শাহজালাল বিমানবন্দর : যাত্রীদের সঙ্গে অভিনব প্রতারণা গ্রেপ্তার ১

আগের সংবাদ

রক্তস্বল্পতা এক নীরব সমস্যা : অপুষ্টিজনিত এ রোগ থেকে হতে পারে জটিল রোগ > নারী ও শিশুরাই ভুগছে বেশি

পরের সংবাদ

উপজেলা নিয়ে প্রশাসনে অস্বস্তি : আমলারা বলছেন, কোনো সমস্যা নেই > চেয়ারম্যানরা বলছেন, আদালতই আমাদের মর্যাদা ঠিক করে দেবে

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : উপজেলায় ‘উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন’ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে প্রশাসন। চেয়ারম্যানদের উচ্চাভিলাষী মনোভাব এবং নির্বাহী কর্মকর্তাদের সহিষ্ণুতার অভাবের কারণে এই অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এ থেকে তৈরি হওয়া সংকট দিনের পর দিন আরো ঘণীভূত হওয়ায় পুরো উপজেলা পরিষদই ডুবতে বসেছে।
অস্বস্তি কাটাতে এখন আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তারা মনে করছে, উপজেলা নিয়ে সৃষ্ট ঝামেলা প্রাকৃতিক ঝড়ের সমতুল্য। প্রকৃতির নিয়মেই এটি একসময় থেমে যাবে। এটি নিয়ে এত দুশ্চিন্তার দরকার নেই। এর আগে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন- উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারার এমন বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় ৫ জুন পর্যন্ত স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। এতে আমলারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, উপজেলার ভেতরে উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন নামে দুটো অফিস চালু হয়ে গেছে। এরমধ্যে উপজেলা পরিষদের নেতৃত্বে আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, যিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। উপজেলা প্রশাসনের প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এর ফলে উপজেলায় দুটো প্রশাসনিক ধারা বা বলয় তৈরি হয়েছে। এই দুই অংশের মধ্যে বেশির ভাগ উপজেলায় এমনিতেই ঝামেলা লেগে থাকে। এই ঝামেলার মধ্যে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ‘উপদেশ’। এই উপদেশ মানতে গিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে সমস্যা আরো প্রকট হয়। এতে সেবাপ্রার্থীরা নানা ভোগান্তিতে পড়েন।
ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের মধ্যে ঝামেলার একমাত্র কারণ ‘কে প্রধান’ এই নিয়ে। উপজেলা চেয়ারম্যানরা মনে করেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ‘আমার নির্দেশে’ সব ধরণের কাজ করবেন। উল্টো দিকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মনে করেন, তারা সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অংশ। সবক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানের কথা না শুনলেও চলবে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই

সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন। এই আইনের কারণেই বেশিরভাগ ঝামেলার সৃষ্টি। কিন্তু সরকার এই মুহূর্তে আইন সংশোধনের পথে যাচ্ছে না। এর বিপরীতে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে পারষ্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে কাজ হাসিল করে নিতে চায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উপজেলা অনুবিভাগ) মলয় চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে আপাতত কোনো সমস্যা আমরা দেখছি না। যদি সমস্যাই না থাকে তাহলে চেয়ারম্যানরা উচ্চ আদালতে মামলা করলেন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপজেলা আইনেই বলা আছে চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী কর্মকর্তা কী করতে পারবেন। ওই আইন অনুযায়ী নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপজেলায় দুটি সত্তা নিয়ে কাজ করতে হয়। একটি হচ্ছে উপজেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেয়া এবং অন্যটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা। কাজেই যে যার কাজ করে গেলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
এর জবাবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসোসিয়েশনের সভাপতি ও পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ড. মো. হারুন আর রশীদ হওলাদার বলেন, উপজেলা প্রশাসন নাম দিয়ে উপজেলা পরিষদকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। গতকাল তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান অন্তত ১৭টি কমিটির সভাপতি থাকার কথা থাকলেও সেটি বুরোক্র্যাটরা হতে দিচ্ছে না। সরকার নয়, আমলারা উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে দিচ্ছে না। এ জন্যই আমরা উচ্চ আদালতে মামলা করেছি। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আপিল করেছে।
ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে জানা যায়, এরশাদ সরকারের আমলে বাংলাদেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু হয়েছে। তখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তা উপজেলার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা হতো। ওই সময় উপজেলায় মুন্সেফ আদালত, ম্যাজিস্ট্র্যাট আদালতসহ সরকারের সব ধরনের অফিস কার্যকর ছিল। তখন উপজেলা পর্যায়ে পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেয়ার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সমমানের কর্মকর্তাকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হত। এরপর ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার এসে উপজেলা পদ্ধতিটিই বাতিল করে দেয়। এর ১৮ বছর পর ২০০৮ সালে ইউএনডিপি ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে অধ্যাদেশ জারি করে দেশে আবার উপজেলা পরিষদ চালুর সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে তৃতীয়বারের মত উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হয়। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার সেই অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করে। আইন অনুযায়ী উপজেলা চেয়ারম্যানের পাশাপাশি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নামে দুটো পদ সৃষ্টি হয়। এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপজেলার পৌরসভার মেয়র এবং সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যুক্ত হয়ে উপজেলা পরিষদ গঠন হয়।
এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে শতাধিক কমিটি রয়েছে। এরমধ্যে ১৭টি কমিটির সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু সেগুলোও তারা পাননি। অপরদিকে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে উপজেলা পর্যায়ে তাদের কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে কমিটি করে দেয়া হয়। মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে দেয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে কোনো জবাবদিহিই করতে হয় না। এরফলে এখানেও কিছুই করার থাকে না। ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না উপজেলা চেয়ারম্যানদের। এ কারণে তারা নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষমতা কমিয়ে কেবলমাত্র সাচিবিক সহায়তা দেবেন- এই মর্মে আদালতে মামলা করেন। কিন্তু স্থানীয় সরকারের মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, উপজেলা চেয়ারম্যানদের কথামত নির্বাহী কর্মকর্তাকে কেবল সাচিবিক সহায়তা দেয়ার জন্য উপজেলায় রাখা হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওই আইনে ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের কাজ কী হবে তা সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। আবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এই পরিষদের সদস্য থাকায় তাদের মনের মতো না চললে তারা উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা পরিষদের ওপর অনাস্থা দিয়ে থাকেন। এতে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সবসময় ‘নতজানু’ অবস্থায় থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে আইনে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের ‘উপদেশ’ নিতে হবে। এই উপদেশ না নিলে সমন্বয় সভার রেজ্যুলেশনই পাস হবে না। এতে উপজেলা চেয়ারম্যানরা আরো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। সঙ্গতকারণেই উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষে অবস্থান নেয়। বস্তুতপক্ষে উপজেলা চেয়ারম্যানদের কোনো ক্ষমতাই নেই। ক্ষমতায়ন করার জন্য কোনো উদ্যোগও নেই। কারণ যে কাজটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যান করছেন সেই কাজটিই সরাসরি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে দিয়ে সরকার করিয়ে নিতে পারে। তবু কিছু রাজনীতিবিদকে উপজেলায় চেয়ারম্যান করে রাখা হয়েছে। তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে অনেককিছু করিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরফলে প্রশ্ন উঠেছে, উপজেলা পরিষদের দরকার কি? এটি কি জেলা পরিষদের মত রাজনীতিকদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে উঠছে?
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, অবশ্যই উপজেলা পরিষদের দরকার আছে। কিন্তু এখন যে উপজেলা পরিষদ রয়েছে সেটি কার্যকর নয়। কার্যকর করার জন্য কারো কোনো আগ্রহও নেই। আর উপজেলা নিয়ে সরকারেরও অস্বস্তি নেই। এমপি এবং ব্যুরোক্র্যাটরা এখানে সুবিধামতো কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। আর কিছু রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানদের মামলা আর পরিষদের কাজ দুটোই স্ট্যাণ্টবাজি। এই স্ট্যাণ্টবাজির আড়ালে কিছু লোক করে খাচ্ছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন করে ইউএনওকে পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়। আইন সংশোধনের পর ইউএনওরা চেয়ারম্যানদের উপদেষ্টা করে নিজেরাই উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির সভাপতি বনে যান। ফলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা ইউএনওর অধীনস্থ কর্মচারী। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের রায়ে শেষ পর্যন্ত উপজেলায় আর আমলাদের কর্তৃত্ব থাকল না। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ইউএনও উপজেলা পরিষদে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থাকবেন না। সংশোধিত উপজেলা পরিষদ আইন ২০১১ চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকটি রিট পিটিশন দায়ের হয় সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে। যার একটি হচ্ছে হারুন আর রশীদ হাওলাদার বনাম রাষ্ট্র মামলা নং-৯৫৯৩/২০২০। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের নির্দেশনা ও আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদই উপজেলা প্রশাসন। অর্থাৎ এতদিন উপজেলা প্রশাসন বলে যা বলা হয়েছে, তা সঠিক ছিল না। উপজেলা প্রশাসন লেখা ঠিক হয়নি। রায়ে আরো বলা হয়, সংশোধিত উপজেলা পরিষদ আইন ২০১১-এর ৩৩ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং ওই আইনের বিতর্কিত ধারাটি বাতিল করা হলো। অর্থাৎ ইউএনও আর উপজেলা পরিষদের আওতায় গঠিত কোনো কমিটির সভাপতি থাকতে পারবেন না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারার এমন বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় ৫ জুন পর্যন্ত স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত। স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারাও সহজেই বিষয়টি ছাড়বেন না। অর্থাৎ উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতাবান হতে দেয়া হবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়