যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

জাতীয় উন্নয়ন নীতি-দর্শন ও বাস্তবতা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশে অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। নানান শঙ্কা ও সমালোচনার মধ্য দিয়েও পদ্মা সেতুর ন্যায় চ্যালেঞ্জিং মেগাপ্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। অনুরূপভাবে মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু টানেল, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, গাজীপুর ঢাকা মাস র‌্যাপিট টানজিট, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, একাধিক পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ কর্মযজ্ঞ চলছে। জাতীয় একাধিক মহাসড়ক ফ্লোর লেনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। আমাদের মতো বিকাশমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বদলে যাওয়া জীবনমান উন্নয়নের ধারণায় বেশ নাড়া দিচ্ছে। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নের ফলে জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এসব উন্নয়নের ফলে সরকার প্রশংসিত। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারই আত্মজা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রের এই অগ্রগমনে জাতি অনুপ্রাণিত। তারপরও রাষ্ট্র সমাজে বিদ্যমান ও অনাগত প্রজন্মের জন্য কতটা উন্নত মানসিক চিন্তাবোধসম্পন্ন রাষ্ট্রকাঠামো-জীবনমান নির্ণয় করতে পারছে, সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
উন্নয়নের ধারণায় শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে প্রকৃত উন্নয়নকে নির্দেশ করে না। উন্নয়ন তখনই সুদৃঢ় হয়, যখন রাষ্ট্রকাঠামোয় বসবাসরত নাগরিকরা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ভালোমন্দের পার্থক্য বুঝতে শেখে, মূল্যায়ন করতে জানে। এই শিখা-জানার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে জাতীয়বোধ ও দেশপ্রেম জাগ্রত হয়; বিদ্যমান উন্নয়ন টেকসইকরণে নাগরিকরাই ধারাবাহিকভাবে কাজ করে। এ ধারণা থেকে নিঃসকোচে বলা যায়- রাষ্ট্রের নাগরিকদের চিন্তার গভীরতা সৃষ্টি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিই প্রকৃত উন্নয়ন। দার্শনিক সক্রেটিস যথার্থ বলেছিলেন, দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব জাদুতুল্য। তার এই মতদর্শন থেকে দেহ হিসেবে আমরা দেশকে বিবেচনায় নিলে চিন্তার সৌন্দর্যের বাহক হিসেবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের চিহ্নিত করতে পারি। সঙ্গতই, রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের পারস্পরিক উন্নয়ন দর্শন পরিক্রমাই উন্নয়নকে টেকসইকরণে উৎসাহ জোগায়। কেননা, জাতীয় উন্নয়নের সুফল প্রত্যেক নাগরিকের প্রাপ্য।
আভিধানিকভাবে বিভিন্ন অর্থে উন্নয়ন বিশ্লেষণ করা যায়। সমার্থক অর্থে উন্নয়ন বলতে উন্নতি, উন্নয়ন, বর্ধন, পরিবর্তন, ক্রমবৃদ্ধি, উত্তেজনা, উদ্দীপনা, বিকাশ ইত্যাদি বুঝায়। সেই অর্থে উন্নয়ন বলতে কোন কিছুর কাক্সিক্ষত পরিবর্তন বা উত্তরণ বা ইতিবাচক উন্নতিকে বুঝায়। অমর্ত্য সেনের মতে, ‘উন্নয়ন হলো মানুষের স্বাধীনতাকে সম্প্রসারণ করার প্রক্রিয়া’। তিনি প্রমাণ করেছেন শুধু নি¤œ আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার পশ্চাৎমুখিতাই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। নাটা বলেছেন, ‘উন্নয়ন হলো প্রচ্ছন্ন উৎপাদনের একটি প্রসারণ’। অর্থনীতিবিদ কিল্ডালবার্গার ও হেগেলে বলেছেন, ‘উন্নয়ন হলো কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে উৎপাদন বৃদ্ধি’। অন্যদিকে বয়ার ও ইয়ামের মতে ‘উন্নয়ন হলো জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধাদির পছন্দগত সম্প্রসারণ’। এসব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি স্পষ্ট- উন্নয়ন সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে তারা কিসের উন্নয়ন চান, কি ধরনের উন্নয়ন চান এবং তা কীভাবে অর্জন করতে হবে, সে বিষয়ে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকতে হবে। নচেৎ বাস্তবতা বিবেচনায় কাক্সিক্ষত উন্নয়ন বা সমাজ রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না।
আধুনিক উন্নয়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি, ইতিবাচক পরিবর্তন বা ভৌত, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক ও জনসংখ্যার উপাদান সংযোজন সৃষ্টি করে। উন্নয়নের উদ্দেশ্য থাকতে হবে পরিবেশের সম্পদের ক্ষতি না করে জনসংখ্যার স্তর ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় আঞ্চলিক আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বা সম্প্রসারণ করা। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এসে উন্নয়ন সম্পর্কে একটা পরিচ্ছন্ন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর উন্নয়ন বিশ্বের জনসংখ্যার জীবনযাত্রার স্তর বা মান বৃদ্ধি করে না, বরং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমন একটি চ্যানেল সৃষ্টি করবে, যার প্রভাবে জনসংখ্যার বিভিন্ন স্তরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনবে।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন উন্নয়নকে সামর্থ্যরে দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি উন্নয়নকে একটি হাতিয়ার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, এটি কর্মের স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর জন্য সক্ষম করে তোলে। বিপরীতে জেফরি শ্যাক্সের মতো পেশাদার অর্থনীতিবিদ অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দারিদ্র্য স্থায়িত্বের উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন হলো গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার। তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উন্নয়ন প্রক্রিয়া গ্রহণ ও টেকসইকরণে বেশি মনোনিবেশ করেন। উন্নয়ন কল্পকদের ধারণামতে, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির উন্নতি মানুষের মানবিকতা উন্নয়নের সমানুপাতিক। কারণ এর সবই মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠে। মানুষকে কেন্দ্র করে সমাজ রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। সমাজ রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থনে যথার্থ নেতৃত্বেই পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে মানবকল্যাণে উন্নত-সমৃদ্ধ জীবনব্যবস্থা।
প্রখ্যাত লেখক বব জোহানসেন তার ‘লিডার মেক ফিউচার’ গ্রন্থে স্পষ্ট ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, একজন নেতা তার জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নেতার কর্ম, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায় নির্ভর করে জাতি বা শ্রেণি গোষ্ঠী কোন পথে ধাবিত হবে। বর্তমান বিশ্বপরিমণ্ডলে যেসব দেশ ও জাতি বিশ্বসমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন; কিংবা জাতিকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ উপযোগী করেছেন, ওই সব দেশের জন্মবিকাশের নেতৃত্ব বর্তমান বাস্তবতা নির্মাণ করে গেছেন তাদের উন্নয়ন দর্শনে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দলিলে উন্নয়ন দর্শন হিসেবে জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তবাজার পুঁজিবাদ ও সীমিত সরকারি হস্তক্ষেপের আদর্শকে কেন্দ্র করে তৈরি করেছিলেন। এই উন্নয়ন দর্শনে উদ্যোক্তা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর শক্তিশালী জোর দিয়েছেন, যেখানে সীমিত সরকারি হস্তক্ষেপ গৌণ করে দেখা হয়েছে। অন্যদিকে, জাপানের উন্নয়ন দর্শনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণের ওপর কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জাপানি অর্থনৈতিক অলৌকিকতা। যেখানে গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। জার্মানি উন্নয়ন দর্শনে স্থায়িত্ব, উদ্ভাবন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। যেটি গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর দৃঢ় লক্ষ্য করাসহ উচ্চমানের পণ্য এবং পরিষেবার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়। চীনের উন্নয়ন দর্শনে চীনা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের ধারণাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেখানে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, দারিদ্র্য হ্রাস ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রসারকে। সিঙ্গাপুরের উন্নয়ন দর্শন ব্যবহারিক প্রগতিবাদকে কেন্দ্র করে নেয়া হয়েছে। যেখানে সামাজিক ও পরিবেশগত বিবেচনার সঙ্গে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের সারকথা ছিল মানুষের উন্নয়ন, কোনো গোষ্ঠী বিশেষের উন্নয়ন নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষায় বিনিয়োগ সরকারের দায় ও দায়িত্ব। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনাতে তিনি মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যেটি অকাট্য প্রমাণ মেলে প্রথম শিক্ষা কমিশনকে প্রদত্ত নির্দেশনায়। তিনি শিক্ষা কমিশনের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি চাই আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা’। এ ক্ষেত্রে আধুনিককালের উন্নয়ন গবেষক ও বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শের সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে- উন্নয়ন ধারণা বা বঙ্গবন্ধু দর্শন মেনে আমরা কতটা উন্নয়নের পথে হাঁটছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের ধারক হিসেবে প্রায়ই বলেন, রাজনীতি করি একটা আদর্শ নিয়ে। বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব, সে স্বপ্ন আমার রয়েছে। যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষকে দেখিয়েছিলেন।
জাতির জন্মদর্শনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। সেই উন্নয়নের প্রাথমিক ধারণায় আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান নাগরিক সৃষ্টির প্রয়াস নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, উন্নয়ন পরিক্রমাকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন করতে না পারলে উন্নয়ন ভেতর থেকে ঘুণে ধরে যায়। সেই উন্নয়নে মুষ্টিমেয় শ্রেণি লাভবান হলেও ভেতর থেকে রাষ্ট্রটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি চাইতেন বাংলাদেশের মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে পড়ে সুখে থাকবে। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্রে রূপ নেবে। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন অভিযাত্রায় অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুর্নীতি। যে অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে তাকে ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ধারা অব্যাহত না থাকায় দুর্নীতি তৃণমূলে বিস্তার ঘটেছে। বলতে হয়, দুর্নীতি নাগরিকদের মনন জগতে স্থায়ী বাসা বেঁধেছে। দুর্নীতিপ্রসূত উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাংলাদেশে অনেক অপচয় ও অপব্যয় হচ্ছে। মোটা দাগে বলতে গেলে, উন্নয়ন প্রকল্প সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের নামে আমলাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ, মহানগর ও নগরীর রাস্তার আইল্যান্ড, ফুটপাত বারবার ভাঙাগড়া, হাসপাতাল ও মেগাপ্রকল্পের জন্য চড়া দামে উপকরণ ক্রয়, নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্প সমাপ্ত না হওয়া, প্রকল্প অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ভুল, প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপনে অপ্রত্যাশিত ব্যয়, সংযোগ সড়ক ছাড়া ব্রিজ নির্মাণ, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত জনবল ছাড়া অবকাঠামো নির্মাণ, নির্মাণকাজের মান ঘাটতি, নদী শাসন ও নদী তীর রক্ষায় নদ-নদীর অপমৃত্যু, উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাঁধবিলীন, মহাসড়ক নির্মাণের পরের বছরে ছেঁড়া কাঁথার ন্যায় জোড়াতালির সংস্কার উন্নয়নে অপদৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, জনমত উপেক্ষা করে প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলেও রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক অপচয় হচ্ছে। যেমন এয়ারপোর্ট রোড সৌন্দর্যবর্ধনের নামে চায়না থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বনসাই গাছ কেনা হলো। এ ধরনের সৌন্দর্যবর্ধন জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে বিধায় সর্বমহল থেকে প্রচণ্ড প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল। কিন্তু সর্বসাধারণের প্রতিবাদ আমলে না নিয়ে বনসাই রোপণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে কোটি টাকা ব্যয়ে। অথচ কয়েক বছর না যেতেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রয়োজনে ওই সব দামি বনসাই গাছ ও সৌন্দর্যবর্ধন ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, উন্নয়ন পরিকল্পনায় উন্নয়ন সহযোগী/অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের অযাচিত শর্ত পূরণ করতে গিয়ে জনস্বার্থবিরোধী অনেক কিছুই হচ্ছে। যেখানে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ হচ্ছে না। উন্নয়নের নামে জাতীয় অর্থের যে অপচয় হচ্ছে, এর দায়ভার কে নেবে?
যে কোনো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক স্টাডি ও গবেষণার প্রয়োজন হয়। বাস্তবে সেটি বেশি পরিলক্ষিত হয় না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বা বাস্তবায়ন-পরবর্তী সময়ে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণের অপরিহার্য হয়ে পড়ে। খোলামেলা ভাষায় বলা যায় অনেক প্রকল্প যেন বাস্তবায়ন করা হয় আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য। ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে অনেকগুলো ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। তারপরও ফ্লাইওভারমুখী সড়কে কাক্সিক্ষত যানজট নিরসন হয়নি। অথচ ক্রসিং পাসে ফ্লাইওভারগুলো দীর্ঘায়িত না করে বহুমুখী করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বিমানবন্দর-সংলগ্ন বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের ৯০ ভাগ কাজ শেষ হলেও ভেঙে ফেলতে হয়েছে ভুল নকশার অজুহাতে। এটা জাতীয় অপচয়। হাওর অঞ্চলে উন্নয়নের নামে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে হাওর অঞ্চলগুলো অকাল বন্যায় পড়বে; সেটি সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের মাথায় আসেনি। যার মাশুল দিচ্ছে জাতি। সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক নির্মাণের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে স্বয়ং সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বলেছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণের এক বছরের মধ্যে ছেঁড়া কাঁথার মতো জোড়াতালি দিয়ে চালু রাখতে হচ্ছে। এটা শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নয়, প্রান্তিক পর্যায়ের সড়কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা শুধু অপচয় নয়, এক ধরনের দুর্নীতিও বটে। এই দুর্নীতি ব্যক্তিবিশেষ শ্রেণিকে ধনী করছে, কিছু সামষ্টিকভাবে জাতিকে করছে দরিদ্র।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশিত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে বঙ্গবন্ধু উন্নয়ন নীতি দর্শন কঠোরভাবে অনুসরণের বিকল্প নেই। প্রযুক্তি বিকাশের চলমান সময়ে সব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে প্রযুক্তিভাবনাযুক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যতদূর সম্ভব সব প্রকল্প বাস্তবায়নে বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এর জন্য উপযুক্ত মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। যেখানে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষাদর্শন শতভাগ বাস্তবায়ন অপরিহার্য। সর্বোপরি, উন্নয়ন সহযোগী অর্থলগ্নিকারী সংস্থার ঋণ গ্রহণে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা, তাদের শর্তযুক্ত ঋণ দিয়ে কোনো দেশই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বহু দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। দেউলিয়াত্বের উন্নয়নের কুফল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভোগ করতে হয়। সেটি শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের চিত্র থেকে অনুমেয়।
টেকসই উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট মানুষের সততা প্রয়োজন। মানুষই এ লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। একটি সফল অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলের জন্য অবশ্যই কর্মশক্তির দক্ষতার উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। একথা সর্বজন স্বীকৃত স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি উন্নয়ন ও সুশাসনের প্রধান শত্রæ। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য উন্নয়ন পরিক্রমায় শুধু অবকাঠামো নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে। দেশ ও জাতির জন্য উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। সেই উন্নয়নের কৌশল যাত্রায় অপচয় রোধ ও দুর্নীতি হ্রাসে মূল হাতিয়ার হতে হবে দেশের মানবসম্পদ। সেই মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিকাশ ও প্রয়োগে আমাদের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ ও কাজ এখনই শুরু করতে হবে। নচেৎ দেশপ্রেম, সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার অপ্রতুলতায় আগামী প্রজন্ম বর্তমান উন্নয়ন ধারা ধারণ করতে ব্যর্থ হবে। মুখ থুবড়ে পড়বে বর্তমান অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। যা কারো প্রত্যাশিত নয়। বিষয়টি বোদ্ধামহল বিবেচনায় নিলে জাতি বেঁচে যাবে।

এ কে এম এ হামিদ
উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়