করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

পঙ্ক্তিচ্যুত

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সবেমাত্র কচুশাকের ঘণ্ট দিয়ে সে পাতের ভাত মাখতে শুরু করেছে, এমন সময় মাইক্রোফোনের শব্দে কান খাড়া করে, তার ডান হাতের পাঁচ আঙুল স্থির মুদ্রায় দাঁড়িয়ে পড়ে থালার ওপর। ভাতের প্রথম লোকমাটিও মুখে তোলা হয়নি। সারা দিনের শেষে সন্ধ্যাবেলায় সে এই রাতের আহারটুকু প্রতিদিনই গভীর মনোযোগের সঙ্গে সম্পন্ন করে। সে সময় নিজের ছেলেমেয়ে কিংবা বৃদ্ধ মায়ের দিকেও তাকায় না। ক্ষুধার আগুন পেটের নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে মাথার চাঁদি পর্যন্ত হানা দিলে সে কী করবে! হাট থেকে বাড়ি ফেরার পর হাতের ঝোলা নামিয়ে রেখে নদীতে ডুব দিয়ে এসে খেতে বসলে ভারি পরিতৃপ্তি হয়, শরীর-মন দুই-ই বেশ ঝরঝরে লাগে। কিন্তু পেটের খিদে মাথায় উঠলে সেদিন আর পা বাড়িয়ে নদীতে নামতে ইচ্ছে করে না। কোনোরকমে হাতেমুখে পানি ছিটিয়ে ঘরের দাওয়ায় খেতে বসে, পরপর বেশ কয়েক লোকমা কোনোদিকে না তাকিয়ে গোগ্রাসে খায়, এরই মাঝে ভেতরের রাক্ষসটা একটু শান্ত হলে ঢকঢক করে একগøাস পানি খাওয়ার পর ডানে-বামে ইতিউতি তাকায়, সবশেষে দরদমাখা কণ্ঠে ডেকে ওঠে- আমার বুড়ি কইরে, বুড়ি!
বুড়ি মানে তার একমাত্র কন্যা গুলবদন। এ নাম রেখেছে গুলবদনের দাদি। নাম যে পছন্দ হয়নি তা নয়। কন্যাদরদি বাপের অন্তর ভরে না ওই একনামে। মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকলে ওই একনামই ভেঙেচুরে সে নতুন নতুন নামকরণ করে- আমার গুলনাহার, আমার গুলবাহার, এই রকম আরো কত কী! তবে তার সবচেয়ে প্রিয় নাম হচ্ছে বুড়ি। কতদিন হাত নেড়ে নেড়ে বাধা দিয়েছে তার বৃদ্ধ মা, পান খাওয়া মুখে তড়বড়িয়ে বলেছে- বুড়ি আবার কিডা? বুড়ি হয়িচি আমি। তুমার গুলবদন তো বাপ ছুঁড়ি! বুড়ির বাপ মিটমিট করে হাসে, মায়ের কথার প্রতিবাদ করে না। বুড়ি এ দিকে সন্ধ্যা লাগতে না লাগতে ঘুমিয়ে কাদা। খাওয়া দাওয়া সেরে বুড়ির বাপ গিয়ে বসে ঘুমন্ত মেয়ের মাথার কাছে, চুলের মধ্যে হাত চালায়, আদর করে, এক সময় আলগোছে ঘুমিয়ে পড়ে বুড়ির সিথানে। লোকটা এই রকমই। গুলবদনের বড়ভাই কাশেম আছে, তারই প্রথম পুত্র, সারা দিন কোথায় থাকে, কী করে তার বেলা কোনো খবরই নাই। ছেলের ক্ষেত্রে কেন যে এমন উদাসীন, কে বলবে সেই কথা!
কাশেম যে একেবারে অকম্মার ঢেঁকি এমনও নয়। বাপ ঠেলে-গুঁতিয়ে ইশকুলে পাঠিয়েছিল ছেলেকে পৈতৃক-পেশায় যুক্ত করতে চায় না বলেই, কিন্তু ক্লাসের পাঠে মোটেই মন বসেনি তার; টেনেটুনে প্রাথমিক সমাপনীর দরজা ছুঁয়েই সটকে পড়েছে। বাপের হাতে বেধড়ক পিটুনি খেয়েও কাজ হয়নি, অকাজ হয়েছে; বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মন ভালো থাকলে তবু সে মায়ের কথা, দাদির কথা দু-চারটি শোনে। সেই কাশেম পুঁটিমারির বিলের কাদাপাঁক ঘেঁটে বেশখানিক খলসে পুঁটি চ্যাং মাছ ধরে এনেছে বিকালে। কাশেমের মা হেঁসেলে থেকে সেই মাছের ঝোল বাটিতে তুলে নিয়ে ঘরের দাওয়ায় এসে স্বামীর কাণ্ডকীর্তি দেখে ভিরমি খায়। ভাবনা হয়- শাকঘণ্ট কি পছন্দ হয়নি লোকটার! ভাত মেখে চুপচাপ বসে আছে যে বড়। একটুও দেরি না করে সে স্বামীর পাতে মাছ তুলে দিয়ে বলে- কী হলু তুমার! ভাত খাচ্ছো না যে!
নাহ, স্ত্রীর কথা সে কানেই তোলে না। পাতের কোনায় তুলে দেয়া মাছ-তরকারির দিকে মোটেই দৃষ্টি নেই তার। এমনকি সারা দিন পর নিজের বউটার মুখের দিকে তাকাবারও যেন ইচ্ছে হয় না। তবু সে নিরুপায় হয়ে স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, শাকঘণ্ট ভালো না লাগে তো মাছের তরকারি খাও, টমেটো দিয়ে রাইন্ধিছি, খাও। যে খাবে সে যেন শুনতেই পায় না স্ত্রীর আহ্বান। তার দুটো কান টাঙানো আছে আকাশে। বাতাসে ভেসে আসা দূরের কোনো দৈব ঘোষণা সে একাগ্রচিত্তে শোনে, সেই ঘোষণায় উচ্চারিত বাণীর অর্থ স্পষ্ট বুঝতে চেষ্টা করে। তার ভেতরের এত সব শব্দ-তৃষ্ণার খবর স্ত্রী জানবে কেমন করে! সে আরো এক টুকরো মাছ স্বামীর পাতে তুলে দিয়ে অনুনয় করে- পুঁটিমারি বিলির মাছ, খুব সোয়াদের মাছ, খাও দিনি!
অকস্মাৎ যেন-বা বিনামেঘে বজ্রপাত ঘটে। খাওয়া তো দূরের কথা, সহসা এক ধাক্কায় সে ভাতের থালা ঠেলে দিয়ে উঠে পড়ে। স্ত্রী একেবারে হতভম্ব। স্বামীর মনের তল খুঁজে পায় না। আতঙ্কিত কণ্ঠে সে আর্তনাদ করে ওঠে-
অমা, কী হলু! ভাত খাবা না?
লোকটা তখন চোখ কটমট করে তাকায় বউয়ের দিকে। বাইরে কোনদিকে যেন অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে তড়পে ওঠে।
মাইকে কী বোলচে, তা শুনতি পাচ্ছিস মাগি? কানে যাচ্ছে না?
যথার্থই চোখ কপালে ওঠে বউটার। ইশকুলপাড়ায় মাইক বাজছে সেই বিকাল থেকে। দমাদম গান বাজছে হিন্দি-বাংলা। গ্রামে যাত্রাপালার আয়োজন হয়েছে তিনদিনের জন্য। মাইক বাজছে সেইখানে। গুলবদনের মা সেদিকে কান দিতে যাবে কোন দুঃখে! সে আছে নিজের ঘরকন্না নিয়ে। দিনের শেষে স্বামী বাড়ি ফিরলে ভাত-তরকারি বেড়ে সামনে ধরা তার নৈমিত্তিক কাজ। মাইকে কান পাতার সময় কোথায় তার! এতক্ষণে মাইক্রোফোনের ঘোষণা বাতাস ভেঙেচুরে এসে কানে ঢোকে; উত্তরপাড়ার বদরউদ্দিন ওরফে বদু পরামানিক, তুমি যেখানেই থাকো, অতিসত্বর তোমার অস্ত্রপাতিসহ যাত্রাপালার প্যান্ডেলে এসে দেখা করো। বদু ভাই, তোমাকে আমাদের জরুরি প্রয়োজন। শিগগিরই যোগাযোগ করো।
কে এই বদু পরামানিক? চমকে ওঠে গুলবদনের মা। বিয়ের পরও অনেক দিন যাত্রাগানের নেশা ছিল লোকটার, পেশার প্রতি টান ছিল না, আলোমতি-প্রেমকুমারে অভিনয় করেছে দরদ দিয়ে; এতদিন পর তার খোঁজ কেন? সংসারে ছেলেপুলে আসার পর সে পৈতৃক পেশার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হয়েছে। ঝোলার মধ্যে ক্ষুর-কাঁচি নিয়ে প্রতিদিন হাটে হাটে ঘুরে যা আয়-রোজগার হয়, তাতে বেশ চলে যায়। দিনে দিনে ইশকুলপাড়ায় বাজার জমে উঠছে, তার ইচ্ছে ওই বাজারে একটা সেলুন-দোকান দিয়ে থিতু হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু আবারও যাত্রাগানের মাইকে তার নাম গাইছে যে! গুলবদনের মা উৎকণ্ঠায় চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে স্বামীর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে। ভাতের থালা ঠেলা দিয়ে সরিয়ে বদু পরামানিক প্রথমে জামা গায়ে দেয়, সেই জামা টেনে টুনে ফিটফাট করে, তারপর চিরুনি বের করে মাথার চুলে ব্যাকব্রাশ করে। স্বামীর প্রস্তুতি এবং মতিগতি দেখে বাধা দেবার সাহস হয় না তার, তবু সামনে দাঁড়িয়ে অনুনয় করে- যিখানে যাবা যাও, একমুঠু ভাত মুখি দিয়ি যাও।
না, ভাত খাবার সময় নেই বদু পরামানিকের। তার যুক্তি খুব সহজ-সরল। পরে এসে ভাত খেলেও চলবে। কিন্তু ওই যে মাইকে বললো- ‘বদু ভাই, তোমাকে আমাদের জরুরি প্রয়োজন।’ এ আহ্বান সে উপেক্ষা করবে কীভাবে! অবুঝ স্ত্রীকে সে বুঝিয়ে বলে- মাইকে নাম ডাকে কজনার, বোল দিনি! পাড়ায় মণ্ডল-মাতুব্বর নেই! কই, তাদের তো ডাকছে না! মিজান মেম্বারের বাড়ির কাছে তার বাড়ি, সেই মেম্বারকে না ডেকে তাকে ডাকছে কেন? ভেতরে ভেতরে গুরুতর একটা কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। না, মোটেই দেরি করা চলবে না। দ্রুত পায়ে তাকে পৌঁছুতে হবে গ্রিনরুমে।
স্বামীর কথার কোনো উত্তর জানা নেই গুলবদনের মায়ের। কেন যে মাইক্রোফোনে বদু পরামানিকের নাম এত গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে, তার অন্তর্নিহিত কারণও সে উপলব্ধি করতে পারে না। ভয়ে ভয়ে কোনোরকমে সে জানতে চায়- তুমি কি আবারও যাত্রাপালায় নামবা?
মাত্র এই একটা প্রশ্নেই বদরউদ্দিন ওরফে বদু পরামানিক ধাঁ করে রেগে যায়। চোখ কটমট করে তাকায় স্ত্রীর দিকে। রাগে রাগেই বলে, ঘরের বাইরে বারানির সুমায় এত প্রশ্ন করিসনি তো! আমার অস্ত্রপাতির ব্যাগডা দে। রাত্রি বাড়ছে, সে হুঁশ আছে?
প্রতিদিন হাটে রওনা হওয়ার সময় স্বামীর অস্ত্রপাতির ঝোলা নিজে হাতে গুছিয়ে দেয় গুলবদনের মা। এ ডিউটি তার নতুন কিছু নয়। অন্যান্য দিন আনন্দের সঙ্গে এ-দায়িত্ব পালন করলেও এই সন্ধ্যায় হাত বাড়িয়ে সেই ঝোলা এগিয়ে ধরতে মোটেই ভালো লাগে না। তবু সেটা করতে হয়। স্বামীর হাতে ঝোলা তুলে দিয়ে সে ফ্যাচ করে কেঁদে ফেলে এবং শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে প্রস্তাব করে- তাড়াতাড়ি বাড়ি চইলি আসবা কিন্তু।
বদু পরামানিক বিরক্ত হয়। স্ত্রীর হাত থেকে ছোঁ মেরে ব্যাগটা নিয়ে পথে নামতেই তার পা হড়কে যায়। ‘আহ’ করে সে কাতরে ওঠে অন্ধকারে না দেখে তেকোনা ইটের খোয়ার ওপরে পা তুলে দেয়ার কারণে কষ্ট পায়, অথচ সে মুখে গরজ গরজ করে, মাগি মানুষির চোখের পানিতি পথঘাট ভিজি পেছল হলি চলে!
তেকোনা ইটের খোঁচায় কঁকিয়ে উঠলেও বদু পরামানিক অতিদ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। মাইকের কড়কড়ে ঘোষণা তখনো বাতাসে ভেসে আসছে- ‘বদরউদ্দিন ওরফে বদু পরামানিক, তুমি যেখানেই থাকো…।’ যেখানেই মানে, বদু মনে মনে ঘোষণা করে- এই যে আমি এখান থেকে রওনা হয়েছি। ইশকুলপাড়া পর্যন্ত যাওয়ার সময়টুকু দিতে হবে তো! আমি কি পঙ্খীরাজের মতো উড়ে যাবো!
পড়ি কি মরি করে ছুটে চলে বদু পরামানিক। পাড়ার সরু পথ ছেড়ে সদর রাস্তায় উঠতেই তার চোখের আঁধার ঘোর কেটে যায়। যাত্রা প্যান্ডেলকে ঘিরে ইশকুলপাড়ার ছোট্ট বাজারটি ঝকমকে বিজলিবাতির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। আলোর ফাঁদে পতঙ্গের আত্মাহুতির মতো গ্রামের মানুষ দলে দলে এগিয়ে যাচ্ছে আলোকোজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চের দিকে। বদুও সেই মানবপ্রবাহে নিজেকে শামিল করে। তবে তার বুকের ভেতর অন্যরকম বেলুন ওড়ে, বাতাসে দোল খায়; যেন-বা সেই রঙিন বেলুনই তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। রাস্তা দিয়ে তো কত মানুষই চলেছে যাত্রা প্যান্ডেলের দিকে, মাইকে তাদের কারও নাম বলছে? চিৎকার করে বলছে বদরউদ্দিন ওরফে বদু পরামানিকের কথা। শুধু বলছে না, বদুভাই বলে সম্মান দিয়ে ডাকছে। এ কি একেবারে চাট্টিখানি কথা! এমন সৌভাগ্য হয় কজনের? সবার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটলেও এ কারণেই বদু পরামানিক ভেতরে ভেতরে নিজেকে বেশ আলাদা করে রাখে। তার সে জগতে সে একা, নিঃসঙ্গ।
প্যান্ডেলের কাছে এসে পৌঁছুতেই সালাম মাস্টারের সঙ্গে দেখা। যাত্রা-কমিটির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সে-ই সহসা বদু পরামানিককে চেপে ধরে, কী ব্যাপার বদুভাই, তুমি এ দিকে ঘুরঘুর করছো কেন? তোমাকে যে গ্রিনরুমে ডাকছে! বদু ঝটপট জবাব দেয়-

ঘুরঘুর করছি কোথায়। এই তো আমি আসছি।
বেশ করেছো। এখন চলো, গ্রিনরুমে চলো দিনি!
মানুষের গজগজানো ভিড় ঠেলে সালাম মাস্টার হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসে বদু পরামানিককে। ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় গ্রিনরুমের ভেতরে। সেখানে তখন রাজা-রানী, মন্ত্রী-সেনাপতি এমনকি রাজকন্যারও মেকআপ নেয়া হয়ে গেছে। বাকি আছে রাজকন্যার দুই সহচরী এবং কয়েকজন রাজনর্তকীর মেকআপ গ্রহণ। যাত্রাপালার ম্যানেজার শিবেন বাবু উচ্ছ¡সিত গলায় বলেন-

বদু এয়েচিস! তোর ক্ষুর-কাঁচি আছে তো সঙ্গে?
বদু পরামানিক ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
শিবেন বাবু পিঠ চাপড়ে বলেন-

গুড। এই ছোঁড়াদের একটু কামিয়ে দেতো বাপু।

বদু সেই ‘ছোঁড়াদের’ খোঁজে এদিক সেদিক তাকায়। তাদের মেয়েলি ড্রেস-আপ হয়ে গেছে। হয়নি মেকআপ। শিবেনবাবু সেই দিকেই ইঙ্গিত করেন-

ফিমেল-রোল করবি, গোঁফ-দাড়িটা কামিয়ে আয়! তা নয়, বিয়ের সময় কন্যে বলে ইয়ে…ঠোঁটের ফাঁকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে এবার তিনি আদেশ করেন, দাঁড়িয়ে কী দেখছিস বদু! ঝটপট কামিয়ে দে ছোঁড়াদের। ঘণ্টা পড়ে গেলো যে! বদু পরামানিক ঝোলার মধ্যে হাত চালিয়ে ক্ষুর-কাঁচি বের করে আনে। এ রকম ঘটনার সঙ্গে তার পরিচয় মোটেই নতুন নয়। অনেক দিন আগে সে নিজে আলোমতি-প্রেমকুমারে ফিমেল রোল করেছে। স্টেজ অভিনয়ের দিন দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে আসা নিজ দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তা এখনকার ছেলেপিলের সেই হুঁশ থাকলে তো! শিবেন বাবু সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আর মুখে গজর গজর করতে করতে গ্রিনরুম ছেড়ে বেরিয়ে যান। বদু পরামানিকেরও নেশা হয় ধূমপানের। পকেট হাতড়ে আধভাঙা একটা কাগজের বিড়ি বের করে দেশলাই খোঁজে। এদিক ওদিক তাকায়। ফিমেল-রোল করা এক ছোকরা সংকটটা বুঝতে পেরে আনডারপ্যান্টের পকেট থেকে দেশলাই বের করে বাড়িয়ে ধরে। ফস করে দেশলাই জ্বেলে সে বিড়ি ধরায়। হুসহুস করে দম কষে, তারপর হুকুম করে, কে কে দাড়ি কামাবা রেডি হও।
হাতের বিড়িটা যখন একেবারে ফুরাবার পথে, সেই সময় কাচের গøাসে টলটলে চা এলো। লাল লিকার। ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। শীত-রাত্রির চা ভালোই লাগে। বিড়িটা ফুরাবার আগে হলে আরো ভালো হতো। চায়ের ওম থেকে হাত সেঁকে বদু কাজ শুরু করতে যাবে, এমন সময় চায়ের দোকানের ছোকরা এসে এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট দিয়ে বলে- শিবেন কাকা পাঠিয়েছে।
ড্রেসআপ মেকআপ কামানো সাজানো সবকিছু সারা হয়ে গেলে বদু পরামানিক সিগারেট জ্বালিয়ে আয়েশ করে টানে, গোল গোল কুণ্ডলি বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে; গ্রিনরুম থেকে চোখের সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গিয়ে মঞ্চে ওঠে, আবার ফিরে আসে। গ্রিনরুমে বসে মঞ্চের কী-ইবা দেখা যায়! বহুদিন পর বদু পরামানিকের যাত্রা দেখার বাসনা জাগে। কিন্তু এই বাসনার কথা সে কাকে বলবে? সালাম মাস্টার সেই যে তাকে ধরে এনে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো, আর একবারও উঁকি দিয়ে দেখলো না। আর শিবেন বাবুই বা কেমন লোক! কাজে লাগিয়ে দিয়ে সিগারেট-চা পাঠালেই সব হয়ে গেল! একবারও তার দেখাই পাওয়া যাবে না! গ্রিনরুমের মধ্যে বসে থাকতে মোটেই ভালো লাগে না বদুর। সে বাইরে এসে প্যান্ডেলের চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে দেখে। এক সময় টিকেট কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ায়। তখনো বেশ কজন লোক টিকেটের জন্য দাপাদাপি করছে। যাত্রা শুরু হয়ে গেছে, তাদের ধৈর্য্যচ্যুতির যথেষ্ট কারণ আছে। তারা পারে তো টিকেটের জন্য মারামারি করুক, মাথা ফাটিয়ে দিক একে অপরের; বদুর কিছুই যায় আসে না। বদু কি টিকেট কেটে যাত্রা দেখতে যাবে নাকি! মাথা খারাপ!
কিন্তু মাইকে তো আর বদরউদ্দিন বদুর নাম এখন ঘোষিত হচ্ছে না, এই অসময়ে কে তাকে চিনবে! মঞ্চে তখন ঝুমুর ঝুমুর ড্যান্স চলছে। মাইকে হিন্দি গানের ফাঁকে ফাঁকে গলা কাঁপানো ঘোষণা চলছে- হ্যাঁ ভাই, আপনারা দেখছেন একঝাঁক ডানাকাটা পরীর নৃত্য…। ফরিদপুর থেকে আগত মিস লাইলী বানু এবং তার সহশিল্পীদের চোখ ধাঁধানো জমকালো নাচ…। বদুর ভয়ানক হাসি পায়। মনে মনে বলে- ডানাকাটা পরী না ছাই! কোথায় ফরিদপুর, গোয়ালন্দঘাট থেকে ধরে এনেছে ওই তো এক আধবুড়ি লাইলীকে! আর সবই তো বুকে কাপড়ের পোঁটলা-গোঁজা ছোকরা, বদুর হাতে গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে ছুকরি সেজেছে! তাদের আবার নৃত্য! কী যে অব্যক্ত টান, বদুর তবু প্যান্ডেলের ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই ইচ্ছের কথা সে বলবে কার কাছে, সেটাই বুঝে উঠতে পারে না। প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বদু দাঁড়িয়ে পড়ে ফার্স্টক্লাসের গেটের মুখে। সবচেয়ে উচ্চমূল্য দিয়ে টিকেট কিনে দর্শকরা এসে চেয়ারে বসে আয়েশ করে। তারা ঢোকে এই গেট দিয়ে। বদু সেখানে খালি হাতে হাজির হলেই কি ঢুকতে দেবে! বিলপাড়ার লিহাজুদ্দির ছেলে শফিকুল গেটম্যান হয়েছে দেখে ভেতরে ভেতরে একটুখানি আশ্বাস জাগে- শিক্ষিত ছেলে, শখের গেটম্যান হয়েছে, বদু পরামানিককে ঠিকই চিনবে, তার দাবির ব্যাপারটা নিশ্চয় বুঝবে। হ্যাঁ, বাস্তবেও হলো তাই। তাকে দেখে বেশ উচ্ছ¡সিত কণ্ঠে শফিকুল শুধায়-
কী ব্যাপার বদু ভাই, আবার যাত্রাপালায় নামবা নাকি?
এ প্রশ্নে বদু একটু লজ্জা পায়। কুণ্ঠার সঙ্গে বলে-

আরে নাহ! আমি আলাম তুমাদের এই ছোকরাদের গোঁফ-দাড়ি কামাতি।
ছোকরাদের ছুকরি সাজাবার কৃত্রিম আয়োজনের কথা মনে পড়ায় শফিকুল খুক করে হেসে ওঠে। তারপর একটু থেমে সে বলে-
অ। তাইতি মাইকে তুমার নাম শুনলাম খানিক আগে!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুইনিচো তাহলি!
হঠাৎ দুজন টিকেটধারী দর্শক আসায় শফিকুল সেদিকে মনোযোগ দেয়। বদু একটুখানি বিব্রতবোধ করে। তবু আপন গরজে সে বলে যায়-
কামানোর কাজ কামিয়ি দিলাম, অ্যাখুন একটু যাত্রা দেখতি পালি তো হয়!
শফিকুল ঝটপট বলে-
যাত্রা দ্যাখবা? টিকেট কাটা হয়িছে?
নিজেকেই পরিহাস করে ওঠে বদু-
বদু নাপিত যাবে টিকেট কাটতি! ফুটুনি আর দ্যাখবা কত!
শফিকুল আপত্তি জানায়-
না না বদুভাই, টিকেট ছাড়া ঢোকা যাবে না। তাহলে তুমি কমিটির কারও সঙ্গে কথা বলো। না হয় শিবেন কাকার সঙ্গে দেখা করো। ব্যবস্থা একটা হবে।
শীতের আমেজের মধ্যেও বদুর কপালে ঘাম ফোটে। সে মরিয়া হয়ে জানতে চায়, তুমার হাতে কুনু ব্যবস্থা নি?
সরাসরি উত্তর না দিয়ে শফিকুল পরামর্শ দেয়-
তুমি বরং মিন্টুর কাছে যাও বদুভাই, সেকেন্ড ক্লাসের গেটে আছে…
বদু কান খাড়া করে-
কোন মিন্টু?
তোমাদের পাড়ারই ছেলে। মিন্টুকেই বলো…
ময়নাল বিলাকির ছেইলি মিন্টু! সে তো চশমখোর চামার!
বদু পরামানিকের গা-জ্বালা করে। শফিকুলের সঙ্গেও আর কোনো কথা না বলে সে পা বাড়ায়। প্যান্ডেলের গা ঘেঁষে যেতে যেতে সেকেন্ড ক্লাসের গেটের মুখে মিন্টুকে দেখতে পায়, সিগারেট টানছে ধুমসে। ভিড় কমে এসেছে গেটে। বদুর দিকে তার দৃষ্টি পড়তেও পারে। কিন্তু বদু সেটা চায় না। নির্ঘাৎ একগাদা কথা শুনিয়ে ছাড়বে। তার চেয়ে দেখা না হওয়াই ভালো। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় থার্ডক্লাসের গেটে। তার থার্ডক্লাসই ভালো। সে মাটির মানুষ, মাটিতেই বসতে চায়। লাভ-ক্ষতির কিছু নেই, যাত্রা দেখা হলেই হলো। কিন্তু বদু পরামানিকের কপাল যে অত প্রসন্ন নয়। থার্ডক্লাসের গেটে লম্বা লাঠি হাতে যমদূতের মতো এক গেটম্যান দাঁড়িয়ে। লম্বা গোঁফঅলা এই লোকটিকে কখনো এই গ্রামে দেখেছে বলে তো মনে পড়ে না তার। কোথাকার লোক কে জানে। চোখ গোল গোল কালো কুচকুচে এই পালোয়ানকে কি বাইরে থেকে হায়ার করে আনা হয়েছে। তাহলে তো সেও বদুকে মোটেই চিনবে না। না চেনে তো না-ই চিনুক। কী হবে না চিনলে! হঠাৎ ভেতরে ভেতরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে বদু পরামানিক। গেটম্যানের কাছে গিয়ে সে নিজের পরিচয় দেবে। ক্ষতি কী তাতে! প্রথমে একটু ভয় ভয় করলেও কাছে গিয়ে টের পায় লোকটা আসলে ততটা ভয়াবহ নয়। বদুকে, কোথা থেকে আসছে, কেন এসেছে সব জানার পর সেও স্বীকার করে মাইক্রোফোনের বদরউদ্দিন ওরফে বদু পরামানিকের নাম বেশ কবার শুনেছে। বহুল প্রচারিত সেই বদু পরামানিকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে সে খুবই আনন্দিত কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে বিনা টিকেটে এবং কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দিতে পারবে না। অগত্যা কী আর করা, বদরউদ্দিন ওরফে বদু পরামানিক অস্ত্রপাতির ঝোলা হাতে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। যাত্রামঞ্চ থেকে তখন বিবেকের কণ্ঠের উদাত্ত গান বাতাসে আছড়ে পড়ছে-
ওরে ভোলা মন
কারে যে তুই পর করেছিস কে যে আপনজন
কার কারণে কাঁদিসরে মন
করিস হুতাশন….।
আলোকোজ্জ্বল ইশকুলপাড়া পেছনে ফেলে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েও বদু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে- না, এ পথে সে যাবে না। পথের মানুষের সঙ্গে তার দেখা হোক, সে আর তা চায় না। হোক ঘুরো পথ, বাড়ি ফিরতে দেরি হয় হোক, তবু সে নদীর পাড় ধরে যাবে। শীতের শুকনো নদী, বুকের ওপরে একফালি আঁচল ফেলে কেমন নির্বিকার শুয়ে আছে! লজ্জা-শরম নেই, মান-অপমানের বালাই নেই, কেমন নির্বিবাদী চরিত্র! নদীর পাড় ধরেই হাঁটতে থাকে বদু। হাঁটতে হাঁটতে স্ত্রীর মুখ মনে পড়ে, পুত্র-কন্যার মুখ মনে পড়ে। নিশ্চয় বুড়ি এতক্ষণ ঘুমিয়ে কাদা। ঘুমানোর আগে ভাত খেয়েছে তো! মনে মনে ভাবে- তখন ভাতের থালাটা ওইভাবে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। তারপর আর ভাত খাবে কী করে বুড়ির মা!
বরদউদ্দিন ওরফে বদু পরামানিক নদীর পাড় ধরে হাঁটছে তো হেঁটেই চলেছে উধাও। যেন বা বাড়ি ফেরার ঠিকানা হারিয়ে ফেলা অবোধ বালক সে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়