যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

জীবন প্রবাহে বাউল দর্শন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাউল শব্দটি শুনতেই আমাদের মনে দারুণ রকমের আবেগ সৃষ্টি হয়। কল্পনার গহীনে কখনো দেখে নিই বাংলা প্রকৃতির মাঝে একতারা হাতে গেয়ে যাওয়া কোন মানুষ। যার কণ্ঠে মিশে আছে বাঙলার প্রকৃতি, দেহ মাটির গান; কখনো কখনো সে গান অর্থের বিশালতায় বাংলা ছাড়িয়ে বিশ্ব সঙ্গীত কিংবা ‘মানুষের গান’র আবেদন হৃদয়ে দাগ দিয়ে যায়। একান্তভাবেই জীবন স্বার্থহীন, প্রকৃতির সন্তান। আর এই উপজিব্যতা বাউল ধারণ করে বলেই সে ফিরে যায় প্রকৃতির কোলে। যেখানে কোন শাস্ত্রীয় সাম্প্রদায়ীকতা নেই। যুক্তির আঁচড়ে লেখা আছে কিংবা বোধের উৎকুষ্টতায় সভ্যতার সীমবদ্ধতাকে দূরে ঠেলে, আঁধার ঘরের বাতিতে ‘মনের মানুষ’ খোঁজার তীব্র আগ্রহ-বাসনা আছে বাউলের।
আধার ঘরে জলছে বাতি দিবা রাতি নাই
সেখানে মনের মানুষ যেখানে
কি সন্ধানে যাই সেখানে আমি মনের মানুষ যেখানে \
যেতে পথে কাম নদীতে পারি দিতে ত্রিবিণে
ধনীর ধারা যাচ্ছে যাচ্ছে মারা, পড়ে নদীর ঝড় তুফানে \
রসিক যারা চতুর তারা, তারাই নদীর ধারা চেনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে, তারাই স্বরূপ সাধন জানে \
লালন বলে মইলাম জ্বলে, মইলাম আমি নিশিদিনে
মনের মানুষ দূরে রেখে, দেখ স্বরূপ নিহারণে \
“সহজ সরল ও প্রাকৃত জীবনযাত্রী শ্রেণীহীন এক শ্রেণীর মানুষ সাধারণত বাউল নামে পরিচিত। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাদের স্বতন্ত্র উপলদ্ধিই ‘বাউল তত্ত্ব’ হিসেবে খ্যাত।” তত্ত্বের আগে বাউলের অর্থ দেখে নেয়া দরকার। সহজ-সরল জীবন যাপন করার অপর সামাজিক নাম (!) হল বাহ্যজ্ঞানহীন কিংবা এমন অর্থের আরো বিশেষণ। এ প্রসঙ্গে ও উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্থ বলেছেন, “পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, ধর্ম বিশ্বাস, কর্ম সাধনা ইত্যাদি দিক দিয়ে যারা সমাজে বসবাসকারী অন্যান্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র, যারা আপন ভাবে মশগুল সমাজে ও উন্মাদ তারা বাউল।” অর্থাৎ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সাধারণ এবং স্বাভাবিকতাকে অতিক্রম করা মানুষই বাউল বা ক্ষ্যাপা হিসেবে পরিচিত। আর এই মানুষগুলো স্বতন্ত্র ভাবনা, উপলব্ধি কিংবা জীবনবোধের প্রকাশই তাদের দর্শন। যার নাম বাউল তত্ত্ব। এখানে একটা বিষয়ক স্পষ্ট হয়েছে যে ‘বাউল’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সাথে বর্তমান অর্থের বৈপরীত্য ঘটেছে বা অর্থান্তর হয়েছে। বাউল গান শুধু গান নয়; এর ভেতরে রয়েছে তত্ত্বের কথা, যা বাউল দর্শনরূপে প্রতীয়মান।
গবেষকদের মতানুসারে এই মতের উৎপত্তি সতের শতকের গোড়ার দিকে। মাধব বিবি নামক এক রমনীর কাছ থেকে বীরভদ্র এট মতের দীক্ষা-শিক্ষা নেন এবং প্রচার করেন। এই সময়টাও ছিল বাংলা লোক দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। চৈতন্য পরবর্তী সময়ে যখন বৈষ্ণব ধর্মে ব্রাহ্মণ প্রভাবে অস্থিরতা বিরাজ করছিল এবং তখন সমাজের নি¤œ শ্রেণির বৈষ্ণববেরা আপন ধর্ম ত্যাগ করে নানা মতের জন্ম দিয়েছিল। সে তালিকাও নেহায়েত কম নয় তবে প্রতিটা লোক ধর্মই ছিলকোন না কোন ভাবে বৈষ্ণব প্রভাবিত। মাধববিবির গুরু ছিলেন আউল চাঁদ যিনি কর্তাকজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু। আর বীরভদ্রের পিতা নিত্যানন্দ (১৪৭৩-১৫৪৪) ছিলেন চৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) সহচর। মাধবিবির কাছ থেকে এইমত গ্রহণের কারণে বীরভদ্রকে ত্যজ্য করেছিলেন নিত্যানন্দ। এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায় বাউল মত অন্যান মত থেকে ভিন্ন । কর্তাভজা সম্প্রদায়ের পীঠস্থান ঘোষপাড়া। চব্বিশ পরগণা ও নদীয়া জেলায় প্রায় সঙ্গমস্থলে কাঁচাড়াপাড়া স্টেশনের পাঁচমাইল ভিতরে ঘোষপাড়ার অবস্থান। এই স্থানেই বাউল মতের উৎসস্থান হিসেবেও স্বীকৃত। কিন্তু এ মতের বিকাশ তৎকালে কর্তাভজা কিংবা অন্যান্য লোক ধর্মের মত হয়নি। তবে এ ধর্মের চলছিল ব্যাপ্তী দীর্ঘ না হলেও।
ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুরের সিরাজ সাঁই একই গ্রামের লালনকে এই মতের দীক্ষা দিয়েছিলেন। লালন-সিরাজ পূর্ব সময় থেকেই হরিশপুর বর্ধিষ্ণু এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত চিল। কুমার নদীর সংযোগে বাটিকামারা বিলের পূর্বপাশের এই গ্রামটিতে নানা ধর্ম মত পথের মানুষের বসবাসও ছিল। ছিল সংস্কৃতির উৎকর্ষতা। এ পরিবেশ লালনকে প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রে প্রভূত অবদানও রেখেছিল। এখান থেকেই তার গান শেখা, গান বাধায় হাতে খড়িও। লালন সমকালে এ গ্রাম এবং এর আশপাশের এলাকায় লোক পদকর্তাদের চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। মোটা দাগে উল্লেখ করা যায় দুদ্দু সাঁই (১৮৪১-১৯১১), পঞ্জু শাহ (১৮৫১-১৯১৪), জহরদ্দীন সাঁই (১৮৪২-১৯০৮), যাদু বিন্দু, রাধাকৃষ্ণ গোঁসাই, সৈয়দ শাহ এর মত প্রতীভা সম্পন্ন পদকর্তার জন্ম। সিরাজ সাঁই এর দেখানো পথে বুৎপত্তি আর্জনের পর গুরুর নির্দেশেই লালন এলাকা ছাড়েন এবং কুষ্টিয়ায় ছেউড়িয়ায় জনমানবহীন জঙ্গলে ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা শুরু করেন।
তার সহিংস অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং দর্শনের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যা পরবর্তীতে এক বৃহৎ রূপ ধারণ করে। বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর জেলায় গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে তার দর্শন। বাঙালির ভাব জগতের চিন্তা ক্রম বিকশিত হতে থাকে লোক মানুষের সহজ জীবনবোধ হিসেবে। লালনের আত্ম অনুসন্ধান জীবনের জটিলতা থেকে নিস্কৃতির সহজ মাধ্যম হিসেবে যখন গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখনই শাস্ত্র ধর্মের খড়গ এসে পড়েছে তাঁর এবং তাঁর ভক্ত অনুসারীদের উপর।
আপনারে আপনি চিনি নে
দীন দনের পর, যায় নাম অধর
তারে চিলব কেমনে
আপনারে চিনতাম যদি হাতে মিলত অটল নিধি
মানুষের করণ হত সিদ্ধি শুনি আগম পুরাণে
কর্তারূপের নাই অন্বেষণ আত্মারে কি হয় নিরূপন
আত্মতত্ত্বে কি পাই সাধুধন সহজ সাধক জনে
দিব্যজ্ঞানী যেজন হল নিজ তত্ত্বে নিরঞ্জন পেল
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় লালন রইল
জন্ম অন্ধ মনগুণে।
বাঙালির ধর্ম চিন্তার আদিরূপে এমনই নির্মল। সহজ সাধনাই জটিল সাধনা, কারণ সভ্যতা আধুনিকতার দোহায় এবং মানুষের ভেতরে শ্রেণি বিভেদের রেখা টেনে জীবনকে আমরা কঠিন করে তুলেছি। এই জীবনের যারা নিয়ন্ত্রা তারাই মূলত লালন বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিল লালনের কালে এবং তাঁর উত্তরকালেও।
মজার ব্যাপার হল লালনের মত-পথকে আমরা বাউল দর্শন বলে অভিহিত করি কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। সতের শতকে যে দর্শনের জন্ম হল এবং লালনে এসে পূর্ণতা পেল সেটা আসলে নামহীন অবস্থাই ছিল লালন পর্যন্ত। মাধব বিবি কিংবা বীরভদ্র কিংবা তৎপরবর্তী সাধকগণও এর কোন নাম দেননি এমনকি লালনও। লালন জীবিত থাকতেও হয়তো এটির দার্শনিক নাম যে বাউল সেটা শুনে যাননি। শুনলে হয়তো তার মন্তব্য থাকত গান থাকত। আসলে তিনি সাধক ছিলেন সাধনায় ছিলেন যেখানে তাঁর ব্যক্তিগত কিংবা তাঁর প্রচারিত দর্শনের নামে দিয়ে যান নি। বিষয়টি ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত যেকোনটি হতে পারে। তাঁর সেই শূন্যতা পূরন করেছে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য দুদ্দু সাঁই। দুদ্দু সাঁই তাঁর গুরুর জন্মবৃত্তান্ত যেমন প্রকাশ করেছেন তেমনি জনিয়ে গেছেন তাঁর প্রচারিত দর্শনের নাম বাউল।
যে খোঁজে মানুষে খোদা
সেই তো বাউল
বস্তুতে ঈশ্বর খোঁজে পায় তাহার মূল \

পূর্ব পূন জন্ম না মানে
চক্ষু দেয় না অনুমানে
মানুষ ভজে বর্তমানে হয়রে কবুল \
বেদ তুলসী আর মলো টেপা
এসব লোকে বলছে ধোকা
শযতানে দিয়ে ধাপ্পা সব করে দেয় ভুল \
এই মানুষে সকল মেলে সেই কথা বলে বাউলে
অধীন দুদ্দু কী আর বলে লালন সাঁইজি কুল \
এ গান প্রকাশ্যের পরই জানা গেল লালনের গানগুলো যে দর্শনকে প্রকাশ করেছে সেটার নাম ‘বাউল’। এখান থেকেই বাউল শব্দের বিভিন্ন বিশেষণবোধক অর্থ থেকে বিশেষ্যে রূপান্তর হয়েছে। সেই থেকে ‘বাউল’ হল দর্শন।
বাউল স¤্রাট লালনের জীবদ্দশাতেই তাঁর মতদার্শের প্রসরতা ছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর এর প্রসারতা আরো বৃদ্ধিপায়। জন্মস্থান এবং সমাধি স্থান উভয় জায়গাতেই লালন তীর্থের স্বরূপ লক্ষ করা যায়। ছেউড়িয়ায় লালনের সমাধিতে তার জন্ম-মৃত্যু দিবসে দুটি উৎসব অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটন, ভক্ত, অনুসারীদের সমাগম ঘটে। অপর দিকে লালন গুরু সিরাজ সাঁই এর মাজারে (ঝিনাইদহের হরিশপুর) প্রতি বছর লালন স্মরণে স্মরণোৎসব হয়ে থাকে। সেখানেও দর্শনার্থীদের মুখরিত পদচারণা দেখা যায়। এখানে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত লালন একাডেমি বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে এতকিছুর পর বাউল দর্শনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সুধি সমাজের হতাশা বিরাজমান। দুর্বল চিত্ত কিংবা সংখ্যালঘুর কারণেই হয়তো তারা প্রতিবাদী
নয় কিংবা আরো আরো নেতিবাচক কথা তাদের প্রসঙ্গে বলা যায়। তাদের ঘৃণিত করার নানা মনগড়া অপরাদও হয়তো তাদের দেয়া যাবে। আমাদের প্রথমত ভেবে দেখা দরকার বাউল পদাবলীর প্রতিটি গানই আত্ম উৎকর্ষেরর বাণী শোনায় বা বহন করে। তারাতো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তি কিংবা বোধের উৎর্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে চায় নি, কারো উপরে দর্শনের খড়গ চাপিয়েও দেয়নি। বাউল দর্শন সচেতন প্রজ্ঞায় গ্রহণ করতে হয়। এটি পৈত্রিক সূত্রেও প্রাপ্ত হওয়া যায় না আবার জন্ম সূত্রেও লাভ করা যায় না। একান্ত সমগোত্রীয়দের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার এ দর্শন হয়তো ক্ষয়ীষ্ণু দর্শনের অপবাদ দেয়া যাবে কিন্তু মৃত বলা যাবে না। ১৯৮০ সনে ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহে বাউল জরিপ করা হয়। যার মাধ্যমে জানা যায় ঝিনাইদহে ১৫০ জন, চুয়াডাঙ্গায় ১২৭ জন, মেহেরপুর ১৮০ জন এবং কুষ্টিয়া ২৭০ জন মোট ৯০৫ জন ত্যাগী বাউল। এছাড়া উক্ত জরিপে গৃহী বাউল সংখ্যা দেখানো হয় ১২,০০০ (বারো হাজার) যদিও তারপর আর কোন প্রতিষ্ঠান এমন জরিপ করেছে কিনা তা জানা যায় নি তবে এর সংখ্যা কমায় সম্ভাবনা খুবই কম। বাউলদের উপর আঘাত লালনের সমকালেও ছিল বর্তমানেও আছে। আধুনিক মিডিয়ার কল্যানে বাউলদের উপর কোথাও অসম্মানজনক কিছু হলেই আমরা জানতে পারি এবং প্রতিরোধ প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
বাউল যে অসাম্প্রদায়িক দর্শন সেটা মূলত অসাপ্রদায়িক নয় সেটা তাদের মতো করে সাম্প্রদায়িক। তাদের বিশ্বাসেও ঈশ্বর আছেন। তবে স্থান-পাত্র আলাদা। তাদের বিশ্বাস আর শাস্ত্রাচারীদের বিশ্বাসের বৈপরিত্যেই মূলত সামাজিক দ্বদ্বের সূচনা হয়। সাম্প্রদায়িক উগ্রতা সম্পন্ন শাস্ত্রধর্মীরা অতি উৎসাহে মূলত এই অস্থিরতাগুলো সৃষ্টি করে থাকেন। যাতে সমাজের সংখ্যাধিক্য মানুষেরই সমর্থন নেই। তাদের উপর নানা ধরনের আঘাতের কারণে হয়তো অনেকের ধারণা এমন যে বাউলেরা তাদের দর্শানিক বিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এমনটি ভাবার কোন কারণই নেই। দু’-একজন অসৎ গুরু কিংবা অসৎ ভক্তের কারণে জন্ম নেয়া নেতিবাচক ধারণাগুলো বৃহৎ অর্থে সঠিক নয়। দীর্ঘদিন বাউলদের সমঝদার হয়ে তাদের সাথে ঘুরে কিংবা সাধু সঙ্গে মিশে দেখেছি তাদের ভেতরে ছাঁচে পরিশুদ্ধ হওয়ার যে মন্ত্রণা দেওয়া হয় তাতে জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
পাপ পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধায়
এক দেশে পাপ পুণ্য
অন্য দেশে পুণ্যি তায়
শুকর গরু দুটি পশু খাইতে বলেছেন যিশু
তাই শুনে কেন মুসলমান হিন্দু
বিভেদে জড়ায় \
তিব্বত নিয়ম অনুসারে একনারী বহু পতি ধরে
এই দেশেতে হলে পরে
ব্যাভীচারী দণ্ড দেয় \
দেশ সমস্যা অনুসারে ভিন্ন বিধান হতে পারে
লালন বলে তাই জানিলে
পাপ পুণ্যের আর নাই বালায় \
বর্তমানে অধিকাংশ বাউল গান শুধু বাউলদের সাধন সংগীতের মধ্যে সমীবদ্ধ নেই, এ গান এখন সমকালের গণসংগীত। সমাজ জীবনে দারুণভাবে প্রভাবিতও। এক সময় যে গান মূল বঙ্গের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল সে গান আজ সকল বাঙলাভাষির কাছেই দারুণ গ্রহণযোগ্য। কোন বাড়িতে হয়তো কোন বাউল নেই কিন্তু বাউলের গান আছে, সে গানের প্রভাবও আছে। বাউল গান তার আত্ম শক্তির ধারা বিকাশিত করছে এভাবেই। হয়তো বয়াতি বাউলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না তবে বাউল দর্শনের ধারণ করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
প্রতিবদ্ধকতাও যে নেই তা নয়। নাম ভূমিকার ‘বাউল’ শব্দটিও নানা সময়ে ভিন্নার্থে প্রয়োগ হচ্ছে। যেহেতু বাউল ব্যক্তি এবং দর্শন দুই অর্থই প্রকাশ করে সেখানে ‘বাউল’ শব্দটি অপব্যবহারে দুষ্ট হচ্ছে প্রয়সই। গায়কেরা অনেক সময় নিজের গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য নামের আগে বাউল শব্দটি জুড়ে দিচ্ছে অথচ দেখা যায় অনেকের গুরুপাটই নেই অথবা বাউল কী তাই বোঝে না। আবার গবেষণা প্রভাবেও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বোদ্ধা মানুষেরা প্রভাবিত হয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অনেক সময়। হিন্দু বাউল, মুসলমান বাউল, সুফি, দরবেশ, নেড়া, ফকির, সাঁই, গোঁসাই বিভিন্ন প্রকার ভেদ কিংবা বিভা,নে বাউল দর্শনের প্রকৃতি হারাচ্ছে। অনেক গবেষকই বলছেন বাউল একটি দর্শন তাহলে তার গায়ে হিন্দু মুসলমান সহ নানা শাস্ত্র ধর্মের চাদর থাকবে কেন? অনেক ক্ষেত্রে গবেষকদের ব্যক্তি বিশ্বাস চাপিয়ে বাউল দর্শনকে নিজ পক্ষীয় করার প্রয়াসও নেন। বাউল গবেষকদের অধিকাংশই এই অংশের। আবার অনেক গবেষক বলে থাকেন বাউলকে ধারণ করে বাউলকে নিয়ে লিখতে হবে। কথাটা কতটা যৌক্তিক? ধারণ করে গবেষণার ফল প্রকাশ করলে সেটা অবশ্যই প্রভাবিত হয়ে যাবে। ধারণ করা না করাটা মুখ্য নয় মুখ্য হল নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রক্ষেপণ। যে দৃষ্টিতে বাউল গবেষণা খুবই কম হয়েছে। গবেষণা দৃষ্টিভঙ্গির সীমবদ্ধতায় বাউল গানে যুক্ত হয়েছে নানা তরিকাপন্থা পদকর্তাদের গানও। বাউল স¤্রাট লালন এবং তার অনুসারীদের কিন্তু কোন তরিকপন্থা ছিল না। শুধুই ছিল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার জন্য যুক্তির অসংখ্য প্রশ্নবান।
একটা বিষয় হামেশায় লক্ষিত হয় যে লালন নামের শেষে নানা জনে নানা উপাধি নিবেশ করেন। কেউ শাহ্, কেউ ফকির, কেউ দরবেশ, কেউ সাঁই, আবার কেউ দরবেশ লালন শাহ প্রভৃতি। তবে দ্ব›দ্ব বাধে শাহ এবং সাঁই নিয়ে। তিনি কোনটা হবেন? শাহ শব্দটি প্রয়োগ করেন সুকিপন্থী সাধক এবং গবেষকগণ, এই শব্দের সাথে মুসলমান চরিত্রের আরবীয় সংযোগ তাদের উদ্দেশ্য বলেই মনে হয়। আর সাঁই শব্দটির অর্থ হল স্বামী, প্রভু, গুরু, মহাজন, পরমেশর প্রকৃতি। লালন তাঁর গুরুকে সিরাজ সাঁই নামে সম্বোধন করছেন আর দুদ্দু সাঁই তাঁর গুরুকে লালন সাঁই বলে সম্বোধন করেছেন। তারা নিজেরা কখনো শাহ শব্দটি ব্যবহার করেন নি অথচ আমরা গবেষকগণ “গড়া ডেঙিয়ে ঘাস খেয়ে” শাহ বানিয়ে দিয়েছি। মূলত সাঁই শব্দের আরেক অর্থ যিনি সৃষ্টির সামর্থ্য রাখেন। এ সৃষ্টি দৈহিক হতে পারে মানসিক হতে পারে আবার চেতনায় হতে পারে, দর্শনেরও হতে পারে। লালনের ভেতরে সিরাজ সাঁই যে সৃষ্টির উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন সেটা ছিল চেতনার, দর্শনের, আধ্যাত্মের। এই জায়গাটি পরিস্কার হওয়া জরুরি।
আবার এও পরিষ্কার হওয়া জরুরি যে, যে বাউল গানের সাথে অন্যান্য গানের সম্পর্ক এবং গানে শব্দের পারিভাষিকতাও। বাংলায় প্রচলিত বহুবিধ গানের মধ্যে বাউল গান ভিন্ন। এখানে একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাউলার প্রচলিত পাল্লা গান এবং বাউল গান অনেকে একই মনে করে থাকেন। প্রকৃত বিষয়টা এমন যে পাল্লা গান বিষয়ভিত্তিক এবং পাল্লায় জেতার অনুসঙ্গে হয়তো কখনো বাউল গান আসতে পারে তবে বাউল গান স্বতন্ত্র। এ গান একটি নির্দিষ্ট তত্ত্বকে ধারণ করে যার নাম ‘বাউল তত্ত্ব’। বাঙলার সহজ-সরল প্রাকৃত জীবন সংগ্রমী চেতনা বাউল দর্শনের তথা বাউল দর্শনধারীদের । সে উৎকৃষ্ট ধারণা ধারণ করে এখনো বঙলার পথে প্রান্তরে, অন্তরে-অন্দরে ঢুকে থাকা বাউল গান দারুণ শক্তি নিয়ে চেতনা প্রসারিত করে চলেছে। নূন্যতম গান শোনা মানুষের কাছেও প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ভালবাসার কথা অস্বীকার করার উপর নেই। হয়তো গানের মতো করে সাধক বাউলেরা প্রসারিত হতে পারছেন না তবে তত্ত্ব পৌঁছে যাচ্ছে বাঙালির ঘরে ঘরে।
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে দেখতে যেন ভুজঙ্গনা
যেখানে সাঁই’র বারামখানা \
যাই ছুঁইলে প্রাণে মরি, এজগতে তাইতে তরী
বুঝেও না বুঝতে নারি কি করি তার নাই ঠিকানা \
আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে
কুবৃক্ষে সু-ফল পেয়েছে, আমার মনের ঘোরে গেল না \
যে ধনের উৎপত্তি প্রাণধন, সেই ধনের হল না যতন
অকর্মের ফল পাকাই লালন, দেখে শুনে তার জ্ঞান হল নাম।

সুমন শিকদার
কবি ও সম্পাদক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়