষের কথা বলার একটা নিজস্ব ধরন আছে। তাই ওর এই বিষয়টা ঠিক বিপরীতমুখী মনে হতো। আমাদের সবার এই ধারণা ভেঙে দিতেই হয়তো লুনা একদিন সবাইকে ওর বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে বসল।
লুনার বাড়িতে গিয়ে দেখি সেই এলাহি কারবার! লুনার বাবা-চাচার যৌথ পরিবার। দাদা-দাদি আছেন, যাদের এককথাই শেষকথা হিসেবে সবাই খুশি মনে মেনে নেন। লুনার মা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, ভারি জ্ঞানী মানুষ। দোতলা বাড়িটার নিচতলায় সবাই থাকে, আর উপরতলায় বিশাল ছাদ। লুনার ছোট বোন টুনা এসে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল।
টুনা : জানো, আপু তোমাদের সবার কথা অনেক বলে। বলে যে কেউ বেশি কথা বলে, কেউ বেশি খায়।
তৃপ্তি : বাহ্! কত সুন্দর প্রশংসা করে!
একটু পরে লুনা দুটি ট্রেতে নাস্তা নিয়ে এলো।
‘চল না! ছাদে যাই!’ তমা আগ্রহ সহকারে বলে উঠল।
লুনা : অবশ্যই যাবি। নাস্তা খাবি, তোর কড়া চা খাবি; তারপর না হয় যা।
তমা : বাহ্! আমাদের কত খেয়াল রাখিস!
তমার কথা শুনে লুনা হেসে দিল। আমাদের হৈচৈ শুনে লুনার ২ চাচাতো ভাই-বোন পাশে এসে বসল।
দুপুরবেলা বিশাল খাওয়া-দাওয়ার পর বিকালে আমরা ছাদে গিয়ে বসলাম। ছাদের রেলিং ঘেঁষে নানা ফুলের গাছের টব। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। যদিও আমি গোলাপ, গাঁদাসহ ২-৪টা ফুল ছাড়া আর কোনো ফুল দেখলে নাম বলতে পারি না, তবে লুনা সব ফুলের নাম একে একে বলে চিনিয়ে দিল।
লুনা : বড় যতœ নিয়ে সাজানো এসব ফুলের গাছ।
আমি : তা তো বোঝা যাচ্ছে। আচ্ছা, লুনা তোর বিয়ে হয়ে গেলে কী করবি? ফুলের গাছগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যাবি নাকি?
লুনা : ধুর! কী বলতে কী বলিস!
‘এই! দেখে যা তোরা!’ ফাহিমার ডাক শুনে আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখলাম বড় একটা নীল প্রজাপতি একটা ফুলে বসে আছে।
এরপর থেকে অবসরে আমরা প্রায়ই লুনার বাড়িতে গিয়ে গল্প করতাম। অবশ্য আমার বাসা কাছে হওয়াতে আমিই বেশি যেতাম। একটা মজার ঘটনা না বললেই নয়। এক ছুটির দিনে ঘুম থেকে উঠে কী মনে করে লুনার বাড়ি গিয়ে হাজির হই। বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় লুনার মা লুনাকে ছাদে ভেজা কাপড় মেলে দিতে বললেন। ঘরের কাজ আমি খুব একটা পারি না, কিন্তু আমিও বেশ আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘আমিও যাই, কাপড় মেলে দেই।’
লুনা : বসে টিভি দেখ, এই রোদের মধ্যে ছাদে আসার দরকার নেই।
‘কী যে মনে করিস? মনে করিস কোনো কাজ পারি না। দেখ, তোর আগেই কাজ শেষ করব।’ আমি দৃঢ়ভাবে বললাম। আমার কথা শুনে লুনা হাসল। তবে কাজটা করতে গিয়ে দেখি বেশ কঠিন! ভারী ভারী কাপড়গুলোর পানি চিপড়ে তারপর দড়িতে দেয়া। চাট্টিখানি কথা না! সুবিধা হবে ভেবে কাপড়সহ বালতি ছাদের রেলিংয়ে রাখলাম। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। বালতি হালকা হতেই রেলিং থেকে পড়ে গিয়ে নিচে রাখা ফুলের টবে পড়ল। টব ভেঙে একটা টুকরা গিয়ে নিচে দোলনায় বসে থাকা টুনার কপালে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে টুনার চিৎকার। পরিস্থিতি দেখে আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। আন্টি, টুনার কপালে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি কিছু বলার আগেই লুনা আমার দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নিল।
অবশ্য পরদিন লুনার এমন আচরণের কারণ জানতে চেয়েছিলাম।
: মাকে আমি চিনি। কিছুদিন বকবে, তারপর এই বিষয়টা ভুলে যাবে। এখন দোষ যদি তোর হয়, বকতে পারবে না, তাই ভুলতেও পারবে না। রাগ থেকে যাবে!
: বাহ্! তোর তো অনেক বুদ্ধি!
লুনা আমার কথা শুনে হাসল। বলল, ‘দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকলে আমরা কাছের মানুষ ভবিষ্যতে কী করতে পারে বা পারে না তা আন্দাজ করতে পারি।’
: তাই নাকি! আমি কী কী করতে পারি- বলতো! আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম। কিন্তু লুনা আমার কথা এড়িয়ে গেল। উত্তর জানা হলো না।
এভাবে দেখতে দেখতে কখন যে চারটা বছর পেরিয়ে গেল খেয়ালই করিনি। বন্ধুদের একেকজন একেক জায়গায় চলে গেল। কেউ চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, কেউবা বিয়েথা করে সংসারে মন দিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠল সবার সঙ্গে কথা বলার সহজ উপায়। কিন্তু একটা কথা আছে। যা কাছে আনে, তা দূরেও ঠেলে দেয়। ভাবছেন এমন কথা কেন বলছি? শুনুন তবে। একদিন ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে পুরনো সময় রোমন্থন করছিলাম। অবশ্য কখনো ভাবিনি যে এই কথাগুলোই শেষ কথা হবে।
তমা : নীরা তো শরীফ স্যারকে চকোলেট দিয়েছিলি।
মিলি : দেবে না, বুঝিসই তো!
তারপর দেখলাম কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে একেকজন একেক কথা বলে যাচ্ছে। একটা সময় আমি জবাব দিতে বাধ্য হলাম।
: বন্ধুদের, প্রিয় শিক্ষকদের, কাছের মানুষজনকে সামর্থ্যরে মধ্যে চকোলেট, বই, ফুল ইত্যাদি উপহার দিতে চেষ্টা করেছি। বাঁকা মন্তব্য করে তোরা সেই সম্পর্কের সম্মান নষ্ট করতে পারিস না। আমি স্পষ্ট ভাষায় জানালাম।
আমার ম্যাসেজ দেখে সবাই চুপ হয়ে গেল। তবে বন্ধুদের ওসব কথা ততটা কষ্ট দেয়নি, যতটা দিয়েছিল লুনার নীরবতা। লুনা একটাবারও প্রতিবাদ করল না। চুপ থেকে ওদের পাশে গিয়েই কি দাঁড়াল?
এ ঘটনার পর প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ। তবে মাঝে-মাঝে পুরান ঢাকায় অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে বিরিয়ানি খেতে যাই। লুনার বাড়ি সামনে পড়লে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাই, পাছে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
তো এতক্ষণ কথা শুনে আপনার মনে হয়তো আগ্রহ জাগবে। বলবেন- চলুন, বাড়িটা দেখে আসি। শুনুন তাহলে। এখন আর বাড়িটা নেই, সঙ্গে মানুষগুলোও হারিয়ে গেছে। আপনি অবাক হবেন। আর আমি কবে থেকেই নির্বাক। আসলে অফিসের কাজে ব্যস্ত বলে প্রায় ২ মাস ওদিকটায় যাইনি। আজকে যখন এলাম, তখন একই রাস্তা ধরে হেঁটেও কোনো আকাশি রঙের বাড়ি দেখলাম না। ভাবলাম মনের ভুল। কিন্তু না, ঠিকই দেখেছি। দেয়ালে নতুন সাদা রং, রাস্তা থেকে ছাদের ফুলের গাছগুলো দেখা যাচ্ছে না। কী মনে করে কলিংবেল বাজালাম। একজন অপরিচিত মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন।
: জি, কাকে চান? আমি প্রশ্নের মুখোমুখি।
: লুনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমার উত্তর।
: ভেতরে আসুন। দরজা পুরোপুরি খুলে দিয়ে আমাকে ড্রয়িংরুমে বসতে দিলেন।
: শুনুন, আমরা বাড়ির নতুন মালিক। গত মাসে বাড়িটা কেনা হয়েছে। ভদ্রমহিলা জানালেন।
: আগে যারা থাকত, তারা কোথায় গেছে? আমি জানতে চাইলাম।
: শুনেছি, ধানমন্ডিতে! তা যাই হোক, আপনি বসুন। নাস্তা খেয়ে যান। হাসিমুখে বললেন ওই মহিলা।
: না, এত কষ্ট করবেন না। তবে যদি কিছু মনে না করেন একটু ছাদে যেতে পারি।
: অবশ্যই পারেন। ছাদের দরজা খোলাই আছে। উত্তরে জানালেন তিনি।
আমি ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলাম। যেন সময় থামি-থামি করেও তীব্রগতিতে ছুটে যাচ্ছে। ছাদজুড়ে শুধু শূন্যতা। কোনো ফুলের গাছ নেই, নেই প্রজাপতি। দুটি ছোট বাচ্চা এক কোনায় বসে খেলছিল। আমাকে দেখে নাম জিজ্ঞেস করেই আবার খেলতে চলে গেল। আমি শেষবারের মতো রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। বিকালের পড়ন্ত সূর্য বড় সুন্দর।
নাহার আল্ রাজী : রমনা, ঢাকা-১০০০

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়