যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

দুর্নীতি সুশাসনে বড় বাধা : একটি সমীক্ষা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুর্নীতি এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, দুর্নীতি এখন সামাজিক ব্যাধি এবং ব্যক্তির তুলনায় সামাজিক এ ব্যাধি দূর করা কঠিন বিধায় এটাকে সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয়ভাবেই মোকাবেলা করতে হয়। প্রশ্ন হলো সমাজ-দেশ সেটা চায় কিনা! বর্তমান সরকারপ্রধান শপথ নেয়ার পর থেকেই এ সম্পর্কে যা বলছেন এবং যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা অত্যন্ত আশা জাগানিয়া। দেশে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সেবা ব্যবস্থাপনা দেখা যাবে, প্রতি ঘাটে দুর্নীতির ধকল থেকে মানুষ নিস্তার পাবে- এরকম স্বপ্ন সর্বসাধারণকে উজ্জীবিত করে তুলছে। কারণ সরকারপ্রধান চাইলেই সেটা হয় এরকম ধারণা তাদের মনে সুপ্রথিত রয়েছে। আসলে কি তাই? সরকারের ৪৩টি মন্ত্রণালয়, কয়েকশ বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর, প্রত্যন্ত ইউনিয়ন পর্যন্ত অফিস- ২০ লাখ কর্মচারী। আবার সরকারি এসব অঙ্গ ছাড়াও সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নিজস্ব ও বিরোধী রাজনৈতিক বৃত্ত রয়েছে- সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত রয়েছে কলুষিত নেটওয়ার্ক, টাউট-বাটপার, দালাল অর্থাৎ দুর্নীতির সুফলভোগী সর্ব পর্যায়ের বড় একটা শ্রেণি। দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টায় ক্ষমতার লালসা তাড়িত দলীয় ও বিরোধীদলীয় এসব কুশীলবকেও বিবেচনায় নিতে হবে।
নিকট অতীতে ব্যাংকিং কেলেঙ্কারিগুলোতে আমরা দেখেছি সেসব দুর্নীতিতে ব্যক্তির সঙ্গে এক বা একাধিক গ্রুপ জড়িত থাকে। গত এক দশকে আর্থিক তথা ব্যাংকিং সেবায় রেকর্ড পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে; যার মধ্যে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ফার্মার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, এবি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির কথা সবাই জানে। এসবের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার রিজার্ভ লোপাটও যুক্ত হয়েছে। কোনো ব্যাংক তার বিধিবিধান ও আইনকানুন মেনে চলছে কিনা দেখার মূল কর্তৃপক্ষ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাংলাদেশে এ দুটি কর্তৃপক্ষ আইনের বিবেচনায় আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং অন্যান্য অসঙ্গতি প্রতিরোধকল্পে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সর্বময় এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তারা কতটা নিবিড়ভাবে ও সতর্কতার সঙ্গে মনিটরিং তৎপরতা চালাচ্ছে- এখানে সেটাই বিবেচ্য। আমানতকারী সাধারণ জনগণ কী ভাবছেন- সেটা কি সরকারের কেউ খতিয়ে দেখেছেন? ব্যাংক করা হয়েছে জনগণকে আর্থিক সেবা দিতে। সে সেবা ডিজিটাল ব্যবস্থায় অনলাইনে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দোরগোড়াতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে- জনগণ খুশি। কিন্তু যখন কেলেঙ্কারিগুলো ঘটছে তখন বিরোধী দল বা জনগণ কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বা বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করছে না; বলছে সরকার দুর্নীতি করছে, সরকার অর্থপাচার করছে, জনগণের আমানত খেয়ানত করছে ইত্যাদি। একইভাবে আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না কেন- সে প্রশ্নও জনমনে সরকারের প্রতি সন্দিহান করে তুলছে, যা জনগণ এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা কারো জন্যই সুখকর নয়। যেমন- সম্প্রতি দুর্নীতির বার্ষিক ধারণা সূচকে দেখা গেছে বাংলাদেশে আগের বছরের চাইতেও ২০১৮ সালে দুর্নীতি বেড়েছে, সূচকে ৪ ধাপ অবনতি ঘটেছে এবং ঘটনা কেবল দেশের সাধারণ মানুষকে নয়, খোদ টিআইবিকেও ‘বিব্রতকর’ করছে বলা হচ্ছে। তাই সরকারপ্রধানের প্রতি সবার সতর্ক দৃষ্টি- তিনি কী ভাবছেন এবং তিনি কী করছেন। তিনি দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন এবং সে লক্ষ্যে সম্ভবপর প্রয়াসে ব্রতী হয়েছেন।
সহজ সংজ্ঞার্থে, সরকারি দায়িত্ব পালনে অনিয়ম, বঞ্চনা, স্বেচ্ছায় তথ্য গোপন করা, এমনকি ইচ্ছাকৃত অফিসে অনুপস্থিতিও দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুপস্থিতি স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণ এবং প্রত্যাশিত সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এক ধরনের বাধা। কারণ, সুশাসন ও দুর্নীতির পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং ব্যস্তানুপাতিক। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে : একজন রোগী সরকারি হাসপাতালে এলে হাসপাতাল ভবনের কোন দিক দিয়ে ঢুকবেন বা কোন বিভাগে যাবেন বা তিনি কেন এসেছেন কিংবা ‘জরুরি বিভাগে ডাক্তার নেই’- এ ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত না করাটাও অপরাধ এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের এ সংক্রান্ত অবহেলা দুর্নীতির আওতায় আসবে। আবার ইউনিয়ন ভূমি অফিসে একজন তার জমির নাম খারিজের জন্য গেলেন। নাম খারিজের আবেদনটি করতে হবে উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে। তিনি অজ্ঞতার কারণে বাড়ির পাশে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে এলেন ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার (তহশিলদার) কাছে। তিনি তাকে সঠিক কথাটা না বলে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে বসিয়ে রাখলেন। ওই ব্যক্তি প্রায় ঘণ্টাখানেক পর জিজ্ঞেস করলেন ‘কী করতে হবে’। কর্মকর্তা রেগে উত্তর দিলেন, ‘দেখছেন না হাতে কাজ, পরে আসুন’। এরূপভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল অবধি বসে থেকে ব্যর্থ মনে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন সংশ্লিষ্ট সেবা গ্রহীতা। এখানে দুটি অপরাধ সংঘটিত হলো : প্রথমত, কর্মকর্তা তাকে মাত্র এক মিনিটেই বুঝিয়ে দিতে পারতেন আবেদনটি উপজেলাতে করতে হবে। তা না করে তিনি তথ্য গোপন করলেন এবং অসহযোগিতা করলেন, যা সরকারি চেয়ারে বসে দায়িত্বে অবহেলা এবং দুর্নীতির পর্যায়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, কর্মকর্তা জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন না করে সেবা গ্রহীতার সঙ্গে অসদাচরণ করেছেন- এটিও চরম দুর্নীতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বর্ণিত উদাহরণ দুটি অবশ্যই সুসেবা বা সুব্যবস্থাপনার ব্যত্যয়। বলা যায়, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি কর্তৃক অর্পিত দায়িত্বাবলি প্রতিপালন না করা- সেটা ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা যে স্বার্থেই হোক না কেন দুর্নীতির আওতায় আসবে।
এ ক্ষেত্রে লেখকের ২০১১ সালের সম্পন্ন পিএইচডি অভিসন্দর্ভ ‘ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ- অ গধলড়ৎ ওসঢ়বফরসবহঃ ঃড় এড়ড়ফ এড়াবৎহধহপব: অ ঝঃঁফু রহ খধহফ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ’-এর পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশগুলো প্রণিধানযোগ্য হতে পারে। যেমন- এক. নামজারি করতে প্রতিটি আবেদনকারীর খরচ হয়েছে ১৮১০ টাকা, যদিও প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন ছিল মাত্র ৫০ টাকা এবং প্রতিটি ব্যক্তিকে গড়ে ভূমি অফিসে ঘুরতে হয়েছে ৪৮ বার, যেখানে ৩-৪ বারের বেশি যাওয়ার কথা নয়। দুই. সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অতিরিক্ত ভ্রমণের খরচ ও সময়ের মূল্য যদি হিসাব করি (ভোগান্তি বাদ দিয়ে) তাহলে বাড়তি খরচের পরিমাণ ১৮১০ টাকার চেয়ে ৩/৪ গুণ বেড়ে যাবে। এটি বলার কারণ, দুর্নীতি একটি মানুষ ও তার পরিবারের আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক তথা নানামুখী ভোগান্তি তৈরি করে। এবার, দুর্নীতি সুশাসনকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করে তার একটি চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমি প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত ৩৯% ব্যক্তি দুর্নীতি সুশাসনকে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে মন্তব্য করেছেন এবং ২৮% বলেছেন মোটামুটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভূমি প্রশাসনের বাইরে, উপজেলায় অন্যান্য বিভাগীয় কর্মচারীদের মধ্যে ৩২% দুর্নীতির জন্য সুশাসন মধ্যম পর্যায়ের ক্ষতির সম্মুখীন হয় বলে মন্তব্য করেছেন। সুশীল সমাজ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ৪২ ভাগ একইরকম মন্তব্য করেছেন। উপজেলা পর্যায়ের সব শ্রেণির গড়ে ৪০ ভাগ মানুষ একমত পোষণ করেছেন যে, দুর্নীতি সুশাসনকে ক্ষতিগস্ত করছে। এখন দেখা যাক বর্ণিত দুটি ইস্যুর সম্পর্ক কেমন। দুর্নীতি কমলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, নাকি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও দেশ গড়া যাবে? আসলে এটি ডিম আগে না মুরগি আগে- এ প্রশ্নের মতো। উপরের আলোচনায় স্পষ্ট যে, সুশাসন ও সেবা সমানুপাতিক। অর্থাৎ সেবা বাড়লে সুশাসন নিশ্চিত হয় এবং সুশাসন নিশ্চিত হলে সেবার মান বাড়ে। পক্ষান্তরে দুর্নীতি বাড়লে সেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থাৎ সেবা দুর্নীতির ব্যস্তানুপাতিক। তাহলে দেখা যায়, সুশাসন দুর্নীতির ব্যস্তানুপাতিক, অর্থাৎ দুর্নীতি বাড়লে সুশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সুশাসন দুর্বল হলে দুর্নীতি বাড়ে। এ কথায় দুর্নীতি ও সুশাসন বিপরীতমুখী সমীকরণকে প্রতিষ্ঠিত করে। এক্ষণে সুশাসনকে যদি দেশ ও জাতির কল্যাণে রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক আইনসঙ্গত কর্তৃত্ব ব্যবস্থাপনা হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে দুর্নীতি হচ্ছে এমন একটি অনৈতিক প্রক্রিয়া যা সুশাসন দ্বারা অর্জিত উন্নয়ন বা জনকল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করে। সুশাসন নির্ভর করে শাসন কর্তৃপক্ষের আইনগত ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার ওপর যার মাত্রা নির্ভর করে দুর্নীতিমুক্ত সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের ওপর। কোনো দেশ বা রাষ্ট্রে বর্ণিত সব দিকগুলো যেমন- প্রশাসনের দক্ষতা, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, সম্পদ ও যাবতীয় ব্যবস্থাপনার আয়োজন আছে কিন্তু যতক্ষণ না সেখানে ওই প্রক্রিয়াসমূহ থেকে দুর্নীতি অপসারিত না হবে ততক্ষণ কোনোভাবেই সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সুতরাং কোনো রাষ্ট্র বা সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তই হচ্ছে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করে স্বচ্ছ একটি সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে সরকারের জন্য একটি ছাঁকনি প্রক্রিয়া প্রয়োজন যা দিয়ে প্রশাসনিক দুর্নীতিকে কমিয়ে আনা যাবে এবং সেটি সুশাসনকে এগিয়ে নেবে।
এ আলোচনায় দুর্নীতির প্রকারভেদ একটি বড় বিবেচ্য বিষয় যার ওপর ভিত্তি করে সুরাহার স্তরবিন্যাস করা সম্ভব। চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যভেদে দুর্নীতিকে ৫/৬টি মূল ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায় : ১. অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতারোহণ- যার ফলে জন্ম নেয় একনায়কতন্ত্র, অংশগ্রহণবিমুখ হয়ে পড়ে জনপ্রশাসন, প্রশাসনের প্রতি জনমনে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয় এবং গোষ্ঠীগত, দলগত ও সম্প্রদায়গত দাঙ্গা, বিবাদ সৃষ্টিসহ দুর্নীতি আরো সম্প্রসারিত হয় ২. জাতীয় পর্যায়ে ঘুষ- যা উচ্চ পর্যায়ে অস্বচ্ছতা, কালো টাকার লেনদেন ও তার পরিসর বৃদ্ধিসহ সরকারকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে, ৩. ক্ষুদ্র পরিসরে ও মাঠ পর্যায়ে ঘুষ লেনদেন- এটা সামাজিক টাউট বাটপারদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি করে; দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মামলা-মোকদ্দমার উৎপত্তি হয়, ফলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, ৪. জনগণকে অসহযোগিতা করা ও ভোগান্তি সৃষ্টি করা- যা জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে ও রোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং সরকার ও তার শাসন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ৫. আইনের বরখেলাপ ও অপপ্রয়োগ- যার ফলে জনগণের ভোগান্তি ও জনরোষ বৃদ্ধি পায় এবং আইনের শাসন বিতর্কিত হয়, ৬. সংবিধান পরিপন্থী রাষ্ট্রীয় নীতি- যার ফলে জন আক্রোশ বৃদ্ধি পায় এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে সুশাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো শ্রেণিবিন্যাস করলেও দেখা যায় অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যা দুর্নীতি দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- উভয় ইস্যুর মৌলিক কেন্দ্রবিন্দুসমূহ একই, যদিও তা পরস্পর বিপরীতমুখী গতিশীলতাকে নির্দেশ করে। কোনো রাষ্ট্র বা সরকার এ পক্ষত্রে এসব মৌলিক ইস্যু বিবেচনায় নিলে একদিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে, অন্যদিকে দুর্নীতিও প্রত্যাশিত মাত্রায় হ্রাস করা যাবে। যেমন- সরকারি সেবাসমূহ স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ নিলে দুর্নীতির সুযোগ কমে আসবে; দায়দায়িত্ব নির্ধারণ ও দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে দায়িত্বে অবহেলা, বিধি-বিধানের ব্যত্যয়, অসাধু পন্থা অবলম্বনের মতো দুর্নীতিকে হ্রাস করতে সহায়তা করবে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে অসাংবিধানিক ক্ষমতারোহণসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে কেউই আইন ভঙ্গ করার সুযোগ ও সাহস পাবে না যা পক্ষান্তরে দুর্নীতি হ্রাসে সাহায্য করবে, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও তদারকির মাধ্যমে দুর্নীতি করার সুযোগ সীমিত হয়ে আসবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণ ও বঞ্চনার অবসান এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস সহজতর হবে।
এক কথায় সরকার বা রাষ্ট্র কর্তৃক সুশাসন কায়েমের সার্বিক পরিকল্পনা ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নই কেবল দুর্নীতির সুযোগ সীমিত করতে পারে। কারণ বাস্তবায়নকারী এজেন্সি বা সংস্থাগুলো এ সমাজের মানুষ দ্বারা পরিচালিত যারা সুযোগ পেলে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে দুর্নীতি করবে- এটাই স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের প্রাচীন অর্থনীতিবিদ চাণক্য পণ্ডিত তাই বলেছেন, মাছ যেহেতু জলের মধ্যে বিচরণ করে সেহেতু সে অভ্যাসবশত নিজের অগোচরেই জল খেয়ে ফেলে। তদ্রƒপ অর্থসম্পদ নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করে তারা কখন তা আত্মসাৎ করে সেটা নিজেরাও জানে না। কাজেই সুশাসনকে এমনভাবে কৌশলগত ও প্রযুক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগই থাকবে না।

ড. প্রশান্ত কুমার রায়
গবেষক ও কলাম লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়