বুয়েটে কর্মচারীর লাশ উদ্ধার

আগের সংবাদ

প্রোটিয়াবধে সিডনিতে টাইগাররা

পরের সংবাদ

সিত্রাংয়ের ভয়াবহ ছোবল ১৩ জেলায় : ভোলা ও নড়াইলে ৩ জনের মৃত্যু > তিন বিমানবন্দরে কার্যক্রম বন্ধ > ২৫ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে > তদারকি করছেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৫, ২০২২ , ১:২৩ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আছড়ে পড়েছে ‘সিত্রাং’। মাঝারি শক্তির এই ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ পটুয়াখালীর কলাপাড়া-খেপুপাড়া ও চট্টগ্রামের মাঝামাঝি অংশ দিয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আঘাত হানতে শুরু করে। এরপর রাতভর তাণ্ডব চালায় দেশের উপকূলীয় এলাকার ১৩ জেলায়। তাণ্ডবলীলা শেষ করে আজ মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে। এর ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। তবে ঝড়ো বাতাসে গাছের ডাল ভেঙে ভোলা ও নড়াইলে ২ নারীসহ ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পুরো উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ এবং মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পরিষেবা বন্ধ রয়েছে।
সারাদেশে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্ধ আছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম। জানমাল রক্ষায় ২৫ লাখ মানুষকে ৭ হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডকে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল এবং ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ক হলেই কাটাসহ ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
আবহাওয়া সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পটুয়াখালীর খেপুপাড়া ও স›দ্বীপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রবেশ করে পুরো ৭৩০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার ১৩টি জেলায় সিত্রাং তার তাণ্ডব চালিয়েছে। এর বাইরে আরো দুটি জেলায় হালকাভাবে আঘাত হেনেছে। সবচেয়ে জোরাল আঘাত হেনেছে বরগুনা ও পটুয়াখালীতে। ১৩ জেলার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, ল²ীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল। এর আগে গতকাল সোমবার সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। দিনভর সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের বেশিরভাগ জেলায় বৃষ্টি অব্যাহত থাকে। কোথাও মাঝারি আবার কোথাও ভারি। বৃষ্টির কারণে বিকালেই যেন রাত নামে। রাজধানীতে ঝড়ের প্রভাবে সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়। প্রথম দিকে হালকা বৃষ্টি হলেও দুপুরের পর তা ভারি বৃষ্টিতে পরিণত হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সিত্রাং বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব অনেক বেশি। এর তিনটি কারণের কথা বলছেন তারা। এগুলো হলো- ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য। উপকূল পার হওয়ার সময় চট্টগ্রাম, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, নোয়াখালী, ফেনীর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে আট ফুট উঁচু জলোচ্ছ¡াসের আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের সময় অমাবস্যা থাকায় জোয়ারের উচ্চতা অনেকে বেশি। ফলে দেশের উপকূলের বেশিরভাগ এলাকা ওই জোয়ারে প্লাবিত হয়। ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানার বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ থেকে ১১০ কিলোমিটার হয়েছে। ঝড়ে বাতাসের গতির চেয়ে জলোচ্ছ¡াসের কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।
এ বিষয়ে ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সিভিয়ার সাইক্লোনে

রূপান্তরিত হয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা থেকে উপকূলে আঘাত হানা শুরু করে। মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করে। তিনি আরো বলেন, সিত্রাং বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৩ জেলায় মারাত্মক ও ২ জেলায় হালকা আঘাত হেনেছে। সবচেয়ে জোরাল আঘাত হানে বরগুনা ও পটুয়াখালীতে। বরগুনা সদর ও পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের মহেশখালী, স›দ্বীপ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিমন্ত্রী জানান, লঘুচাপ শুরুর পর থেকেই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। দেরি করা হয়নি। দুর্যোগ মোকাবিলায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। লোকজনকে বাড়িঘর থেকে আনা হয়েছে ও প্রায় ৭৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। প্রয়োজনীয় খাবার, নগদ টাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে বলেও জানান দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ভয়ংকরপূর্বাভাসের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝড়ের ফলে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ফলে উদ্ভূত সার্বিক পরিস্থিতি সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রেস সচিব জানান, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে আইনপ্রণেতাসহ তার দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন এবং ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় ও ত্রাণ পর্যবেক্ষণ সেল চালু করা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সরে গেছে। ফলে সমুদ্রের তাপ বেড়েছে। যা বঙ্গোপসাগরের ওপর সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়িয়েছে। এর জেরে মহাসাগরীয় অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলীয় আর্দ্রতাও বাড়ছে। এই অবস্থায় যখন দক্ষিণ চীন সাগর থেকে ঝঞ্ঝা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছায়, তখন অনুকূল পরিস্থিতি অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়ের গঠন এবং তীব্রতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ফলে আন্দামান সাগরের ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্ট হয়। যা প্রতিনিয়ত শক্তি বাড়িয়ে নি¤œচাপ, গভীর নি¤œচাপ তৈরি হয়। তা আরো শক্তি বাড়িয়ে বর্ষা-পরবর্তী প্রথম ঘূর্ণিঝড়টি ‘সিত্রাং’ এ রূপ নেয়। যেটি ২০১৮ সালের পর অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রথম ঘুর্ণিঝড়। সিত্রাং নামটি থাইল্যান্ড দিয়েছে। যার অর্থ ‘পাতা’। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে আরএমএসসি দ্বারা তৈরি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই নাম দেয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ : কিছু কিছু বছর দেখা গিয়েছে সমুদ্রের বায়ুমণ্ডলীয় কারণ ঘূর্ণিঝড় তৈরিতে বাধা দিয়েছে। যেমন, ২০২০ সালে নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগর বরাবর দুর্বল লা নিনা পরিস্থিতি ভারতের উপকূলের কাছাকাছি একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি বাধা সৃষ্টি করেছিল। তবে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং তেমন কোনো বাধার মুখে পড়েনি বলে জানায় আবহাওয়া অফিস। ফলে এটি বাধাহীনভাবে দেশের উপকূলে ছোবল দেয়।
যে কারণে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টি : সিত্রাং বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়। অমাবস্যা তিথি, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য কারণে ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব তীব্র হতে পারে বলে জানায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। ৩টি কারণ ব্যাখ্যা করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আবদুল মান্নান বলেন, প্রথমত, ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানার সময় অমাবস্যা থাকবে। অমাবস্যার সময় চন্দ্র ও সূর্য একই দিক থেকে পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। যার কারণে পৃথিবীর বুকে যে জলভাগ আছে, তার ওপর অতিরিক্ত আকর্ষণ তৈরি হয়। এতে জলভাগ উত্তাল হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত সিত্রাংয়ের অগ্রবর্তী অংশের আচরণ দেখে ঘূর্ণিঝড়টির সম্ভাব্য প্রবল প্রভাবের বিষয়টি আঁচ করা যাচ্ছে। তৃতীয়ত বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের কারণে এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়, যা জলভাগের ওপর চাপ তৈরি করে।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের তথ্যানুসারে ঘূর্ণিঝড়টির ব্যস প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। ফলে গভীর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কেন্দ্র বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে প্রবেশ করলেও একইসঙ্গে খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোর উপর ভারি বৃষ্টি, ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিবেগের বাতাস ও উচ্চ জলোচ্ছ¡াসের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার; ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতে ১৫০ থেকে ২০০ মিলিমিটার, চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে (বিশেষ করে ফেনী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়) ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিমিটার, রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে ৫০ থেকে ১০০ মিলিমিটার এবং রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে ৩০ থেকে ৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে। খুলনা বিভাগের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়