করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

প্রিয়জন

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আলী ইমাম
আমাদের এই ছোট্ট জীবনে অনেক ঋণ আলী ইমামের কাছে। আলী ইমাম ভাই কর্মজীবনে যা যা করেছেন আমরাও কেন জানি সে সব করার চেষ্টা করেছি।
আলী ইমাম ভাই ছোটবেলা থেকেই নিবেদিতপ্রাণ শিশুসাহিত্যিক। স্কুলজীবন থেকেই তিনি পত্রপত্রিকার পাতায় নিয়মিত লিখে থাকেন।
মাসিক কচি ও কাঁচা, টাপুরটুপুর, সাত ভাই চম্পা, খেলাঘর, এসব বিভাগে স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকে তিনি লিখছেন। স্বাধীনতার পরবর্তী আলী ইমাম একজন অগ্রগণ্য শিশুসাহিত্যিক। শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, আলী ইমাম শিশুসাহিত্যের সারথী-বন্ধু। তারা একসঙ্গে লেখা শুরু করেন এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল হন।
আলী ইমাম বহুপ্রজ লেখক। শিশুসাহিত্যের সব শাখায় তার সমান পদচারণা। গল্প-উপন্যাস-ফিচার-প্রবন্ধ-ছড়া-কবিতা-জীবনী- সবই লেখেন তিনি। প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে তার। প্রায় পাঁচ শতাধিক গ্রন্থ।
এমনই বিপুল আয়তনিক লোক তিনি। শিশুসাহিত্য-বিষয়ক যাবতীয় সম্মানজনক পুরস্কার সবই তিনি পেয়েছেন। বাংলা একাডেমির পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার, কবীর চৌধুরীর স্মৃতি পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কারের শেষ নেই।
আলী ইমাম ভাই সুবক্তা। শিশুসাহিত্য বিষয়ে তিনি অসাধারণ বক্তৃতা দেন। টেলিভিশন ও রেডিও বক্তা হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। প্রায় ৫০ বছরের অধিককাল ধরে তিনি টিভি ও রেডিও অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি সরাসরি চাকরি করেছেন। জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে চাকরি থেকে তিনি অবসর নেন।
নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে আলী ইমাম ভাই নিবিড়ভাবে জড়িত। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, শিশু একাডেমির নানাধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে আলী ইমাম ভাই ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত।
বহু গুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তিত্ব আলী ইমাম। শিশুসাহিত্য-বিষয়ক বিপুল পঠন তার। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনি আশ্চর্য রকম অনুরক্ত। ‘বুড়ো আংলা’ বইটা প্রায় তার মুখস্থ। রিদয় চরিত্রের তিনি মুগ্ধ ভক্ত। সারাজীবন আলী ইমাম ভাই রিদয় আর বুড়ো আংলার পৃথিবীতে বাস করলেন। যে কোনো বক্তৃতায় আলী ইমাম ভাই প্রসঙ্গক্রমে ‘বুড়ো আংলা’ আনবেন। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন নাকি বলতেন, আমার টাকা থাকলে আমি ‘বুড়ো আংলা’ ছেপে বিনামূল্যে বাংলার ছেলেমেয়েদের পাঠ করার জন্য উপহার দিতাম।
এতেই বোঝা যায়, শিশু মনোরাজ্যে অবন ঠাকুরের প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী।
অবন ঠাকুরের রচনাকর্মের প্রতি আলী ইমামের মুগ্ধতা এখনো কমেনি। আমাদের জেনারেশনও অবন ঠাকুরের প্রচণ্ড ভক্ত। আহমাদ মাযহার এবং আমি জীবনটা কাটিয়ে দিলাম অবন ঠাকুরের রূপকথার জগতে।
জসীমউদ্দীন, হাবীবুর রহমান, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, লীলা মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকদের লেখারও খুব অনুরাগী পাঠক আলী ইমাম ভাই। কতদিন কত আড্ডায় যে বাংলার শিশুসাহিত্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা আমরা করেছি। বাংলা শিশুসাহিত্য নিয়ে হেন তথ্য নেই যা বলে আলী ইমাম ভাইকে বিস্মিত করা যায়। শিশুসাথী, মৌচাক, রংমশাল, শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী কিংবা বাংলাদেশের নবারুণ, ধান শালিকের দেশ, কচি ও কাঁচা, টাপুর-টুপুর সব ধরনের ছোটদের পত্রপত্রিকাই ইমাম ভাই উল্টেপাল্টে দেখেছেন। পড়েছেন।
আলী ইমাম ভাই আরেক বাঙালি ব্যক্তিত্বের চরম ভক্ত। তার নাম সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ-মুগ্ধতা ইমাম ভাইয়ের মধ্যে এখনো সক্রিয়। স্বপ্নবিলাসী কিশোরের মতো সত্যজিৎ রায়ে ডুবে থাকেন তিনি। রায়ের লেখা ফেলুদা, রায়ের চলচ্চিত্র, রায়ের লেটারিং, বুক কাভার ডিজাইন, ফিল্মের মিউজিক কম্পোজিশন, রায়ের সম্পাদনা, রায় বিষয় নিয়ে ইমাম ভাইয়ের উচ্ছ¡াস এখনো শিশুদের মতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি অনর্গল ‘রায়’ নিয়ে কথা বলতেই থাকেন। ইমাম ভাই প্রায়ই বলেন, সত্যজিৎ রায় চর্চাই তার জীবনকে বদলে দিয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত তার প্রিয় বিষয়। সময় পেলেই নিবিষ্ট মনে গান শোনেন। বিভিন্ন ধরনের বই সংগ্রহ তার নেশা। ভালো ভালো খাবার ও পানীয় দ্রব্য তার খুব পছন্দ। যে কোনো সুস্বাদু খাবার পেলেই উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠেন ইমাম ভাই। পোশাক-আশাক পরেন খুব সাধারণ। শার্ট-প্যান্ট আর স্যান্ডেল। শীত তাকে খুব কম কাতর করে। ইদানীং শীতে জুতা এবং ব্লেজার পরেন। চশমা তার নিত্যসঙ্গী। ভারী চশমা পরেন। এক ছেলে অনতু, চিকিৎসক। অনিতা তার মেয়ে। লিপি আপা তার স্ত্রী। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমেদ লিপি আপার আপন মামা। আলী ইমাম ভাইয়ের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। তার পছন্দের বিষয় খুব সহজেই তার স্মৃতিতে ধরা থাকে। খুব উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। কথার পৃষ্ঠে খুব দ্রুত জবাব দিতে পারেন।
টেলিভিশনে লাইভ অনুষ্ঠানের তিনি মাস্টার। সময়জ্ঞান তার অতি তীব্র। ৭টায় কোথাও উপস্থিত হওয়ার কথা। ইমাম ভাই ৭টায় উপস্থিত হবেন। হাতে ঘড়ি পরেন না। কিন্তু তার দেহঘড়ি অতি সচেতন। সময়ের ব্যাপারে সতর্কতা দিতে থাকবে তার দেহঘড়ি।
একটি বই কী করে সম্পূর্ণ করতে হয় এটা শিখেছি ইমাম ভাইয়ের কাছে। কী করে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে হয় সেটাও তার কাছেই শেখা। বইয়ের চরিত্র ব্যাপারটা কেমন, সেটাও ইমাম ভাই শিখিয়েছেন। গল্পের বই, ছড়ার বই, ফিচারের বই, কীভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে হয়, সে ব্যাপারেও আলী ইমাম ভাই খুব করিৎকর্মা। লেখালেখি ব্যাপারটা যে দিনমজুরদের মতো পরিশ্রমের বিষয়, এটাও তিনি উপলব্ধি করেন। তাই রাত্রি জেগে বিপুল পরিশ্রম করে লিখতে হবে, এটাও শিখেছি ইমাম ভাইয়ের কাছে। ইমাম ভাই খুব পরিশ্রমী মানুষ। প্রচণ্ড ছোটাছুটি করতে পারেন। ভ্রমণে ক্লান্তহীন। যে কোনো পরিবেশে মানানসই। থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে কোনো সংস্কার নেই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই মিশতে পারেন। লেখালেখি করে যে কিশোর-তরুণরা তাদের তিনি হৃদয় উজাড় করে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।
ইমাম ভাই টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবেও তুখোড় ব্যক্তি। বাংলাদেশে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লাইভ অনুষ্ঠান তিনি প্রযোজনা করেছেন। ১৯৮৫ সালে আলী ইমাম ভাই আমাদের ধরে নিয়ে যান টেলিভিশনে। অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণের সেই প্রথম পাঠ। ইমাম ভাইয়ের হাত ধরেই পরিচিত হই ফিরোজ মাহমুদ, হাবিব আহসান, ম. হামিদ, খ. ম. হারুন, আল মনসুর, মেনকা আপা, শাহিদা আরবী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে টকশো, ন্যারেটিভ ডকুমেন্টারি, নিয়মিত আলেখ্যানুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সরাসরি প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’, নানাবিধ অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লাম। পরে জনসংখ্যা বিষয়ক সেলে বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান শুরু করি। চুক্তিভিত্তিক চেক পেতাম। সেই ব্যাপারেও অনেক উদারতার পরিচয় দিতেন ইমাম ভাই। সুযোগ পেলেই চেক দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। আমরাও চেক পেয়ে মহাখুশি। বিটিভির শক্তপোক্ত চেক। নিজেকে খুব সম্মানিত বোধ করতাম।
ইমাম ভাইয়ের কাছে কাজ শিখে পরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। সায়ীদ স্যার খুব নিখুঁত ও সুন্দর-সর্বাঙ্গ কাজ করতেন। অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল আমাদের। কাজ করে সায়ীদ স্যারকে খুশি করতে পারতাম না।
পরবর্তী জীবনে টেলিভিশনেই কাজ করেছি। স্যাটেলাইট চ্যানেল, চ্যানেল আইতে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সংযুক্ত আছি। ফরিদুর রেজা সাগরের নেতৃত্বে অনেক স্বাধীনতা ভোগ করে মনের আনন্দে কাজ করে যাচ্ছি। চ্যানেল আইতে অনেক ধরনের অনুষ্ঠান প্রযোজনা করে থাকি। সাগর ভাই আরেক অসাধারণ টিভি-ব্যক্তিত্ব। দুর্দান্ত মেধাসম্পন্ন সাগর ভাই। মুহূর্তের মধ্যে তিনি তুড়ি মেরে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করে থাকেন। নির্মাণ করে থাকেন। সেই সাগর ভাইও নানা প্রসঙ্গে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে হেলাল ভাইয়ের কথা স্মরণ করেন। হেলাল ভাই মানে প্রিয় আলী ইমাম। ইমদাদুল হক মিলন, অভিনেতা আফজাল হোসেন, ফরিদুর রেজা সাগর প্রমুখ তাকে ছোটবেলা থেকেই হেলাল ভাই সম্বোধন করে থাকেন। হেলাল ভাই তাদের খুব প্রিয়। এক ধরনের আন্তরিক-মধুর ব্যবহার দিয়ে তিনি সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন।
আলী ইমাম অতি সজ্জন ব্যক্তি। উপস্থাপক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। ইদানীং ডায়াবেটিসের নির্মম ছোবলে ইমাম ভাই কিছুটা অসুস্থ। এখন তিনি আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। কিন্তু তার তীব্র মনোবল। প্রতি বছর তার নতুন-পুরনো মিলিয়ে গড়ে ৩০টা বই প্রকাশিত হয়। এখনো তিনি বাংলাবাজারে ছুটে যান। স্যাঁতসেঁতে আলো বাতাসহীন প্রেসের ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি প্রæফ দেখেন। বইয়ের মেকাপ দেন। নিষ্ঠার কোনো কমতি নেই।
তাই আলী ইমাম ভাইকে চিরতরুণ বলি আমরা। বয়সের বিভাজনে তিনি বিশ্বাস করেন না। ছেলে বুড়ো সবাই তার বন্ধু। তরুণ বা তরুণতম লেখকদের সঙ্গেও তিনি সমান প্রাণখোলা। মিডিয়ার সঙ্গে ছোটবেলা থেকে জড়িত বলে দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের সরল সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আলী আহসান, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা, ড. আহমদ শরিফ, ড. মযহারুল ইসলাম, সমর দাশ, জহির রায়হান, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. রফিকুল ইসলাম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, অনেক দীর্ঘ হতে পারে এই তালিকা। প্রবীণদের অনেক প্রিয় তিনি।
আমাদেরও অতি প্রিয়। রিটন ভাইয়ের সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তার। মাযহারকে মননশীল ব্যক্তি হিসেবে খুব পছন্দ ইমাম ভাইয়ের। আমার বিষয়েও অনেক উচ্ছ¡সিত তিনি। এসব নিয়েই আলী ইমাম ভাই। এক কথায় চমৎকার মানুষ।
অনেক শ্রদ্ধা। অনেক অভিবাদন। প্রিয় আলী ইমাম ভাই।

সানী ভাই
সানী ভাইকে নিয়ে কী লিখব। একহাজার পৃষ্ঠা লিখলেও লেখা শেষ হবে না। এক পাতা লিখলে হয়তো সমাপ্ত হয়ে যাবে সানী ভাইয়ের কীর্তিকাহিনী।
সানী ভাইয়ের বহু পরিচয়। তিনি কবি। তিনি রাজনীতিবিদ। তিনি সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি ছড়াকার। তিনি ঢাকাইয়া সমাজের প্রতিনিধি। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত। তিনি বঙ্গবন্ধু-সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়ে আপসহীন।
এরকম অনেক পরিচয়ে তাকে মহিমান্বিত করা যায়। তিনি সবার প্রিয় সদাহাস্য সদারসিক কবি আসলাম সানী। সানী ভাইয়ের মুখে সবসময় রঙিন হাসি। সবাইকে প্রাণ খুলে হাসাচ্ছেন। মন খুলে কথা বলছেন।
যেন উচ্ছ¡সিত ঝর্ণাধারা। যেখানে সানী ভাই সেখানেই আনন্দের উৎস। তার সামনে কেউ গোমড়ামুখো থাকতে পারবে না। হাসতে হবেই তাকে। শ্লীল-অশ্লীল, ছোট বড় কোনো ভেদাভেদ নেই। ছেলেমেয়েদের সামনে শ্রাব্য-অশ্রাব্য বাণী ছুড়ে দিচ্ছেন অসঙ্কোচে। গালি তার মুখে মধুর হয়ে ওঠে। চুদির ভাই, চোদনা- এসব তার মুখে সহজাত বুলি। নাতি-নাতনির সঙ্গেও তার একই রকম ব্যবহার। গালি দিয়ে তাদের সম্বোধন করবেন। আর সবসময় রসিকতা করবেন।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সানী ভাই আমার বড় ভাই। কবে কখন প্রথম দেখা সে সব মনে নেই। তবে আমরা ছোট হলেও তিনি আমাদের সঙ্গে কোনোদিন ছোটর মতো আচরণ করেননি। সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। সানী ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা শহরের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। উদ্দেশ্যহীন অকারণ। সেই সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন, ঢাকা বিশেষজ্ঞ আনিস আহামেদ, চলচ্চিত্রকার জাহিদ হোসেন মনজু, আমি- আমরা সবাই লালবাগ, আমলিগোলা পাট্টি। একসঙ্গে শৈশব-কৈশোর পার করেছি। সানী ভাইয়ের সঙ্গে এখনো আমার নিয়মিত সম্পর্ক রক্ষিত আছে। যোগাযোগ আছে।
সানী ভাই আমার অভিভাবক, আমার পিতৃতুল্য। আমার সুখ-দুঃখের একান্ত সহচর। আমার সামান্য লোক হয়ে ওঠার পেছনে সানী ভাইয়ের প্রত্যক্ষ অবদান আছে। আমাকে সব বাধা-বিঘœ থেকে তিনি পিতার মতো রক্ষা করে থাকেন। আমার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার উৎসাহদাতা সানী ভাই।
১৯৭৯ সাল। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ থেকে সংসদ নির্বাচন করেছিলাম। বাসা থেকে নিষেধ ছিল। শুধু সানী ভাইয়ের আগ্রহেই নির্বাচন করি এবং কামরুল-হাবিব পরিষদ থেকে বৈতরণী পার হই। ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনেও সাহিত্য সম্পাদক পদপ্রার্থী হতে পারি সানী ভাইয়ের কল্যাণেই। পরাজিত হই তৎকালীন পরিবেশে। আমাদের আরেক সহযাত্রী ড. শাহাদৎ হোসেন নিপু। শেখ সাহেববাজার বাসী।
জীবনটা কত দ্রুতই না আমাদের ফুরিয়ে গেল। এই লেখা লিখতে গিয়ে কত স্মৃতিই না মনে পড়ছে। সানী ভাই ঘরে যেমন বাইরেও তেমন। ভাবির সঙ্গে সবসময় ঠাট্টা-মশকরা করছেন। দুষ্টুমি করছেন।
মনে পড়ে ভাবি বললেন,
যাও সানী- বাজার করো
সানী ভাই হাসতে হাসতে বলল-
চলো তো টুলু- চলো, জলদি যাই। এগো লগে থাকলে আর লেখক হইতে পারুম না। যা দিন সব হান্দাইয়া ফালাইবো। এগো খিদা শেষ হইব না।
ভাবিও হাসছেন। সানী ভাইয়ের এই রসিক চরিত্র তারচেয়ে বেশি কে জানে! ভাবি পুরান ঢাকার বনেদী পরিবারের সন্তান। তাদের বিশাল আত্মীয়-গোষ্ঠী। সানী ভাইয়ের সব অত্যাচার তিনি সমগ্র জীবন ধরে হাসিমুখে সহ্য করে গেলেন। কোনোদিন প্রতিবাদ করেননি। সংসারের হাল ধরে সানী ভাইয়ের লেখালেখি করার জন্য সহায়তা করেছেন। তিন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মানুষ করেছেন। রুম্পা, শম্পা, ঝুম্পা। বড় দুজনের বিয়ে হয়েছে। ঝুম্পা এখন সানী ভাইয়ের সব কাজের সহকারী। ছোট্ট একটা স্কুটি আছে শম্পার। বাবাকে একটানে কোথাও নামিয়ে দিয়ে আসছে। আবার বাসা ফেরার সময় সানী ভাইকে স্কুটির পেছনে বসিয়ে ঝুম্পা ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে।
অসম্ভব জীবনরসিক মানুষ আসলাম সানী। তার খাই খাই স্বভাব নেই। বেশি উচ্চাশা করেন না। পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছেন। সুখের সংসার। টাকার জন্য সানী ভাই কোনোদিন কাজ করেননি। ভালোবাসার টানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছেন। টিএসসি, শাহবাগ, পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি- এসব স্থানেই নানা কাজে-কর্মে সানী ভাইকে পাওয়া যাবে। সবার প্রিয় মানুষ। সবার হৃদয়েও তার ভালোবাসার আসন।
কেউ কখনো সানী ভাইকে কোনো কাজ না করেন না। সানী ভাই অন্যের জন্যও সারাক্ষণ ছুটে বেড়াচ্ছেন।
খুব পরোপকারী ও সমাজসেবক ধরনের ব্যক্তি তিনি। কোনো রোগী মানুষ যদি সানী ভাই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তবে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হবেই। প্রয়োজনে কারো চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন। কারো চাকরি প্রয়োজন, কেউ জমি কিনতে চায়, কারো বিদেশ যাত্রা, কারো সন্তানের বিয়ে- সবার প্রতি সানী ভাইয়ের উদার দুই হস্ত প্রসারিত।
এক আশ্চর্য মানুষ তিনি।

দুই.
জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি গালি খেয়েছি সানী ভাইয়ের কাছে। আমাকে খুঁজে না পেলেই, আমি ফোন ধরতে না পারলে, কোনো নির্ধারিত অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত না হলেই শুরু হবে সানী ভাইয়ের গালিবর্ষণ।
আমীরুল হালায় মানুষের বাচ্চা না। অর কথা আর কইবা না আমারে। চোদনা ধান্দাবাজ হইয়া গেছে। কথা দিয়া কথা রাখব না। চর্বি জইমা গেছে।
আমীরুল- হালার লগে আর কথা নাই। অর ফোন আর ধরুম না।
দু-একদিন হয়তো এই গোস্সা থাকবে। তারপর আবার সানী ভাই সহজ ও স্বাভাবিক। আবার আমাদের কার্যক্রম চলতে থাকবে।
আর গালি-গালাজ তো লিখিত হবে না। সানী ভাইয়ের গালির ধ্বনি ঝংকার শুনতেই ভালো লাগবে। সেসব কাগজে লেখা সম্ভব নয়।
আমার অনেক বই সানী ভাই প্রকাশ করে দিয়েছেন। শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের অবদান সানী ভাইয়ের। তার কল্যাণেই আমার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। সানী ভাইয়ের কল্যাণে আমার বড় ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্র অমির জন্যে ঢাকার আশপাশে জমি কেনা হয়েছে।
সানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো স্বার্থের সম্পর্ক নয়। ভালোবাসা শ্রদ্ধার সম্পর্ক। সানী ভাই যদি কিছু বলেন বা আদেশ দেন সেটা পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আমি কিছু বললে সানী ভাই সেটা সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে সমাধা করে দেন।
সানী ভাইকে আমি বেশ কয়েকটা বই উৎসর্গ করেছি। সানী ভাইও আমাকে অনেকগুলো বই উৎসর্গ করেছেন।
বইমেলা ২০১৮-তে সানী ভাই অপরিসীম আবেগে আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। ‘আমীরুলনামা’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ ছড়ার বই প্রকাশ করেছেন সানী ভাই। বইটির প্রকাশক বাদল চৌধুরী। আমাদের আরেক স্নেহভাজন। বইটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে মেলা মাঠে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বললেন,
শাবাশ সানী। দুর্দান্ত কাজ করেছ। বাংলাভাষায় জীবিত কোনো অগ্রজ কোনো অনুজপ্রতি এরকম ছড়ার বই প্রকাশ করেনি।
তোমাকে অভিবাদন সানী।
সানী ভাই হাসতে হাসতে বললেন,
সব হালায় এই বই দেইখা হিংসায় জ্বলতাছে। সবার খবর হয়্যা গেছে।
আমি বললাম,
কামটা ভালো হয়নি উস্তাদ
সানী ভাই, হিংসা বাড়ায়া লাভ কী?
সানী ভাই অবশ্য কাউকে পরোয়া করেন না। যত বড় ব্যক্তি হোক না কেন- অসংগতি দেখলে তার সমালোচনা করে যাবে, কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই সানী ভাইয়ের। মন্ত্রী, এমপি, সচিব- সবার সঙ্গেই সদ্ভাব তার। স্বনামে সবাই তাকে স্নেহ করেন। ভালোবাসেন।
সানী ভাই কখনো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অকারণ সুবিধা নেয়নি। কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে তিনি দূরে থাকেন।
সানী ভাই সব সংগঠনের প্রাণপুরুষ। সবার সঙ্গে তিনি মিলেমিশে থাকেন। মজাটা হচ্ছে সানী ভাই আর আমি এমনই মানিকজোড় যে, সানী ভাইয়ের প্রিয়জনেরা আমার প্রিয়জন। আমার ঘনিষ্ঠজনেরা সানী ভাইয়েরও ঘনিষ্ঠ।
একটা কথা বলা হয়নি। আমাকে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত করে থাকেন তিনি আসলাম সানী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে থাকেন : আমীরুল আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু জ্ঞানে মেধায় আমীরুল আমার চেয়ে অনেক বড়।
আমীরুল আমার গুরু।
আমীরুলের কাছ থেকে আমাকে অনেক কিছু শেখার আছে।
যারা আমীরুলের মূল্য দিতে জানে না তাদের দিয়ে কিছু হবে না। আমীরুলকে ভ্যালু দিতে হবে।
আমি সামনে হয়তো দর্শক আসনে বসে আছি। সানী ভাই মাইক্রোফোনে অনর্গল বলে যাচ্ছেন :
আমীরুল অনেক লাজুক। নিজের আত্মপ্রচার করতে পছন্দ করে না। আরেকজন আছে ধ্রæব এষ। খামোখা এরা ছোটাছুটি করে না।
বক্তৃতার মধ্যে বলতে থাকলেন,
শুধু বাংলা নয়, বিশ্ব শিশুসাহিত্যেই আমীরুল তার সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আছে।
আমি লজ্জায় মাথা নত হয়ে বসে থাকি।
ঢাকা, কলকাতা, চট্টগ্রাম, সিলেট যেখানেই হোক না কেন সাহিত্য অনুষ্ঠান- সানী ভাই থাকলেই আমাকে গাছে তুলে ছাড়বে। আমি নামব কীভাবে সে উপায় থাকবে না।
সানী ভাইয়ের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ অতি আনন্দের। কলকাতায় আমরা বহুবার গেছি। একসঙ্গে একই হোটেলে থেকেছি। ভ্রমণে সানী ভাই অসম্ভব সাহায্যকারী ব্যক্তি। আমি হার্টের রোগী। আমাকে কোনো ব্যাগ-লাগেজ বহন করতে দেবেন না তিনি। আমার প্রথম কলকাতা ভ্রমণও সানী ভাইয়ের হাত ধরে।
সানী ভাইয়ের বৃত্তান্ত বলে শেষ হবে না। পুরো একটা বই লেখার ইচ্ছা রইল আমার।
সানী ভাই সম্পর্কে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, নাট্যজন মামুনুর রশীদ কিংবা আমাদের উভয়ের অতি কাছের বন্ধু আহমাদ মাযহার সবসময় বলে থাকেন- আসলাম সানীর মতো চরিত্র আমাদের দেশে নেই। একেবারে বিরল চরিত্র। কোনো তুলনা নেই।
সানী ভাই একক ও অদ্বিতীয়। সানী ভাইয়ের মুখের হাসি যেন কোনোদিন মলিন না হয়।

তারিক সুজাত
আমার প্রিয় কবি বন্ধু। সলজ হাসিমাখা মুখ। এমন কর্ম তৎপর- নানা স্বপ্নে বিভোর। দুর্দান্ত উত্তাবনী ক্ষমতার অধিকারী। পেশাদার এবং সৃজনশীল দুক্ষেত্রেই তিনি অভিনব। বয়স মাত্র পঞ্চাশ পেরিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে দায়িত্বশীল অনেক কাজ করেছেন। শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিতে এমন কেউ নেই যারা তাকে চেনে না এবং ভালোবাসে না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনাও তাকে চেনেন। তার কাজকর্ম পছন্দ করেন। তিনি আমাদের তারিক সুজাত। সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রতায় বড় বড় কাজের সঙ্গে তারিক গভীরভাবে জড়িত থাকে। এ সবের আড়ালে চাপা পড়ে যায় তার কবি খ্যাতি। তারিক তার সমকালে একজন বড় কবি। তার কবিতা মনোযোগের দাবি রাখে। খুব সহজ ও আদুরে তার কবিতা। ইদানীং তারিকের কবিতা চিরন্তন ধারার কবিতার পপে বাঁক নিয়েছে। ছোট ছোট গীতল কবিতা। রবীন্দ্রনাথ, ওমর খৈয়াম, মীর তুর্কী মীর এর বয়েত ভেঙেচুরে, নতুন ব্যঞ্জনায় তিনি তারিকীয় কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতার অনুভূতির মধ্যে মানুষ প্রেমের ক্ল্যাসিক ধারাটি মূর্ত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথকে টুকরো টুকরো বিনির্মাণ করে তারিক দুই তিনটে কবিতার বই প্রকাশ করেছে। একটা দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। রফিকুন নবী প্রতিটা কবিতার সঙ্গে পেইন্টিং করেছেন। বাংলা ভাষায় এমন সুমুদ্রিত কবিতার বই আর কী আছে! ভাগ্যবান তারিক। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নাম যশের জন্য সে অকারণে লাফ ঝাঁপ করে না। তারিকের বিনয় তারিককে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
তারিক সুজাতের বাবা স্বনামে সুখ্যাত তোফাজ্জল হোসেন। ছোটবেলায় মুকুল ফৌজ করতেন শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে। চাকরিজীবনে সরকারি তথ্য সার্ভিসে উচ্চপদে কাজ করেছেন। ১১৫২-এর ভাষা আন্দোলনের তিনি একজন সৈনিক। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলনে তোফাজ্জল হোসেনের কবিতা ছাপা হয়। এটাও এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বে তোফাজ্জল হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র তারিক সুজাত। তারিক তরুণ কবিদের প্রতিনিধি। দীর্ঘ তিন দশক ধরে তারিক কবিতা লিখছে। জাতীয় কবিতা পরিষদে প্রথম দিন থেকে সে জড়িত। এখন তারিক জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। বিগত বছরগুলোতে তারিকের একক কৃতিত্বেই কবিতা উৎসব আয়োজিত হয়।
তারিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কৃত্রিবাস’ পত্রিকার নামে ‘কৃত্রিবাস’ পুরস্কার পেয়েছে। ফৌজ পাবলিশিং থেকে বাংলা ভাষার সেরা কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় তারিক সুজাতের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তারিক সুজাত অবশ্য দুই বাংলাতেই কবি হিসেবে সুখ্যাত।
তারিকের বহুমাত্রিক কর্ম সাফল্য সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়া যাক। তারিক প্রিন্টিং সম্পর্কে আমার মতে সবচেয়ে সর্বজ্ঞ ব্যক্তি। ‘জার্নিম্যান’ নামে তারিকের সুখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা আছে। অসাধারণ মুদ্রণ সৌকর্য তার প্রকাশনায়। যেমন সাইজ, তেমন কাগজ, তেমন বাঁধাই। বইয়ের চরিত্র অনুযায়ী মুদ্রণ। বাংলা প্রকাশনায় এমন নজির নেই।
তারিক সুজাত মুদ্রণ পারিপাট্যে বিপ্লব এনেছেন। তার প্রিন্টিং প্রেসে ছোটখাটো নানা ধরনের মেশিন আছে। কত ধরনের ছাপার কলাকৌশল। বই বাঁধাইতেও অনেক নতুন আইডিয়া সংযুক্ত হয়েছে। তারিক দীর্ঘদিন ধরে প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তারিক নিজে অসাধারণ এক গ্রাফিক ডিজাইনার। ৯০ সালে তারিক ডাকসু নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদ প্রার্থী হন। তখন একটা নির্বাচনী পোস্টার প্রকাশ করেন। তারিকের নিজের করা অসাধারণ ডিজাইন। তারিকের প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে ছাত্রলীগ থেকে আমিও সাহিত্য সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলাম। মনে আছে শিল্পী বন্ধু ধ্রæব এষ আমার নির্বাচনী ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করে দিচ্ছিলেন। ধ্রæব একদিন বলল, আপনাকে তো ভোট দিতেই হবে। তা না হলে শুধু পোস্টারের জন্য তারিক ভাইকে ভোট দিতাম।
তারিকের গ্রাফিক ডিজাইনের এমনই শক্তি। তারিকের স্ত্রী মিমিও নানা স্থপতি ও ইনটেরিয়ার ডিজাইনার। বিভিন্ন জাদুঘরে নানা স্থাপনা নির্মাণে মিমি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারিক রাষ্ট্রতায় অনেক বড় বড় কাজ করে থাকে। এ নিয়ে তার কোনো অহংকার নেই। বঙ্গবন্ধু রচিত বইগুলোর তারিক প্রকাশনা তত্ত্বধারক। চীন ভ্রমণের ওপর বইটার গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো তারিক সংগ্রহ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইমেলা ২০২০ উদ্বোধনকালে তারিকের কথা উল্লেখ করেন। তারিক যে অসাধ্য সাধন করেছে তা উল্লেখ করেন।
কবি তারিক সুজাত অসম্ভব ভালো মানুষ। অল্প বয়সে তার সাফল্য অনেক বেশি। দেশ টিভি, ভোরের কাগজের সঙ্গে সে পরিচালক হিসেবে যুক্ত।
তারিক অসম্ভব ভালো মানুষ। নিরংহকারী সজ্জন ব্যক্তি। মানুষের জন্য উদার হস্ত। সাহায্য প্রার্থীকে সাহায্য করার জন্য সে ব্যাকুল থাকে। তারিক সাহায্য করে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। তারিক অসম্ভব মানবিক। কবি সাহিত্যিকদের সাহায্য সহযোগিতা করে নিয়মিত। একমাত্র কবিদের মৃত্যুতেই ভেঙে পড়তে দেখেছি তারিককে। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন- এদের মৃত্যু তারিক একেবারেই মেনে নিতে পারে না। কারো অসুখ হলে তারিক খুব উদ্বিগ্ন থাকে।
এমন ভালো মানুষ কবি কোথায় পাব? তারিকের সঙ্গে আমার সৌন্দর্যপূর্ণ সুন্দর সমাজ। সেই কলেজ জীবন থেকে তারিককে চিনি। তারিক ঢাকা কলেজে পড়ত আমাদের কিছুকাল পরে।
তারিক একসময় আজিমপুর কলোনীতে থাকত। তারপর দীর্ঘকাল থেকেছে শ্যামলীতে পৈতৃক বাসায়। তারিক পেইন্টিং লাভার এবং সংগ্রাহক। অনেক মূল্যবান পেইন্টিং তারিকের সংগ্রহে আছে। তারিক পুরনো বইয়ের সংগ্রাহক। অকিম-বাড়ি সর্বত্র তারিকের সংগ্রহের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আছে। আমার ধারণা তারিকের কাছে অনেক মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ আছে। যা তারিক প্রকাশ করে না। তারিকের প্রেসে শতবর্ষী পুরনো মেশিন আছে। দুষ্প্রাপ্য মেশিন। সেই মেশিনে কাজও হচ্ছে।
তারিকের সৃষ্টিশীলতার আমি একজন মূর্খ দর্শক। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। তারিকও ওর কর্মের গল্প আমার কাছে বলে আনন্দ পায়। আমিও মূর্খ শ্রোতা হয়ে শুনি।
তারিককে সবাই ভালোবাসে। তারিকের বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো কটু মন্তব্য শুনিনি। অগ্রজ কবিরা তারিককে খুবই ভালোবাসেন।
আমরাও তারিকের অনুরক্ত। তার কবিতার ভক্ত। তারিকের সঙ্গে দেখা হলেই নতুন ভুলানো হাসি। আন্তরিকভাবে সে উষ্ণতা ছড়িয়ে কথা বলবে। আর আমি দুষ্টামি করে বলব,
আমার পাঁচশো টাকা কইরে? দিলি না?
তারিক বলবে, নিশ্চয়ই দেব আমীরুল ভাই। রেডি আছে।
তারিকের সঙ্গে দেখা হলেই আমি পাঁচশো টাকা পাই। এটা আমাদের অনির্ধারিত শর্ত।
তারিকের মতো হৃদয়বান মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। বন্ধু তারিক, তুই সবসময় ভালো থাকবি। এই প্রত্যাশা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়