যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

নিয়ন্ত্রণেই সংবাদ-সাংবাদিকতার বিকাশ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দয়া, অনুকম্পা বা উদারতায় সাংবাদিকতার বিকাশের ইতিহাস নেই। দেশে দেশে এর বিকাশ এসেছে সেন্সর বা নিয়ন্ত্রণেই। আবার অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, সাংবাদিকতার সূচনাও হয়েছে ক্ষমতাসীনদের বন্দনা ও উষ্মার রসায়নে। হাতে লেখা সংবাদপত্রকে রাজারা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচারপত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সময়ে সময়ে সাংবাদিকরা এতে বিরক্ত হয়েছেন। কৌশলে প্রজাদের উপযুক্ত করে তথ্য জোগান দিয়েছেন। রাজ-রাজারা ক্ষেপেছেন। আবার নমনীয় হয়েছেন। যা প্রকারান্তরে সাংবাদিকতাকে দিয়েছে গতিময়তা।
সেই শুরু থেকেই সংবাদপত্রকে সাম্রাজ্য রক্ষা, বিস্তার, প্রতিপক্ষ দমন, জনগণকে বিভ্রান্ত করার মুখপত্র হিসেবে চাইতেন রাজাপক্ষ। তাদের আনুকূল্য ছাড়া সংবাদপত্র প্রকাশ করাও ছিল ধারনার বাইরে। ১৭০২ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত ইংল্যান্ডের প্রথম দৈনিক পত্রিকাটির নাম ডেইলি কুরান্ট। এর প্রকাশক ছিলেন এডওয়ার্ড ম্যালেট। এই মুদ্রণ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণ আসতে শুরু করে রাজাদের কাছ থেকে প্রজাদের হাতে। কারণ মুদ্রণ শিল্প বা ছাপাখানার মালিকরা প্রজা বা সাধারণ মানুষ। ছাপাখানা প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সংবাদপত্র ক্রমেই একটি শক্তিশালী মাধ্যমে রূপ নিতে থাকে। সম্রাট বা রাজারা একে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ হেনরি সিংহাসনে বসেই ছাপাখানা প্রজা মালিকানায় না রাখার ফরমান জারি করেন। ফরমানটি নিয়ে রাজ্যে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। এক পর্যায় তিনি ফরমানটি প্রত্যাহার করলেও ছাপাখানা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন করেন। কেউ কিছু ছাপতে গেলে তা আগে রাজ দপ্তরে দেখিয়ে সেন্সর করে আনা বাধ্যতামূলক করা হয়। এ নিয়ে রাজা-প্রজা পরস্পর সরাসরি প্রতিপক্ষে রূপ নেয়।
রোমান ক্যাথলিক চার্চের পক্ষে একটি প্যামপ্লেট ছাপা হওয়ায় একজনকে ফাঁসি দেয়া হয় রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় (১৫৫৮-১৬০৩)। রাজদ্রোহের অভিযোগ এনে কান কেটে দেয়া হয় উইলিয়াম প্রাইন নামে এক প্রকাশকের। প্রেস মালিক ও প্রকাশকদের ওপর এ ধরনের নিপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষাপটে ইউরোপ ও আমেরিকায় বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেস। আজকের বাস্তবতায় আন্ডারগ্রাউন্ডের ধারণা ও অর্থ পাল্টে গেছে। ষাটের দশকে সাংবাদিকতার নামে ক্ষমতাসীনদের বন্দনামূলক রচনায় বিরক্ত-ক্ষুব্ধ হয়ে প্রগতিশীল সাহসী কিছু যুবক-তরুণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেস গড়ে তোলেন। জার্নালিজমে তারা এমন একটি স্টাইল সৃষ্টি করেন, যা পাঠক সমাজকে কেবল আলোড়ি নয় মুক্তও করে। ওইসব আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেস থেকে ছাপা হতে থাকে সাহসী ও মন্তব্যধর্মী বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা। সংবাদপত্রকে নিষ্পেষণ ও কণ্ঠরোধের রাষ্ট্রীয় চেষ্টার প্রতিবাদে সাহসী সাংবাদিকতার চর্চা হয়েছে ওইসব আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে। টেনের জন মিল্টন, ডানিয়েল ডিফো, জনাথন, সুইফট, স্যার রবার্ট স্টিল, জোসেফ এডিসনের বহু লেখ প্রকাশ হয়েছে গোপন প্রেসে। খবর উপযোগী তথ্য ও ঘটনাকে তারা সাহিত্যের ভাষায় সাংবাদিকতার সাহসী ও নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন। এখানে জনমিল্টনের অ্যরিও প্যাজিটিকা পুস্তিকার সামান্য একটু উদ্বৃতি বেশ প্রাসঙ্গিক। এতে তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে জানার অধিকার দাও, দাও অবাধে কথা বলার স্বাধীনতা, আমাকে মুক্তভাবে বিতর্ক করার স্বাধীনতা দাও, বিবেকের, চিন্তার স্বাধীনতা দাও। সবার ওপরে দাও আমাকে মুক্তি’। জন মিল্টনের এ লেখায় সাহিত্যমানের চেয়ে সাংবাদিকতার মান ও আবেদনই ছিল বেশি।
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদদৌলার পতনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ইংরেজ রাজত্ব পাকাপোক্ত হয়। কলকাতাকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে ভারতবর্ষের রাজনীতি-অর্থনীতি। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বেশ কিছু ছাপাখানা বসায় এ অঞ্চলে। রাজত্ব আরো পাকাপোক্ত করতে এগুলো থেকে ইংরেজ শাসনের গুণকীর্তন করে ১৭৮০ সালে ভারত প্রবাসী ইংরেজ জেমস অগাস্টাস হিকি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করেন বেঙ্গল গেজেট। নাম বেঙ্গল গেজেট হলেও হিকির গেজেট নামেই এটি পরিচিতি লাভ করে। একে উপমহাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা প্রসার ও বিকাশের ভিত্তি ধরা হয়। হিকির পর ইউরোপীয় মালিকানাধীন এসব ছাপাখানা থেকে আরো কিছু সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশ হয়। এগুলোতে শুধু ইউরোপীয়দের সমাজচিত্র-সংস্কৃতিই প্রকাশ হতো, যা প্রকাশ এ অঞ্চলের বাস্তবতা বিচারে ছিল কদর্য ও অশ্লীলতায় ভরপুর। অথচ হিকি ইউরোপীয় হলেও তার পত্রিকায় এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও সামাজিকতার সুন্দর দিকগুলো। এমনকি ইংরেজ শাসকদের অত্যাচারের কিছু সংবাদও স্থান পেত। হিকির আগে ১৭৬৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদ্য অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা এতে বিরক্ত। তাকে ভারতবর্ষ থেকে তাড়িয়ে দেয়। তল্পিতল্পাসহ উইলিয়াম বোল্টসকে দেশে ফেরত দেয়া হয়।
উনিশ শতকের আগ মুহূর্তে বাঙালি বিশেষত বাঙালি হিন্দুুদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার ঢেউ লাগতে শুরু করলে ভারতে সংবাদপত্রের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়। ১৮১৮ সালের ১৬ মে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের মালিকানাধীনে প্রকাশ হয় বাঙাল গেজেট। বাঙাল গেজেটকেই বলা হয় বাংলা ভাষায় এবং বাঙালি মালিকানাধীন প্রথম সংবাদপত্র। এর ক’দিন পরই প্রকাশ হয় আরেকটি বাংলা পত্রিকা সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ। এর উদ্যোক্তা ছিলেন খ্রিস্টান মিশনারীরা। আর সম্পাদক জন ক্লার্ক মার্শম্যান। ১৮৪৭ সালে বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে প্রথম যে সংবাদপত্রটির প্রকাশ ঘটে রংপুর থেকে। নাম রঙ্গপুর বার্তাবহ। প্রথমে এর সম্পাদক ছিলেন গুরুচরণ রায়, পরে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় সাহসী ভূমিকার কারণে ব্রিটিশ সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশ (পূর্ববাংলা বা পূর্বপাকিস্তান) এর দ্বিতীয় পত্রিকা ঢাকা নিউজ। এটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র। ঢাকায় প্রথম বাংলা পত্রিকা ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালের মার্চে। ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যশোরের (বর্তমান মাগুরা) পলুয়া থেকে প্রকাশ হয় ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। দুই ভাই বসন্ত কুমার ঘোষ ও শিশির কুমার ঘোষ ছিলেন এর উদ্যোক্তা। বছর তিনেক পর ১৮৭১ সালে শিশির কুমার ঘোষ পত্রিকাটি স্থানান্তর করে নিয়ে যান কলকাতায়। বাঙালি মুসলমান আনিস উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘পাক্ষিক পারিল বার্তাবহ’। ১৮৭৪ সালে এটি প্রকাশিত হয় মানিকগঞ্জের পারিল গ্রাম থেকে। বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি বাংলা দৈনিক পত্রিকাই প্রকাশ হয় চট্টগ্রাম থেকে। প্রথমটি দৈনিক জ্যোতিঃ (১৯২১), দ্বিতীয়টি দৈনিক রাষ্ট্রবার্তা (১৯৩০)। জ্যোতিঃর সম্পাদক-প্রকাশক পটিয়ার কালিশংকর চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন ছাপাখানার মালিক এবং মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ অনুসারী। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখায় তার পত্রিকাটি ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়ে। দ্বিতীয় দৈনিক রাষ্ট্রবার্তার সম্পাদক লোকমান খান শেরওয়ানী। চট্টগ্রামে মাস্টার দ্য সূর্যসেনের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ১৯৩০ সালে প্রকাশিত দৈনিক রাষ্ট্রবার্তা অল্পসময়ে বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। দৈনিক জ্যোতি ও রাষ্ট্রবার্তার আগে ঢাকা থেকে প্রকাশ হয় পূর্ববাংলার প্রথম ইংরেজি দৈনিক দি হেরাল্ড। সম্পাদক প্রিয়নাথ সেন। সংবাদপত্রের মান এবং পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিচারে বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা মনে করা হয় দৈনিক আজাদকে। তবে আজাদ প্রথম প্রকাশ হয় কলকাতা থেকে। অগ্রসর চিন্তার মুসলমান বরেণ্য রাজনীতিক মওলানা আকরাম খাঁ ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর কলকাতা থেকে আজাদের প্রকাশনা শুরু করেন। পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়ায় এর বিশেষ একটি পাঠক শ্রেণি গড়ে ওঠে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালের অক্টোবরে আজাদ ঢাকায় স্থানান্তর হয়। কলকাতা-ঢাকা দুই জায়গায়ই আজাদের সম্পাদক ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন। প্রখ্যাত সাংবাদিক খায়রুল কবির বার্তা সম্পাদক।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৭’র ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে বের হয় দৈনিক পয়গাম। এর কিছুদিন পর প্রকাশ হয় দৈনিক জিন্দেগী। প্রকাশের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। এটি সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে উন্নীত হয় ১৯৪৭ এর ৪ সেপ্টেম্বর। বন্ধের পর দৈনিক জিন্দেগীর ২৬৩ বংশাল রোডের ঠিকানা থেকেই প্রকাশ হয় দৈনিক সংবাদ (১৫ মে ১৯৫১)। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম খাঁটি বাংলা নামের পত্রিকা দৈনিক সংবাদ। আজাদ, পয়গাম, জিন্দেগী ইত্যাদি উর্দু-হিন্দি নামের যুগে ‘সংবাদ’ নামটি অনেকের কাছে তখন বেখাপ্পা মনে হয়েছে।
পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার প্রকাশ হয় ১১ মার্চ ১৯৪৯-এ। মুসলিম লীগের বহুল পরিচিত নেতা হামিদুল হক চৌধুরী এর মালিক। প্রথম সম্পাদক শেহাবুল্লাহ। পরে সরকারি চাকরি ছেড়ে অবজারভারের সম্পাদক পদে যোগ দেন আবদুস সালাম। তার কিছুদিন পরই (২০ মার্চ ১৯৪৯) কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর হয় মর্নিং নিউজ। দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে (সাপ্তাহিক হিসেবে) প্রকাশ করেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। কট্টর মুসলিম লীগবিরোধী ভূমিকার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগবিরোধীদের প্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর দৈনিকে উন্নিত হয় ইত্তেফাক। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশের পরের বছর ১৯৫০ সালের মাঝামাঝিতে বলিয়াদির জমিদারদের মালিকানায় প্রকাশ হয় দৈনিক ইনসাফ। ইনসাফের সম্পাদক ছিলেন মহিউদ্দীন আহমেদ। ১৯৫০ সাল নাগাদ সংবাদপত্র এ অঞ্চলে একটি শক্তি হিসেবে দাঁডায়। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে বেশ প্রভাব রাখতে শুরু করে সংবাদপত্রগুলো। ভাষা আন্দোলন বেগবান করতে সংবাদপত্রগুলো বেশ ভূমিকা রাখে। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার বেশ সাহসী ভূমিকা নেয়।
’৫২-র ১৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার অবজারভার বন্ধ করে দেয়। গ্রেপ্তার করে মালিক হামিদুল হক চৌধুরী ও সম্পাদক আব্দুস সালামকে। দৈনিক মিল্লাত ও ইনসাফ ভাষা আন্দোলনকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করেছে। সাপ্তাহিক সৈনিকের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত সাহসী। এ সাহসী ভূমিকার কারণে মিল্লাত সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বের ও সৈনিক সম্পাদক আবদুল গফুরের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়।
ভাষা আন্দোলন ও পূর্ববাংলার বিভিন্ন আন্দোলনে কর্মসূচিকে বেগবান করার পেছনে সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকা উপলব্ধি করে পাকিস্তান সরকার। সেই উপলব্ধি থেকে সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পত্রিকা প্রকাশনার উদ্যোগ নেয়। সেই লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে গঠিত হয় ন্যাশনাল প্রেসট্রাস্ট। পাকিস্তান সমর্থিত মর্নিং নিউজ প্রকাশনার দায়িত্ব নেয় প্রেস ট্রাস্ট। ইংরেজির সরকার একটি বাংলা পত্রিকার প্রয়োজন মেটাতে ট্রাস্টের মালিকানাধীনে ১৯৬৪’র ৬ নভেম্বর প্রকাশ করা হয় দৈনিক পাকিস্তান। সম্পাদক করা হয় আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনকে। দৈনিক পাকিস্তানই দেশ স্বাধীনের পর হয় দৈনিক বাংলা। দৈনিকে উন্নীত হওয়ার পর স্বাধিকার আন্দোলনে জোরদার ভূমিকার। পরিণতিতে বারবার পাকিস্তান সরকারের দমনে আক্রান্ত হয় ইত্তেফাক। ১৯৫৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়াকে। তিনি আবার গ্রেপ্তার হন ৬২’র ৬ ফেব্রুয়ারি। আবার ৬৬ সালের ১৫ জুন। তখন ইত্তেফাকের প্রকাশনাও বন্ধ করে দেয়া হয়। ৩ বছর বন্ধ থাকার পর ৬৯-এ আবার ইত্তেফাকের প্রকাশনা শুরু হয়। ৫২তে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দৈনিক সংবাদ মালিকানা বদলের পর অবস্থান নেয় আন্দোলনের পক্ষে। ৬ দফা আন্দোলনে কিছুটা সংশয়ী ভূমিকা নিলেও আজাদ এক পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ভূমিকা রাখতে শুরু করে।
এভাবে এক এক করে অধিকাংশ পত্রিকা আন্দোলনের সপক্ষে অবস্থান নিতে থাকে। এমনকি পাকিস্তান সরকারের মালিকানাধীন মর্নিং নিউজও। এক পর্যায়ে দৈনিক সংগ্রামও। ইংরেজি দি পিপল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অকপেশন আর্মি নামে শ্লেষাত্মক মন্তব্য করে। সাপ্তাহিক হলিডের তখনকার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বলতে গেলে দৈনিক পাকিস্তান ছাড়া প্রায় সব সংবাদপত্র ও এসবে কর্মরত সাংবাদিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে হুঁশিয়ারি দিতে থাকেন। এর জবাবে পাকিস্তান সরকার সেন্সর জোরদার করে। আর দৈনিক পাকিস্তান ছাড়া বাদবাকি পত্রিকাগুলোকে ভয়াবহ আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা বলে তাচ্ছিল্য করতে থাকে। ৭১’র ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে পাক বাহিনীর অন্যতম টার্গেট হয় ইত্তেফাক ও পিপল। বোমা মেরে বিধ্বস্ত করা হয় এ দুটি সংবাদপত্র অফিস। অগ্নিসংযোগ করা হয় সংবাদ অফিসে। কর্মক্ষেত্রেই পুড়ে মারা যান সাংবাদিক শহীদ সাবের। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস প্রকাশিত হয়নি সংবাদ, পিপল, হলিডে। ইত্তেফাক ২ মাস বন্ধ থাকার পর ২১ মে থেকে আবার প্রকাশিত হতে থাকে। তবে আগের মতো বলিষ্ঠ কণ্ঠে না হলেও কোনো না কোনোভাবে ইত্তেফাক তার পাকিস্তান বিরোধিতা অব্যাহত রাখে। অবজারভার এবং এ হাউজের বাংলা দৈনিক পূর্বদেশ, সরকারি মালিকানাধীন মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তানসহ যেসব পত্রিকা তখন অবাধে প্রকাশ হয়েছে এগুলোর কোনোটিই সাহসী ভূমিকা নেয়নি বা নিতে পারেনি। কমবেশি পাকিস্তানের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। আর পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সংবাদের শহীদল্লাহ কায়সার, পয়গামের খোন্দকার আবু তালেব, পূর্বদেশের আ ন ম গোলাম মোস্তফা, অবজারভারের লাডু ভাই খ্যাত শেখ আবদুল মান্নান, সেলিনা পারভীন, শিবসাধন চক্রবর্তীকে।
স্বাধীনতা সবার জন্যই উপভোগের। কিন্তু নিজে স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে অন্যেও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলো কি-না দেখা যে কোনো সচেতন মানুষের দায়িত্ব। সমাজের বিবেকমান, মানবিক গুণসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা ও সতর্ক রাখার উদ্দেশ্যই আচরণবিধি বা নীতিমালার প্রশ্ন এসেছে।
যেদিন থেকে সংবাদপত্রকে অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী ও প্রভাবশালী মনে হতে থাকে সেদিন থেকেই এ ক্ষমতা ও প্রভাবের সীমা টেনে ধরার চিন্তা আগে রাষ্ট্রপক্ষের। সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ ‘ফোর্থ স্টেট’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্য তিনটি শক্তি- নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদকে নিয়ন্ত্রণের কিছু নীতি ও বিধি রয়েছে। তা হলে চতুর্থ শক্তি সংবাদপত্রের জন্যে কেন নীতিমালা বা আচরণবিধি থাকবে না এ প্রশ্ন জোরালো হয়ে ওঠে। তিনটি শক্তির নিয়ন্ত্রণ বরাবরই থাকে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হাতে। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অনুরূপভাবে চতুর্থ শক্তি সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সময়ের সময়ে আচরণবিধি, নীতিমালা প্রণয়নের তাগিত বোধ করেন। এছাড়া সীমিত-শৃঙ্খলিত স্বাধীনতার মধ্যেও সাংবাদিকদের ক্ষমতাচর্চাও অপসাংবাদিকতা রোধের আচরণবিধি আরোপের একটি উদ্দেশ্য। সময়ের ব্যবধানে তা আরো কঠোর হয়েছে। এরপরও মনমতো নিয়ন্ত্রণ কয়েম না হওয়ায় নীতিমালা, আচরণবিধি কঠোর থেকে কঠোর করা হয়। এসব বিধিবিধান বর্তমান বিশ্বের দেশে দেশে একটি বিশেষ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসত্তা বিনাশী এবং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সংবিধান। বিরোধী বা পরিপন্থি কোনো সংবাদ অথবা ভাষ্য প্রকাশ কোনো দেশই মানে না। জনগণকে আকর্ষণ করে অথবা তাদের ওপর প্রভাব ফেলে এমন বিষয়ে জনগণকে অবহিত রাখাকে একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। জনগণের তথা সংবাদপত্রের পাঠকগণের ব্যক্তিগত অধিকার ও সংবেদনশীলতার প্রতি পূর্ণ সম্মানবোধসহ সংবাদ ও সংবাদভাষ্য রচনা ও প্রকাশ সাংবাদিকতার নৈতিকতাভুক্ত। গুজব ও অসমর্থিত প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে সেগুলোকে চিহ্নিত করা এবং যদি এসব প্রকাশ করা অনুচিত বিবেচিত হয় তবে সেগুলো প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার বিধান আছে সব দেশেই।
সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বেশি বেশি বলা হলেও বাস্তবে এ স্বাধীনতার মাত্রা রয়েছে। তাই বলা হয়, গণমাধ্যম কোথাও কখনো স্বাধীন ছিল না, এখনো নেই। এ স্বাধীনতা আসলে কার স্বাধীনতা? সংবাদের না সাংবাদিকের, সাংবাদিকের না সম্পাদকের না মালিকের? এ নিয়েও কথা আছে, বিতর্কও আছে। এছাড়া একাডেমিশিয়ানরা এ স্বাধীনতাকে যেভাবে দেখেন প্র্যাকটিশনাররা সেভাবে দেখেন না। সংবিধানে সংবাদক্ষেত্রের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে সেখানেও জুড়ে দেয়ার মাঝেও কতগুলো শর্ত রয়েছে। ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় বলা হয়েছে- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার কথা। সাংবিধানিক উপরে। বিধিনিষেধের বাইরেও এমন কিছু আইনকানুন রয়েছে, যা কোনো না কোনোভাবে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। এগুলোর মধ্যে ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন, প্রেস কাউন্সিল আইন, কপিরাইট অধ্যাদেশ, বেতার। টেলিগ্রাফি আইন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনতো রয়েছেই। বিশেষ ক্ষমতা আইন, মানহানি, আদালত অবমাননাসহ ইত্যাদি আইনের ধারা-উপধারায় দেওয়ানি-ফৌজদারি উভয় মামলায় সংবাদ-সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণের অবারিত সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও এ নিয়ন্ত্রণ কম-বেশি বিদ্যমান।
গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি প্রশ্নে উদার ঐতিহ্য ও সভ্যতার কথা বলা হলে ব্রিটেনের নাম আসে সর্বাগ্রে সেখানেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের আইন রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সাংবাদিকদের জন্যে কঠোর আচরণবিধি। বিশ্বের আরেক সভ্য দেশ আমেরিকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সেই স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের জন্যে রয়েছে আইনকানুনও। ভারেতও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা অবাধ বা নিরঙ্কুশ নয়। ভারতীয় সংবিধানের ১৯(ক) অনুচ্ছেদের বিপরীতে ১৯ (২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে ‘পরিপূরক দায়দায়িত্ব ছাড়া সংবাদপত্রসমূহ একতরফা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না’।
বিকাশ বা সূচনালগ্নে সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস যেমন সত্য তেমনি সত্য অপসাংবাদিকতার ইতিহাসও। ভারত উপমহাদেশে ওয়াকিয়া নবিশ, খুফিয়া নবিশ, আখবর নবিশ ইত্যাদির নামের সংবাদ লেখকদের মধ্যে অসত্য-অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশনের বহু নজির রয়েছে। তা কখনো ইচ্ছাকৃত-উদ্দেশ্যমূলকভাবে কখনো অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতার কারণে। সাংবাদিকতা বা সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ইতিহাসের পেছনে অপসাংবাদিকতা, অসত্য তথ্য চর্চাও একটি কারণ। বিভিন্ন কারণে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতা সেই আধুনিককাল পর্যন্ত চলছে।
কোনো স্বাধীনতাই অসীম বা সীমাহীন নয়। সাংবাদিকতার স্বাধীনতার বিষয়টিও তেমন। বিশ্বের কোথাও কোনো সংবাদ মাধ্যমের যা ইচ্ছে তা ঢালাও প্রচার প্রকাশের লাইসেন্স নেই। সংবাদকর্মী বা একজন সাংবাদিকের যেরকম মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে, একই স্বাধীনতা রয়েছে একজন সাধারণ নাগরিকেরও। অর্থাৎ মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকের বাড়তি কোনো ক্ষমতা বা অধিকার নেই। সংবিধানে একজন সাধারণ নাগরিককে মত প্রকাশের যে অধিকার দেয়া হয়েছে একজন সাংবাদিকেরও তা-ই। আইনে এ রকম বলা হলেও এর বাস্তব প্রয়োগ ভিন্ন। পেশাগত সুবিধার্থে একজন সাংবাদিক যেভাবে তথ্য ও মত প্রকাশের সুযোগ পান অন্য একজন নাগরিক তা পান না। কারণ সাংবাদিক সরাসরি একটি সংবাদক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তার পেশাই হচ্ছে মত ও তথ্য প্রকাশ। তাই বলে তিনি ইচ্ছামতো মত বা তথ্য প্রকাশের অধিকারী নন। মত প্রকাশের এ সুযোগে সাংবাদিককে কারো চরিত্র হনন বা মিথ্যাচারের যথেচ্ছ স্বাধীনতা দেয়া হয়নি।
কোনো সাংবাদিকের অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতাবশত ভুল তথ্য পরিবেশনও শাস্তিযোগ্য। এমনকি সংবাদপত্রে পাঠকের চিঠি বা মতামতের জন্যেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সম্পাদক-প্রকাশক দায়মুক্ত নন। যদিও সংবাদপত্রগুলোতে পাঠকের চিঠিপত্র বা মতামত বিভাগে মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নন’- এ মর্মে একটি ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদ সাংবাদিকতা বিষয়ে আইন ও বিচার বিশেষজ্ঞগণের মতে, কোনো সংবাদমাধ্যমে যা কিছু (সংবাদ, ফিচার, মতামত এমনকি বিজ্ঞাপনও) প্রকাশ হবে সকল কিছুর জন্যেই ওই সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা রয়েছে।
সংবাদ বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিকতার শিক্ষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ সকলেই একমত যে সংবাদমাধ্যমে ব্যবহারিক বিবেচনায় ‘অবাধ’ শব্দটি নিতান্তই তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক নয়। একজন সাংবাদিকের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যে কোনো ভুল, অসত্য-অর্ধসত্য তথ্য দেশের বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। এজন্যে বলা হয়ে থাকে, ডাক্তারের ভুল বা অসাবধানতায় একজন রোগীর সর্বনাশ হয়। কিন্তু সাংবাদিকের বা সংবাদমাধ্যমের ভুলে সর্বনাশ হয় গোটা জাতির। এক্ষেত্রে হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ইতিহাসে মিথ্যার মহারাজা’ খ্যাত জেনারেল গোয়েবলসের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, একটি গ্যাস চেম্বারের বিস্ফোরণে কয়েকশ লোক মারা যেতে পারে। কিন্তু একটি পরিকল্পিত মিথ্যা লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই উক্তিটি করেছেন তিনি। দায়িত্ব বা প্রভাব বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমের স্থান অত্যন্ত উচ্চাসনে। সংবাদপত্রে কিছু ছাপা হলে, টেলিভিশন-রেডিওতে কিছু স¤প্রচার হলে মানুষ তাকে সত্য বলে ধরে নেয়। এ মানসিকতা সারা দুনিয়াতেই। এ রকম উচ্চাসনের প্রভাবক ও দায়িত্বশীলদের দায়বদ্ধতাও তাই বেশি।
অনিচ্ছাকৃত অসত্য তথ্য পরিবেশনের স্বাধীনতা নেই সাংবাদিকের। তিনি অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হয়ে বা বিনা স্বার্থে কোনো অসত্য তথ্য দিলে তাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। তথ্য সংগ্রহ, সংবাদ প্রস্তুত, প্রচার এবং প্রচারের পর অডিয়েন্সের কাছে তিনি দায়বদ্ধ। সেই সাথে প্রচলিত আইন ও সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধতা। আর পেশার প্রতি এবং নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে দায়বদ্ধতা তো রয়েছেই। তাই দায়িত্ব বিচারে সাংবাদিক অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে দায়িত্বশীল। পেশাগত দায়িত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব। সেই অনুপাতে তার দায়ও বেশি। ঝুঁকি বেশি। জাতিসংঘ ঘোষিত নীতিমালায় বলা হয়েছে : সাংবাদিক শুধু তথ্য মাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারীদের কাছেই নন, সমাজের বিভিন্ন মহলসহ চূড়ান্তভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।
এত বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণের পর সাংবাদিকের পক্ষে ঝুঁকিমুক্ত থাকা কঠিন। ঝুঁকি তাকে নিতেই হয়। বিধিনিষেধ, সীমাবদ্ধতা, আইনি ও সামাজিক বাধার কারণে পেশা ছেড়ে দেয়া বা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার অবস্থা নেই। কখনো তার ক্ষুরধার তথ্য সংবলিত সংবাদ, কখনো তথ্য ঘাটতি, কখনো অসত্য-অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশনের কারণে তাকে আইনের কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হয়। অর্থাৎ তার সত্য প্রকাশ যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, অসত্য প্রচারও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক, প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার বিভিন্ন মহলের হুমকি-ধমকি এমনকি আক্রমণেরও শিকার হন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ারও খবর পাওয়া যায়। এসবের অধিকাংশই মানহানি মামলা। দণ্ডবিধির ৪৯৯ থেকে ৫০২ ধারায় মানহানি এবং সুনাম নষ্টের অভিযোগে মামলার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া দেওয়ানি ফৌজদারি আদালতেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা হয়। এ ধরনের মামলায় সাজা ভোগের চেয়ে হয়রানি ভোগান্তি বেশি। সংশ্লিষ্ট মামলাবাজরা এসব মামলা করেন মূলত সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশকদের হয়রানি, নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে। মামলার রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। তাদের উদ্দেশ্য নয়। সংবাদ প্রকাশের কারণে সাংবাদিকরা কখনো কখনো হামলার শিকারও হন। কখনো হামলার আশঙ্কায় পালিয়ে বেড়ান। হামলা-মামলায় আক্রান্ত হওয়ার পর চাকরিচ্যুতির অভিশাপ নেমে আসার মতো অমানবিক ঘটনাও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের কৃতকর্মের দায় এক পর্যায়ে তার প্রতিষ্ঠান বহন করতে চায় না।
আবার কখনো কখনো নিজ কর্মস্থল এবং পেশাগত কমিউনিটিতেও ঝামেলায় পড়তে হয় সাংবাদিকদের। অভিজ্ঞতা এবং কৌশলের আলোকে এ ধরনের ঝামেলা যেমন এড়নো যায়; প্রতিকারও করা যায়। আবার মোকাবিলাও করা যায়। এ ধরনের অতীতবর্তমান কিছু ঘটনার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একটু সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করলে এসব মামলা-হামলা-ঝামেলা এড়ানো সম্ভব। নমনীয় ভাষায়ও কঠিন কথা বলা যায়। কৌশল মতো ন্যূনতম তথ্য বিন্যাস করে অডিয়েন্সকে সর্বোচ্চ তথ্য দেয়া যায়। বিষয়টি একান্তই কলাকৌশল নির্ভর। আর এসব কলাকৌশল সাংবাদিকতাকে প্রকারান্তরে সাবধানী-সংযমির মাধ্যমে শক্ত ভিত্তি দেয়।
সাধারণ কোনো লেখা বা গদ্য-পদ্যে ভাব প্রকাশ করা মুখ্য। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে ভাব প্রকাশ যথেষ্ট নয়। তথ্য দিয়েতা সুনির্দিষ্ট করতে হয়। ভাষা সহজ-সাবলীল এবং ত্রæটিমুক্ত করার ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে সংবাদমাধ্যম। নিয়ম, বানান, ব্যাকরণ সব মিলিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো ভাষার যে গতি সৃষ্টি করে অন্য কোনো মাধ্যমে এভাবে তা সম্ভব নয়। ভাষাবিজ্ঞানী বা ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষেও অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। লক্ষ কোটি মানুষ তা পড়বে, শুনবে, দেখবে। পাঠক, শ্রোতা, দর্শকদের মধ্যে অশিক্ষিত, কম শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষই রয়েছেন। অন্য ভাষার লোকও রয়েছেন। সবার কথা বিবেচনায় রেখে সংবাদমাধ্যমে ভাষা সাজাতে হয়। সমাজে গণমাধ্যমের শব্দ ও ভাষার শক্তি কখনো কখনো অভিধানের চেয়েও বেশি। গণমাধ্যমে কোনো ভুল শব্দ বা বাক্য কিছুদিন প্রচার হতে থাকলে সেটা সমাজে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। ভাষা বিজ্ঞান, শব্দ বিজ্ঞান, ব্যাকরণের পণ্ডিত কারো পক্ষেই তখন ওই ভুলের বিপরীতে শুদ্ধ অবস্থান কঠিন হয়। মানুষ গণমাধ্যমে প্রচারিত শব্দকেই বেশি আমল দিতে চায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওসামা বিন লাদেন এর কথা। এ নামটির অর্থ তিনি লাদেনের ছেলে; তার নাম ওসামা। অর্থাৎ তার পিতার নাম লাদেন। কিন্তু মিডিয়ার ভুল প্রচারে ওসামা হয়ে গেছেন লাদেন। পিতার নামে হয়ে গেছে পুত্রের নাম। সারা দুনিয়াতে এ ভুলটি প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায় ওয়ান ইলেভেনের কথা। ১১ জানুয়ারির সংখ্যাগত পরিচয় হওয়ার কথা ইলেভেন ওয়ান। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে অতি ব্যবহারের ফলে ওয়ান ইলেভেন-ই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠিত এ ধরনের ভুল শুধরানোর চেষ্টা সুফল দেয় না। এ কারণে বলা হয়ে থাকে- সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ভাষা শুদ্ধকরণে অভিধানের চেয়েও শক্তিশালী। স্বাভাবিকতা চাইলে অবারিত না করে শক্তির নিয়ন্ত্রণ জরুরি। আর নিয়ন্ত্রিত শক্তির ফল হয় শুভ।

মোস্তফা কামাল
সাংবাদিক ও কলাম লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়