বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন আর নেই

আগের সংবাদ

দেশজুড়ে জেঁকে বসেছে শীত : উত্তররাঞ্চলের কয়েক জেলায় বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ > জনজীবন বিপর্যস্ত > বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগবালাই

পরের সংবাদ

সংকট সামাল দেয়ার চ্যালেঞ্জ : নির্বাচনী বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখা চ্যালেঞ্জ > ডলার সংকট, অর্থ পাচার ও হুন্ডি বাড়তে পারে > খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে ঋণ আদায় বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : শুরু হয়েছে নতুন বছর। এ বছরের শেষে আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসেবে নতুন বছরকে নির্বাচনী বছর বললে খুব বেশি ভুল হবে না। আর অতীতে নির্বাচনী বছরে সরকারকে তাড়া করেছে প্রবৃদ্ধি কমার শঙ্কা। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, রিজার্ভ ঘাটতি, ভর্তুকির চাপ, ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যম ডলারের বিনিময় হার অস্থিতিশীলতাসহ নানা সংকট চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে নতুন বছর। তবে অর্থনীতির এসব চ্যালেঞ্জ যত দ্রুত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যাবে, তত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অর্থ পাচার ও হুন্ডি বন্ধ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নজরদারি বাড়াতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ও তারল্য সংকট হবে না। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার নানা অক্ষমতার কারণে আমাদের স্থিতিশীল অর্থনীতি বেশ ধাক্কা খেয়েছে। এমন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আগামীতেও যা ঘাটবে তা আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু দেশের ভেতরে বয়ে চলা সমস্যাগুলো নিজেদের স্বার্থেই আমাদের উন্নতি ঘটাতে হবে। এটাই নতুন বছরের বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, বিশেষ করে গত বছরে সৃষ্ট খেলাপিঋণ কমিয়ে এনে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, করখেলাপি থেকে বেরিয়ে আসতে রাজস্ব নীতির সংস্কার, বাস্তবায়ন সক্ষমতা, মুদ্রানীতি, বিনিময় হারের নীতি, সুশাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বিষয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে নতুন বছরে নজর দেয়া জরুরি। এর পাশাপাশি নতুন বছরে নতুন করে যোগ হবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার দেয়া শর্ত প্রতিপালনের টানাপড়েন মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ।
তিনি আরো বলেন, সরকারের উচিত নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক টানাপড়েনের চাপ দক্ষতা ও সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে যতটা সম্ভব জনমুখী সিদ্ধান্তে যাওয়া। অন্যদিকে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে দাতাদের শর্তগুলোকে অতি

দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া। এজন্য সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচিগুলোতে সরকারি ব্যয় আরো বাড়ানোর চাপও একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে ২০২০ ও ২০২১ সালে যেমন বিশ্ব গণমাধ্যমের বড় অংশজুড়ে ছিল কোভিড-১৯, ২০২২ সালে দ্রুতই সেই জায়গা নিয়ে নিল যুদ্ধের খবর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ডলারের দামও। যুদ্ধের ডামাডোলে বর্তমানে বিশ্বেও ১০৪টি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডবল ডিজিটের ওপরে। এর মধ্যে চারটি দেশের ১০০ ভাগের ওপরে রয়েছে।
বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে ওই সব দেশেও মূল্যস্ফীতির হার বেশি। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আগে ছিল ১ শতাংশের কম। এরপরেই ভারত থেকে বেশি আমদানি হয়। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ব্রাজিলের মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, কানাডার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৭ দশমিক ১ শতাংশ। এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। ফলে দেশেও এর চাপ বাড়ছে। নতুন বছর ওইসব দেশে মূল্যস্ফীতির হার আরো বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজারের তালিকা কাটছাঁট করেও সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছে সীমিত আয়ের মানুষ।
বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে চাল, ভোজ্য তেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে সরকার। তারপরও গত বছরজুড়ে বাজারদরে নাভিশ্বাস ছিল ভোক্তার। নতুন বছরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কামার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, আগামীর সব সময় সম্ভাবনার। তবে এবার নতুন বছরে সেই সম্ভাবনার ইতিবাচক দিকগুলোর চেয়ে শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তাই বেশি। তিনি দাবি করেন, গত বছরজুড়েই অর্থনীতি বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে, যার কোনোটিই বিদায়ী বছরে ফেলে আসা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ চলমান এসব সমস্যা নতুন বছরের কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হয়।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চলতি বছর কৃষি উৎপাদন কমার আশঙ্কা রয়েছে। এতে কৃষিপণ্যের সরবরাহ কমে এর দাম বাড়তে পারে। ফলে অনেক দেশকে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বল্প আয়ের মানুষ ইতোমধ্যে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় তাদের আয়ে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য কিনতে পারছে না।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের সরবরাহ কমায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমেছে। ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্যের দাম বেড়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারছে না। গত বছরে জিডিপির হিসাবে বিনিয়োগ সরকারি খাতে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ ও বেসরকারি খাতে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই বেসরকারি খাতে। ফলে এ খাতে নতুন কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। করোনার আগে থেকেই কর্মসংস্থানের গতি মন্থর। করোনার কারণে ২০২০ সালে তা প্রকট হয়েছে। ২০২১ ও ২০২২ সাল জুড়েও তা অব্যাহত ছিল। ফলে এ সময়ে যারা চাকরির বাজারে এসেছেন তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাননি। এদের জন্য নতুন বছরও হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা-কর্মজীবীসহ সর্বস্তরের জনতার আস্থা ধরে রাখার পাশাপাশি আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে সচেতন থাকা একান্ত জরুরি। এককথায়, আমদানিজনিত যে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, সেটিই আমাদের জন্য এখন প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় গুরুতর চ্যালেঞ্জটি হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নীতি সুদের হার বৃদ্ধি। বৈশ্বিক বাস্তবতায় প্রায় সব দেশের মুদ্রানীতিই সংকোচনমুখী। প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই খুব দ্রুত সুদের হার বাড়িয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই তাদের এমন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও রিজার্ভ ক্ষয় ঠেকানোসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে তাদের নীতি সুদহার খানিকটা বাড়িয়েছে। আসছে দিনগুলোতে এই সুদের হার হয়তো আরো বাড়াতে হতে পারে। তবে নীতি সুদহার বাড়ার পর তা ব্যাংক পর্যায়েও যাতে ট্রান্সমিট করা যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগেও একরকম ভাটার টান দেখা দেবে। তাই চাহিদামতো বিনিয়োগ প্রবাহ চালু রাখাটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়