করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড, প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের জেরে বিশ্বজুড়েই বেড়ে চলছে খাদ্যপণ্যের দাম। চলমান এই সংকট বিশ্বকে একটি ‘মানবিক বিপর্যয়ে’র মুখে ফেলে দিয়েছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, যদি এই যুদ্ধ চলতে থাকে তবে খাদ্যপণ্যের রেকর্ড দাম লাখ লাখ মানুষকে অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে- যা একটি মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। এদিকে হঠাৎ করেই পাম অয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এর প্রভাবে বাংলাদেশের বাজারেও পাম অয়েলের দাম বেড়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে গম ও ভোজ্যতেলের পাশাপাশি সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর এর ব্যাপক প্রভাবও পড়ছে। বাংলাদেশ এসব পণ্যের আমদানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এর আগে গত মার্চে দেশে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ হয়েছে- যা ১৭ মাসের সর্বোচ্চ। অর্থাৎ, গত বছরের মার্চ মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, তার জন্য এ বছরের মার্চ মাসে ১০৬ দশমিক ২২ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। ফলে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ইতোমধ্যে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে ভর্তুকি বাড়িয়ে দিয়ে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা।
মূলত, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশকে তিনটি উপায়ে প্রভাবিত করেছে। এগুলো হচ্ছে- গমের বাজার, ভোজ্যতেলের বাজার ও সারের খরচ। যদিও বাংলাদেশের মানুষের ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে চালের ওপর ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরতা বেশি। তবে বর্তমানে মানুষের মোট ক্যালরির প্রায় ৭ শতাংশের জোগান আসছে গম থেকে। গমের চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে। ২০০৫ সাল থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে এ পণ্যের

বেশির ভাগ অংশ আমদানি করে বাংলাদেশ। এদিকে বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ইউক্রেন ও রাশিয়া সরবরাহ করে। বাংলাদেশ সূর্যমুখীর তেল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমদানি না করলেও যুদ্ধ পুরো ভোজ্যতেলের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। গম ও ভুট্টার মতো পণ্যেরও অন্যতম উৎপাদনকারী দেশ ইউক্রেন। এ যুদ্ধের কারণে ওই দুই পণ্যের দামও বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, কৃষ্ণসাগর অঞ্চল যুদ্ধের আওতায় থাকায় ভেজিটেবল অয়েল ও খাদ্যশস্যের বিশ্ববাজারে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য মূল্যসূচক বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা করা ভোগ্যপণ্যের দরের ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে শস্য, ভেজিটেবল অয়েল, দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস ও চিনি। ৬০ বছর আগে শুরু হওয়া এই সূচকের হিসাব বলছে, এ বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে প্রায় ১৩ শতাংশ দাম বেড়েছে এসব পণ্যের, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এফএও সতর্ক করে জানায়, ইউক্রেনে সংঘাতের কারণে খাদ্যের মূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে অপুষ্টি বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তাদের খাদ্যশস্যের সূচক মার্চে রেকর্ড ১৭ শতাংশ বেড়েছে। আর উদ্ভিজ্জ তেলের সূচক বেড়েছে ২৩ শতাংশ- যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। বেড়েছে চিনি ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম। এফএও জানায়, ২০২২ সালে বিশ্বে গমের উৎপাদন কমে হতে পারে ৭৮৪ মিলিয়ন টন। গত মাসে এই প্রাক্কলন ছিল ৭৯০ মিলিয়ন টন। সংস্থাটির ধারণা, ইউক্রেনের শীতকালীন শস্যের অন্তত ২০ শতাংশ চাষ সম্ভব হবে না।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে সার আমদানি নিয়ে একটি শঙ্কা রয়েছে। বেলারুস থেকে যে সার আমদানি হতো, যুদ্ধের কারণে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও সারের দাম বেড়েছে। আর আমাদের গমের কিছু চাহিদা রয়েছে; কিন্তু খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে আমরা গম প্রধান দেশ না। তিনি বলেন, সরকার যদি ভতুর্কি বেশি দিয়ে হলেও এসবের সরবরাহ ঠিক রাখে তবে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। এ অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, তবে দেশে ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি অনেক বাড়তি। মূল্যস্ফীতির এ পারদ নিচের দিকে নামানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, যতদিন না নামে ততদিন আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম বাড়তি থাকবে। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। তারা তখন সঠিক পুষ্টি পাবে না। ফলে নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো পুষ্টহীনতায় ভুগবে। তাদের জন্য ঝুঁকি অনেক বেশি। এজন্য সরকার টিসিবির মাধ্যমে যে নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার সঠিক বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের এমন ভালো উদ্যোগ যদি সঠিক জায়গায় পৌঁছানো যেত তবে ভয় কম থাকতো। তিনি আরো বলেন, ভর্তুকি ব্যয় বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাজেটে ঘাটতির টার্গেটের মধ্যেই রয়েছে। কাজেই সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে মূল বিষয়।
এদিকে হঠাৎ করে গত শুক্রবার এক বিবৃতির মাধ্যমে পাম অয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় ইন্দোনেশিয়া। এর প্রভাবে বাংলাদেশের বাজারেও পাম অয়েলের দাম বেড়েছে। রাজধানীর বাজারে পাম অয়েল (খোলা) প্রতি লিটারে প্রায় ৫ থেকে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কারখানা পরিদর্শন, আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার এবং বাজার মনিটরিংয়ের পর ভোজ্যতেলের দাম খানিকটা কমে এসেছিল। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া হঠাৎ করে পাম তেল রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় ভোজ্যতেল নিয়ে আবারো দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। তাদের আশঙ্কা ভোজ্যতেলের দাম আরো বাড়বে। এরই মধ্যে সরকার সয়াবিনের দাম বাড়িয়েছে। আজ থেকে এ বাড়তি মূল্য কার্যকর হচ্ছে। এ ছাড়া দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় পাম অয়েল। আর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাম অয়েল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়া। বিশ্ববাজারে সরবরাহের অর্ধেকই জোগান দেয় দেশটি। তবে সাময়িক এ নিষেধাজ্ঞাও দ্রুত তুলে নেয়া হবে বলে আশাবাদী আমদানিকারকরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ টন ভোজ্যতেল ব্যবহার হয়। তাই সমস্যা সমাধানে পরিকল্পিত উপায়ে দেশীয় উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া উচিত।
বাংলাদেশের কৃষি, বিশেষ করে ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। বছরে প্রতি হেক্টরে গড় ২৮৬ কেজি সার ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ বছরে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টনেরও বেশি সার আমদানি করে। দেশে নাইট্রোজেনের চাহিদার ৩১ শতাংশ, ফসফেটের চাহিদার ৫৭ শতাংশ এবং পটাশ চাহিদার ৯৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। রাশিয়া ও বেলারুশ বিশ্বের প্রধান সার রপ্তানিকারক দেশ। যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে লক্ষ্য করে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এ বাজারগুলোর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশ তার পটাশ সারের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ (রাশিয়া থেকে ৩৪ শতাংশ এবং বেলারুশ থেকে ৪১ শতাংশ) আমদানি করে। যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশকে সম্ভবত অন্যান্য দেশ থেকে সার আমদানি করতে হবে এবং এতে ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এতে দেশে সারের ব্যবহার কম হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেনভিত্তিক সারের ব্যবহার হ্রাস পাবে- যা চাল উৎপাদন হ্রাস করতে পারে এবং চাল আমদানির চাহিদা বাড়বে।
খাদ্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। এটি আর্থিক রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং মুদ্রাবাজারে প্রভাব ফেলবে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে উঠবে। এতে ভোক্তাদের অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কারণ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম দুর্বল মুদ্রা বিনিময় হার দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং জনসাধারণের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করবে।
তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব দেশের খাদ্যখাতে পড়বে না বরে মনে করেন খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারাও একই ধরনের প্রশ্ন করেছে। কিন্তু আমি মনে করি, বাংলাদেশের খাদ্যপরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর। আমাদের জমি আছে, উর্বর মাটি আছে, ভালো উৎপাদন ক্ষমতা আছে। তাই এ মুহূর্তে খাদ্যদ্রব্যের ওপরে প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, তবে ফসল ফলানোর জন্য সার আমদানি করতে হয়। যদিও করোনা মহামারিতে বিশ্ব বাজারে সারের দামে প্রভাব পড়েছে। তাই আমাদের এখন বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরাসরি প্রভাব না পড়লেও পরোক্ষভাবে কিছুটা প্রভাব তো পড়বেই। এমনিতেই আমাদের দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কিনতে সক্ষম নয়। তবে শুধু দামি খাবারেই পুষ্টি থাকে না। সামান্য শাক সবজিতেও অনেক পুষ্টি রয়েছে। আমাদের দেশে মিষ্টি পানির মাছ উৎপাদন অনেক ভালো। ডিম, দুধ উৎপাদনেও আমরা সারপ্লাস। তিনি আরো বলেন, দাম বাড়ার কারণ শুধু যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। সুতরাং লাইফস্টাইল উন্নত হয়েছে। এমনকি চাহিদাও অনেক বেড়েছে। তাই আগে যেমন প্রয়োজন ছাড়া একটা পণ্য মানুষ কিনতো না। এখন কিন্তু কিনে নিয়ে আসছে।
এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসে দেশে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর খাদ্য বহিভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩০ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়