কুমিল্লাকে হারের স্বাদ দিল রংপুর

আগের সংবাদ

বাংলাদেশ-ব্রাজিল বাণিজ্য বাড়ানোয় জোর প্রধানমন্ত্রীর

পরের সংবাদ

সংসদ সদস্যদের অসময়ে পদত্যাগে দলে হতাশা : ছোট খেলায় বড় ট্রাম্প কার্ড হাতছাড়া বিএনপির

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুমানা জামান : বর্তমান সংসদকে অবৈধ দাবি করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিকে পাকাপোক্ত করতে সংসদ থেকে এমপিদের পদত্যাগের পর চাপা ‘আফসোসে’ ভুগছে বিএনপি। নেতারা কেউ বলছেন ‘সময়টা মোক্ষম ছিল না। আন্দালন আরো পোক্ত হলে পদত্যাগে রাজনৈতিক ফল আসত। কারো উপলব্ধি- পদত্যাগের মাধ্যমে দল ‘ব্যাকফুটে চলে’ গেল। এছাড়া পদত্যাগ করে ফের উকিল আব্দুস সাত্তার উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তে বিব্রত বিএনপি।
বিএনপির নির্ভরযোগ সূত্র জানায়, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে সাংসদদের পদত্যাগের কোনো বিকল্প ছিল না। সমাবেশ থেকে যদি এই পদত্যাগের ঘোষণা না আসত তাহলে নয়াপল্টনে ‘যে কোনো মূল্যে’ সমাবেশ করা নিয়ে সরকারের উদ্দেশে ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ থেকে বিএনপির পিছু হটার বিষয়টি বেশি আলোচিত হতো; যা দলটির ‘উজ্জীবিত’ নেতাকর্মীদের জন্য এক ধরনের হতাশা বয়ে আনত। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বিএনপি যে একটা বড় ট্রাম্প কার্ড ছোট উদ্দেশ্যে খেলে দিল, তা তারা বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভুগছে।
তবে বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করতে রজি নন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ভোরের কাগজকে বলেন, ‘রাজনীতিই রাজনীতির জায়গায় এখন নাই। যে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব-‘ এক সের বেগুনে দুই সের লবন দিমু তাতে কার কি বলার আছে?’ সেই সংসদে থাকা না থাকা সমান। বিএনপির সংসদরা যখন শপথ নেন তখনও নানা প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছিল; এখানো হচ্ছে। আমরা এসবের ধার ধারি না। বিএনপির জন্য জনগণের দুয়ার খোলা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধী শিবিরে বাড়তি টনিক তৈরির জন্য বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই টনিক সৃষ্টি হতে পারত সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাপ তৈরি হলে। তখন এ ধরনের একটা ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিসরেও আলোচনার জন্ম দিত। কিন্তু এখন এমন এক সময় যখন রাজপথের

উত্তাপ তো দূর স্থান, বিএনপি শিবিরে চলছে বিগত কয়েক মাসের ‘বিনিয়োগের’ লাভ-ক্ষতির হিসাব। কিছুটা হলেও ভাটার সময়ে বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ আন্দোলনকেও উজ্জীবিত করতে পারবে বলে মনে হয় না।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুনুর রশীদ ভোরের কাগজকে বলেন, বিএনপির অল্প কয়েকজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলেও চলমান সংসদ কোনো সংকটে পড়বে না। কারণ আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তাছাড়া বিএনপিও এমন সিদ্ধান্তে লাভবান হবে না। কারন, সংখ্যায় অল্প হলেও সাংবিধানিকভাবে তাদের কথা বলার একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল। পদত্যাগ করে এই সুযোগটিও তারা হারিয়েছে। এটি ছিল বিএনপির হটকারী সিদ্ধান্ত। দায়িত্বহীনতা, আদর্শিক দূরদর্শিতার পরিচয়। রাজনৈতিক অপরিপক্কতার নজির বিহীন দৃষ্টান্ত।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সংখ্যায় কম হলেও বিএনপির সংসদ সদস্যরা যেভাবে তৎপর ছিলেন, তারও একটা বড় অবদান আছে বলে আমার মনে হয়। সরকারকে টক্কর দেয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি সংসদের বাইরে তো বটেই ভেতরেও ভালো ভূমিকা রাখছিল। পদত্যাগের কারণে বিএনপি একটা ফ্রন্ট হারালো।
গত ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশে সংসদ থেকে একে একে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাত সংসদ সদস্য। এই সাত এমপি হলেন- উকিল আবদুস সাত্তার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২), হারুনুর রশীদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ (বগুড়া-৬), মোশাররফ হোসেন (বগুড়া-৪), আমিনুল ইসলাম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২), জাহিদুর রহমান জাহিদ (ঠাকুরগাঁও-৩) ও সংরক্ষিত মহিলা আসনে রুমিন ফারহানা।
বিএনপি এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিবে এমন পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৯ অক্টোবর দলের রংপুর বিভাগীয় সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার সময় বলেছিলেন, তাদের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছেন। দলটির প্রত্যাশা ছিল ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে এমন চাপ সৃষ্টি করা হবে যাতে সরকার পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ওই মুহূর্তে সাংসদদের পদত্যাগের ঘটনায় ক্ষমতাসীন শিবিরে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। অবশেষে সরকারের কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ প্রয়োজনীয় ও প্রত্যাশিত উত্তাপ তৈরিতে ব্যর্থ হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির উপলব্দি হয়, পদত্যাগের সময়টা মোক্ষম ছিল না। দলটির সিনিয়র নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, সংসদ থেকে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কোনো প্রত্যাশা-প্রাপ্তি না হওয়ায় দলে হতাশা এসেছে। কারও কারও ব্যাখ্যা- কোনো ‘মোমেন্টাম’ তৈরি না করে অনেক আগেই পদত্যাগ করায় ফল উল্টো হয়েছে।
নেতারা অনেকেই বলছেন, সরকারের বিভিন্ন বাধা ডিঙিয়ে একে একে ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ সফল করার মাধ্যমে বিএনপি শুধু মূলধারার সংবাদমাধ্যম বা সামাজিকমাধ্যম নয়, জনপরিসরেও বেশ আলোচনা ও কৌতূহল তৈরি করতে পেরেছিল; এতে প্রতিপক্ষ তথা শাসক মহলে কিছুটা হলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জন্ম নিয়েছিল। বিএনপি বলছে, ডান-বাম মিলিয়ে বহু বিরোধী দলকে মিলে তারা অচিরেই এক ছাতার নিচে না হোক, অন্তত যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। দলটির নেতাদের বক্তব্য অনুসারে, এ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা সরকারকে ‘উৎখাত’ করবেন; অর্থাৎ বিএনপির পক্ষে রাজপথে উত্তাপ তৈরির অবকাশ এখনো আছে। সে রকম পরিস্থিতিই হতে পারত দলটির সংসদ সদস্যদের সংসদ ত্যাগের মোক্ষম সময়।
একই কথা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও। তাদের মতে- বিএনপির এমপিদের পদত্যাগ যদি আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে হতো, তাহলে আবেদন ও প্রভাব বেশি হতো। কারণ, পদত্যাগ-ধরনের কর্মসূচি যেকোনো আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে আসে। এরপর সর্বাত্মক কর্মসূচি আসার কথা। কিন্তু পদত্যাগ সময়োচিত হয়নি। তারা পদত্যাগের কার্ডটিকে আরো ভালোভাবে ব্যবহারের সুযোগ বিএনপির সামনে ছিল।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা বরাবরই বলে এসেছি, এই সংসদ অবৈধ। আমরা স্ট্রাটেজিক কারণে সংসদে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন মনে করেছি, আর প্রয়োজন নেই, তখনই আমাদের সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। এমপিদের এই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি লাভবান হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সূত্র জানায়, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি পদত্যাগ করে আফসোস করছেন ৭ এমপিও। তবে প্রকাশ্যে কেউই মুখ খুলছেন না। এর মধ্যে পদত্যাগী এমপিদের মধ্যে উকিল আব্দুস সাত্তার ভিন্ন। তিনি পদত্যাগ করে আবারো উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তÍ জানিয়ে দল থেকে বহিষ্কারও হয়েছেন। ২০১৮ সালে তার মনোনায়ন প্রাপ্তি ও পদত্যাগের পর আসন্ন উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিয়ে বিএনপিতে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।
তবে সরকার বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগকে বিতর্কিত করতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়াকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সভায় তিনি বলেন, আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের একটি চাপ আছে তার ওপর। সরকার যে কোনোভাবে আমাদের পদত্যাগকে বিতর্কিত করতে চায়। সরকার সেটা সফলভাবে করেছে। তাকে চাপ দিয়ে এই নির্বাচনে আনা হয়েছে।
অন্যদিকে উকিল আব্দুস সাত্তারের উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তে তার ছেলে তুষার বলেন, দল বর্তমানে তার (আব্দুস সাত্তার) খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। দলীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তাকে ডাকা হয় না। কিছু জিজ্ঞেস করে না। দলের কর্মকাণ্ড মনে হচ্ছে তার আর প্রয়োজন নেই। তাই তিনি নিরিবিলি থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছেন। তাই পরিবারসহ সব আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করেই দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
তবে দলটির নির্ভরযোগ্য একাধিক নেতার সন্দেহ- ‘ভোকাল’ হওয়ার কারণে হারুনুর রশীদ বা রুমিন ফারহানার বিষয়ে ঈর্ষান্বিত মহলটি এক্ষেত্রে একটি অবস্থান তৈরি করেছে। দলের এই অংশটি সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। একইসঙ্গে জামায়াতের একটি পক্ষও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করেছে সংসদ থেকে এই সুযোগে দলের এমপিদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দলের নেতৃত্ব শতভাগ নিশ্চিত করা সহজ হবে। সরকার চাপে পড়বে।
বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসা বিএনপি নেতা জি এম সিরাজ বলেন, সংসদ থেকে আমাদের পদত্যাগ নিয়ে দলের ভেতরে বাইরে অনেক আলোচনা রয়েছে। তবে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত দলের পক্ষ থেকে হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত ভালোভাবে দেখছি। তিনি বলেন, আমাদের কয়েকজন সংসদে থাকায় এতদিন জনগণ আমাদের কথা শুনতো। এখন যারা সংসদে আছেন, তাদের কথা সংসদের চার দেয়াল শুনবে।
রাজপথের আন্দোলনকে গতি দিতে সংসদ থেকে দলীয় সদস্যদের পদত্যাগ দেশে এটাই প্রথম নয়। এর আগে আওয়ামী লীগ ১৯৯৪ সালে এ অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে সংঘটিত ওই গণপদত্যাগ লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছিল। সম্ভবত সেই উদাহরণ থেকেই বিএনপি এবার একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে সংসদের সব বিরোধী দল এক হয়ে আন্দোলন করছিল। সংসদ থেকে পদত্যাগের পরও ‘১৪৭ জন’ একতা দেখিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালের পদত্যাগ জনমনে যে ইমপ্যাক্ট তৈরি করেছিল, সংখ্যার দিক থেকে তো নয়ই, পরিস্থিতি বিবেচনায়ও বিএনপি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ তার ধারে কাছে যেতে পারেনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়