ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে জি এম কাদেরের সৌজন্য সাক্ষাৎ

আগের সংবাদ

যে কারণে বেঁকে যাচ্ছে রেললাইন

পরের সংবাদ

রক্তস্বল্পতা এক নীরব সমস্যা : অপুষ্টিজনিত এ রোগ থেকে হতে পারে জটিল রোগ > নারী ও শিশুরাই ভুগছে বেশি

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : রক্তের হিমোগেøাবিনের মাত্রা কোনো কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে গেলে তাকে বলা হয় রক্তস্বল্পতা। দেশের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে রক্তস্বল্পতা অন্যতম। এটি ঝুঁকিপূর্ণ একটি রোগ। অ্যানিমিয়া নামে রোগটি বেশি পরিচিত। চিকিৎসকরা বলছেন, রক্তের যে কোনো সমস্যাই রক্তরোগ। লাল রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা- এই তিনটির যে কোনো একটির সমস্যা হলে তা রক্তরোগ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে বহু মানুষ, বিশেষ করে নারীদের একটি বড় অংশ রক্তস্বল্পতায় ভুগছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে হিমোগেøাবিনের পরিমাণ ১৪-১৬ গ্রাম/ডিএল থাকে। এর থেকে কম হলেই রক্তস্বল্পতা বলে ধরে নেয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের ৫ বছরের কম বয়সি ৪২ শতাংশ শিশু এবং ৪০ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। অ্যানিমিয়া ইন বাংলাদেশ : এ রিভিউ অব প্রিভেলেন্স এন্ড এটিওলজি : এফ আহমেদ, পাবমেড আর্টিকেল অনুযায়ী, গ্রামীণ বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ কিশোরী ও ৪৯ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের ‘এ ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অ্যানিমিয়া প্রিভেনশন এন্ড কনট্রোল ইন বাংলাদেশ’ নামক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩৬ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়। ফলে শরীরে কম আয়রন জমা থাকে বলে তা খুব অল্প সময়েই শেষ হয়ে যায় এবং শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে।
২০২২ সালে অক্টোবর মাসে প্রকাশিত জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পুষ্টি সেবা (এনএনএস) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এর যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে শিশু ও নারীদের ভিটামিন ও খনিজের গুরুতর অভাব রয়েছে। দেশের ২১ শতাংশ শিশু বিভিন্ন মাত্রায় রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। আর গর্ভবতী নন, যারা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন না এমন ২৯ শতাংশ নারী ভুগছেন রক্তস্বল্পতায়।
সম্প্রতি পেডিয়াট্রিক এন্ড অ্যাডোলেসেন্ট গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিএজিএসবি) এর এক অনুষ্ঠানে সংগঠনটির মহাসচিব ও স্ত্রী রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বলেন, দেশের ৩৬ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরীর ৩ ভাগের ১ ভাগ রক্তশূন্যতা ও অপুষ্টিতে ভুগছে।
চলতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে ইউনিসেফের ‘অপুষ্টিতে আক্রান্ত এবং উপেক্ষিত কিশোরী ও নারীদের মধ্যে বৈশ্বিক পুষ্টি সংকট’ শীর্ষক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, বিশ্বের ১শ কোটির বেশি কিশোরী ও নারী অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। আর পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে কিশোরী ও নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, পাশাপাশি তাদের মেধার দুর্বল বিকাশ এবং গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতাসহ নানান ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিশোরী ও নারীদের পুষ্টি সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকা। বৈশ্বিকভাবে ওজন স্বল্পতায় ভোগা প্রতি ৩ জনের মধ্যে ২ জন এবং রক্তস্বল্পতায় ভোগা প্রতি ৫ জন কিশোরী ও নারীর মধ্যে ৩ জনই এ দুই এলাকার।
রক্তস্বল্পতার লক্ষণ প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা বলেন, চোখ-মুখ ফ্যাকাশে মনে হওয়া, দুর্বলতা, ক্লান্তি, অবসাদ, মাথা ঘোরা ও ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, মুখে-ঠোঁটে ঘা ইত্যাদি রক্তশূন্যতার সাধারণ লক্ষণ। রক্তশূন্যতার মাত্রা তীব্র হলে শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ লাগা এমনকি হার্ট ফেইলিউরও হতে পারে।
রক্তস্বল্পতায় ভোগার কারণ প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা বলছেন, ভুল খাদ্যাভ্যাস, অপুষ্টি, অজ্ঞতা, বাল্যবিয়ে, ঘন ঘন গর্ভধারণ, মাসিক, কৃমির সংক্রমণ, রক্তের ক্যান্সার ও পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগ অন্যতম। তাই প্রতি ৬ মাস পরপর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করানোর মাধ্যমে পরিস্থিতি জেনে নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেন, দেশে রক্তস্বল্পতার ব্যপকতা থাকলেও রক্তরোগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ। এছাড়া দেশে রক্ত নিয়ে আদর্শ সমন্বিত চিকিৎসাকেন্দ্র একটিও নেই।

পুষ্টিবিদদের মতে, রক্তস্বল্পতা বিশ্বের সবেচেয়ে বড় অপুষ্টিজনিত সমস্যা। বিশেষ করে যারা পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত তাদের রক্তস্বল্পতার প্রবণতা বেশি হয়। মূলত শরীরে আয়রনের অভাবেই রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, রক্তস্বল্পতা বাংলাদেশের মানুষের একটি নীরব ও অবহেলিত সমস্যা। কারো রক্তস্বল্পতা হলে শুরুতে খুব বেশি শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় না বলে রোগটি অবহেলিতই থেকে যায়।
অবসটেট্রিক্যাল এন্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, গর্ভ অবস্থায় মেয়েদের আয়রনের ঘাটতি অনেক বেশি হয়। এই ক্ষেত্রে ১শ গ্রামের চেয়েও বেশি আয়রনের প্রয়োজন হয়। তাই প্রতিটি গর্ভবতীকে আয়রন সাপ্লিমেন্ট নিতে হয়। কারণ যেকোনো গর্ভবতী নারীরই অ্যানিমিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তিনি আরো বলেন, ১৮ বছরের আগে ছেলে বা মেয়ে উভয়েরই বেড়ে ওঠার পর্যায়ে থাকে। বিশেষত একটি মেয়ের তখন নিজেরই বেড়ে ওঠার জন্য অনেক আয়রন, ভিটামিন, ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়। মেয়েদের যখন মাসিক হয়, তখন শরীর থেকে অনেক শক্তি ক্ষয় হয়। আর তা যদি পরবর্তীতে আয়রনসমৃদ্ধ খাবারের মাধ্যমে পূরণ না হয়, তখন তারা রক্তস্বল্পতায় ভোগে। কোনো মেয়ের যদি বাল্যবিয়ে হয় এবং সে যদি গর্ভবতী হয়, তখন সে আয়রনের ঘাটতিজনিত সমস্যায় ভোগে। এর প্রভাব বাচ্চার ওপরও পড়ে।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, রক্তস্বল্পতা যে শুধু গর্ভবতীদেরই হয় তা নয়। শিশুদেরও এ রোগ দেখা দেয়। শিশুদের ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত শুধু চালের গুঁড়া এবং দুধ খাওয়ানো হয়। মাছ, মাংস, ডিম খুব বেশি খাওয়ানো হয় না, ফলে তখন থেকেই শিশুরা রক্তশূন্যতায় ভোগে। আমাদের দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাবারের তালিকায় কার্বোহাইড্রেট অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। এটা রক্তস্বল্পতার অন্যতম প্রধান কারণ। দেশের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত অনেকেরই এখনো পর্যন্ত পুষ্টি সচেতনতা নেই। আমাদের খাবারের মেন্যুতে কী কী আয়রন সমৃদ্ধ খাবার রাখা উচিত তা জানা প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়