নারী ইউএনওকে কাদের সিদ্দিকীর বাধায় আসকের নিন্দা

আগের সংবাদ

৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচন : আ.লীগের গলায় ‘কোন্দল’ কাঁটা

পরের সংবাদ

রাজস্ব আদায়ে তিন বাধা : ভঙ্গুর অর্থনীতি, কর আদায়ে বৈষম্য, কর অব্যাহতি

প্রকাশিত: মে ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : বিশ্বে যেসব দেশ জিডিপির তুলনায় সবচেয়ে কম রাজস্ব আয় করে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। এরপরেও রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা কোনো বছরই পূরণ হয় না। বিগত বছরগুলোর মতো এবারো রাজস্ব ঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। এরপরও প্রতি অর্থবছরই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মোটা দাগে তিন কারণে রাজস্ব খাতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয় না। যেমন- ভঙ্গুর অর্থনীতি, কর আদায়ে বৈষম্যমুলক আচরণ এবং কর অব্যাহতি প্রক্রিয়া।
জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ভোরের কাগজকে বলেন, অনেক আগেই রাজস্ব খাতের সংস্কার করা উচিত ছিল, আইএমএফ আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে। কারণ, আমরাও চাই সামষ্টিক অর্থনীতি ভালো হোক। মোটা দাগে রাজস্ব আদায়ে তিন ধরনের বাধা রয়েছে। যে অর্থনীতি থেকে আমি রাজস্ব আদায় করব, তা প্রায়ই ভঙ্গুর থাকে। বর্তমানে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেমে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির, মানে আয়ও অনেকটা স্থবির।
তার মতে, রাজস্ব আদায়ে দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে পুরো অর্থনীতি এক ধরনের বৈষম্যের মধ্যে রয়ে গেছে। ট্যাক্স জিডিপি রেশিও দেখলেই তা অনুমেয়। অনেক সামর্থ্যবান লোক করের বাইরে রয়ে গেছে। বৈষম্য এবং সমস্যা দূর করার কোনো পদক্ষেপ না থাকার কারণে কর আসছে না। তৃতীয়ত, ম্যাক্রোঁ ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টেও গলদ রয়েছে। দেখা গেছে বড় বড় জায়গায় উন্নয়ণ হচ্ছে। কিন্তু কর মওকুফ করে দেয়া হচ্ছে। ফলে জিডিপি বাড়লেও কর বাড়ছে না। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান কর দেয় না। অর্থাৎ ম্যাক্রোঁ ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টে দুর্বলতা আছে। সরকার এসব জায়গাগুলোতে শৃঙ্খলা আনতে পারছে না।
তিনি বলেন, এনবিআরের উচিত রাজস্ব আহরণ ঘাটতির প্রকৃত কারণ রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরা। প্রয়োজনে

সরকারও এনবিআরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে। এনবিআর যদি রাজস্ব আহরণ তার ভূমিকা না রাখতে পারে, সেটাও জনগণকে জানানো দরকার। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী সংস্কারে ব্রত না হয়ে নিজ থেকেই রাজস্ব আহরণ বাড়াতে প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
সরকারের অভ্যন্তরীণ আয়ের সিংহভাগ যোগান দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। জনগণের দেয়া মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট, আয়কর এবং শুল্ক থেকেই আসে রাজস্ব। সরকারের এ আয় বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগের কথা বলা হয়ে থাকলেও কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়ছে না আয়। প্রশ্ন হচ্ছে কেন বাড়ছে না রাজস্ব আদায়? পলিসি সংস্কার, প্রশাসনের সংস্কার এবং সংস্কার বাস্তবায়ণ করা-এ তিন ধরনের বাধার কারণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয় না বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, রাজস্ব খাতে সংস্কার এখন অপরিহার্য হয়ে গেছে। কারণ, অর্থনীতির আকার গত এক দশকে যে হারে বেড়েছে, সেই হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। কর দেয়া সহজ হয়নি, করদাতার ভয় কাটেনি। আবার বছরের পর বছর কর অব্যাহতির সুবিধা নিয়ে দেশের বহু শিল্প খাতের বিকাশ হয়েছে। কর অব্যাহতির অপব্যবহারও হয়েছে। সংস্কারের উদ্যোগে আসে একশ্রেণির প্রভাবশালীর বাধা।
তিনি বলেন, আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কার করি, যেমন গত তিন বছর ধরে করপোরেট ট্যাক্স রেট কমানো হয়েছে। কিন্তু এর কোন মূল্যায়ন করি না। সুতরাং কোনো একটি সংস্কার করে তার মূল্যায়ন করতে হবে। কোথায় গলদ ছিল এটা চিহ্নিত করতে হলে অতীত অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, গত বছর একটি নতুন পলিসি দেয়া হলো, ৭ শতাংশ আয়কর দিলেই বিদেশে রাখা সম্পদ দেশে নিয়ে আসা যাবে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। এ পলিসির আমরা কোনো সুফল পাইনি। কুফল পেয়েছি কিনা সেটাও যাচাই করে দেখা দরকার ছিল। কারণ, দেশে টাকা থাকলে তার জন্য আমাকে দিতে হবে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স। কিন্তু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলে দিতে হবে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ আমরা একটি নীতি তৈরি করি কিন্তু তার মূল্যায়ন করি না। নীতির সংশোধনও করি না।
রাজস্ব আদায়ে অটোমেশনকে একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা অনেক বছর ধরেই অটোমেশনের কথা বলছি। বিভিন্ন সময়ে ভ্যাটের অটোমেশন, ইনকাম ট্যাক্সের অটোমেশন, কাস্টমসের অটোমেশনসহ অসংখ্য প্রকল্প এলো আর গেল। কিন্তু একটি পরিপূর্ণ অটোমেশন আর হলো না।
জানা গেছে, বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দিতে রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কারের শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সবচেয়ে বড় শর্ত হলো, আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। এ জন্য আগামী বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। আইএমএফ বলছে, পৃথিবীর যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম, বাংলাদেশ তার একটি। ফলে দেশটি প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারছে না।
আইএমএফ কর-জিডিপি অনুপাত এক বছরেই দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে বলেছে। এটা শুধু মুখে বললেই হবে না। এ জন্য করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে, করহারও বাড়াতে হতে পারে। আবার এত পরিমাণ শুল্ক কর ছাড় দিয়ে কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো কঠিন। শুল্ক কর ছাড় কমাতে গেলে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাধা আসবে। আবার সরকারের বড় বড় প্রকল্পে কর ছাড় বন্ধ করতে হবে। তারপরও আইএমএফের শর্ত মানতে হলে এত কর ছাড়ের লাগাম টানতেই হবে। তা না হলে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি আশা করা যায় না। ভর্তুকি কমানো আরো বেশি কঠিন। কারণ, বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে হলে দাম বাড়াতে হবে, যা জনগণের ওপর চাপ তৈরি করবে। আবার না বাড়ালে সরকারের খরচ বাড়বে। তখন রাজস্ব আদায়ে বাড়তি চাপ থাকবে। ভর্তুকি কমানোর বিষয়টি রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সার্বিকভাবে আইএমএফের শর্ত মেনেই রাজস্ব খাতের সংস্কার করতে হবে।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজস্ব আয় কম হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ করফাঁকি। সংস্থাটির মতে, ফাঁকি ও কর এড়ানোর ফলে এক বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয় বলে এক গবেষণায় পাওয়া গেছে।
এ ক্ষতির পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। ১২টি প্রতিষ্ঠান, ১০ জন সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ, এনবিআরের ২ জন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতামত এবং কর এড়ানো ও কর ফাঁকির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে সিপিডি গবেষণার হিসাবটি তৈরি করেছে। উন্নয়ন সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় এই গবেষণা পরিচালনা করে সিপিডি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রাজস্ব ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাত। এটি ‘ছায়া অর্থনীতি’, যার প্রকৃত হিসাব করা কঠিন। এসব খাত থেকে এনবিআর কর আদায় করতে পারে না। অনানুষ্ঠানিক খাতের কারণে ২০১০ সালে কর ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এরপর প্রতিবছরই এ ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২১ সালে এসে তা ৪ গুণ বেড়ে ৮৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা হয়েছে। আমরা অনুমান করছি, কর ফাঁকির একটি অংশ পাচার হয়। কিছু অংশ বিনিয়োগ হয়। আবার কিছু অংশ প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মধ্যে থাকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়