সংবাদ সম্মেলনে দোকান মালিক সমিতি : গুজবেই তেলের সংকট

আগের সংবাদ

সয়াবিন তেল সংকট কারসাজিতে > ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম, তারা কথা রাখেনি : সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

পরের সংবাদ

মন্ত্রীপতœীর ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: মে ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আতিকুর রহমান : স্ত্রী শাম্মী আকতার মনির স্বজন তোষণ নীতির কারণে বিব্রত রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তাকে কিছু না জানিয়ে তার স্ত্রীর তিন আত্মীয় গত শুক্রবার রাতে বিনা টিকেটে রেলে পাকশী থেকে ঢাকা আসছিলেন। রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেয়ার পরও দায়িত্বরত টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের জরিমানা করেন এবং এসি কামরা থেকে সাধারণ কামরায় স্থানান্তর করেন। বিনা টিকেটে ভ্রমণকারীরা বিষয়টি রেলমন্ত্রীর স্ত্রীকে জানানোর পর তিনি পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে ফোন দিয়ে টিটিইকে বরখাস্ত করতে বলেন। মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনের পরই নাসির উদ্দিন টিটিই শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেন এবং মোবাইল ফোনে তাকে জানিয়ে দেন। কোনো ধরনের বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে এভাবে বরখাস্তের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। মন্ত্রীর স্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। কোনো মন্ত্রীর স্ত্রী সরকারি কাজে এভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেন কিনা? আর মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অধস্তনকে বরখাস্ত করতে পারেন কিনা? এ নিয়েও সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তোলেন। মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় টিটিইকে বরখাস্ত করা সমীচীন নয় বলে মত দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনও এ ঘটনায় বিব্রত বোধ করেছেন। অন্যদিকে এ ধরনের ঘটনাকে ন্যক্কারজনক ও দুর্নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
গত শুক্রবার রাতে খুলনা থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন থেকে তিন যাত্রী বিনা টিকেটে এসি কেবিনে চেপে বসেন। ওই টেনে দায়িত্বরত টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের কাছে টিকেট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। ওই যাত্রীদের মধ্যে একজন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বড় বোনের ছেলে। টিটিই বিষয়টি পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (এসিও) নুরুল আলমের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি সর্বনিম্ন ভাড়া নিয়ে টিকেট কাটার পরামর্শ দেন।
এসিওর পরামর্শ অনুযায়ী টিটিই ওই তিন ট্রেন যাত্রীকে এসি টিকেটের পরিবর্তে সব মিলিয়ে এক হাজার ৫০

টাকা জরিমানাসহ সুলভ শ্রেণির নন-এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকেট দেন। এরপর ওই তিন যাত্রী ফোনে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীকে বিষয়টি জানান। রেলমন্ত্রীর স্ত্রী রাতেই পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে মোবাইলে ফোন করে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ এনে তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে তদন্ত ছাড়াই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিষয়টি ফোনে শফিকুলকে জানান নাসির উদ্দিন।
এ ঘটনা গত শনিবার সকালেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গণমাধ্যমেও খবরটি প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে শনিবারই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেলে ভ্রমণকারীরা তার আত্মীয় নন। যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগের ভিত্তিতেই টিটিই শফিকুলকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে শনিবার বিকালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তখন রেলমন্ত্রী জানান, শফিকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তার বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
টিটিইকে বরখাস্তের ঘটনাকে ন্যক্কারজনক অভিহিত করে শনিবার এক বিবৃতিতে দুর্নীতির অভিযোগে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)। বিবৃতিতে বলা হয়, ন্যায়-নিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে টিটিইকে তড়িৎ গতিতে বরখাস্তের সিদ্ধান্তে দেশবাসীর কাছে এই বার্তাটিই পরিষ্কার হয়েছে, ক্ষমতাবানরাই শুধু নয় বরং তার/তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকা আত্মীয় পরিজনদের জন্যও আইন প্রযোজ্য নয়; বরং অনিয়মের কাছে মাথানত করাই রুটিরুজি টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায়। একই সঙ্গে ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে নৈতিক অবস্থান থেকে রেলমন্ত্রীকে সাময়িক সময়ের জন্য পদত্যাগের আহ্বান জানায় টিআইবি।
গতকাল এক বিবৃতিতে একই দাবি জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতিও। বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে যেখানে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন। সেখানে কিছু কিছু মন্ত্রীর স্ত্রীদের অবৈধ আদেশ-নির্দেশ পালনের ফলে বিভিন্ন দপ্তরের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি এখন আকাশচুম্বী। তিনি প্রশ্ন তোলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মতো একটি কচ্ছপ গতির মন্ত্রণালয়ে যেখানে একটি জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে বছরের পর বছর ফাইল আটকা থাকে, সেখানে অফিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ সকাল ১০টায় একজন কর্তব্যরত টিটিইকে কীভাবে বরখাস্ত করা হলো, দরখাস্ত কোন সময় গ্রহণ করা হলো, কখন যাচাই-বাছাই করা হলো, কে এই অভিযোগ রিসিভ করল, কে বরখাস্তের আদেশ অনুমোদন করল।
দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে গতকাল টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের তথ্য জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো যাত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন। যাত্রীর আত্মীয় হিসেবে তিনিও (মন্ত্রীর স্ত্রী) ফোন দিতে পারেন। তবে মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে তিনি ফোন দিতে পারেন না। কারণ তিনি তো আমাকেই বলতে পারেন। আমার স্ত্রীর যদি রেলওয়ে সম্পর্কে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তার উচিত ছিল আমার সঙ্গে কথা বলা, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা তিনি করেননি। যে কারণে আমি মনে করি এই বরখাস্তের আদেশটি সঠিক হয়নি। তাই এটি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ এছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে শফিকুলকে বরখাস্তের দায়ে পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে শোকজ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, টিটিইর কাজ হলো রেলে শৃঙ্খলা আনা। তার কাজইতো রেলে যাত্রীদের সহযোগিতা করা, সাহায্য করা, সঠিক জায়গায় সেবা দেয়া; রেলের লোকদের দায়িত্বই সেটা। এখন যেভাবে ঘটেছে ঘটনাটি, তাতে আমরা বিব্রত। আমি বিব্রত, আমি যেভাবে এখানে স্বচ্ছভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি, সেখানে এ ধরনের একটি ঘটনা… সেটা যেভাবেই ঘটুক না কেন, আমি অবশ্যই বিব্রত।’
সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের পর শুকরিয়া আদায় করেছেন টিটিই শফিকুল ইসলাম। গতকাল দুপুরে পাবনার পাকশী পশ্চিমাঞ্চল বিভাগীয় রেলওয়ে কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম আমার বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। যেহেতু আমি রেলওয়ের জন্য কাজ করি, দেশের জন্য কাজ করি, সেহেতু আমাকে কাজে যোগদানের সুযোগ দিয়েছে, তাতে আমি খুশি।’
এদিকে গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় রেলের টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করা ‘সমীচীন’ হয়নি। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তারই দায় বেশি। মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত সমীচীন নয়।
অন্যদিকে, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের স্বজনদের কেলেঙ্কারির পর এই ধরনের পরিচয়ধারী কাউকে বাড়তি সুবিধা না দিতে রেলকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গতকাল রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক, সব স্টেশনের ম্যানেজার, স্টেশন মাস্টার, ট্রেনের পরিচালককে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
অফিস আদেশে বলা হয়েছে, রেলপথমন্ত্রীর একান্ত সচিব, সহকারী একান্ত সচিব এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অগোচরে তাদের রেফারেন্সে আত্মীয়/পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব পরিচয় দিয়ে যারা বিভিন্ন স্টেশনে টিকেট দাবি এবং ট্রেনে উঠে বিশেষ সুবিধা চায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া এবং যেসব মোবাইল নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে সেই নম্বরগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়ে ওই ব্যক্তিদের সঠিক পরিচয় জানার নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়