করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

ফ্রেমে বাঁধানো ছবি

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জাল ফেলা হয়েছে পুকুরে। বিরাট পুকুর। ঘোলা জল। কোথাও মাছ উয়াস কাটছে তাও নয়। জল যতই ঘোলা হোক, মাছ থাকলে ভুড়ভুড়ি কাটতই। সরাফত আলী নিজেও জানেন সে কথা। মাছ ধরা তার উদ্দেশ্য নয় অবশ্য। ছবি ধরার জন্য জাল ফেলেছেন পুকুরে। পুকুরে ছবি ধরবেন? হ্যাঁ, ঘটনা সত্যি। একটা ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবি পুকুরটাতে ফেলেছিলেন নিজেই। কতদিন হবে? আট-নয় মাস। গ্রাম ছাড়ার আগে গায়ের চাদর দিয়ে ভালো করে মুড়েছিলেন ছবিটা। তার ওপর অয়েলক্লথ পেঁচিয়ে বেঁধেছিলেন পাটের দড়িতে, পানি না ঢোকে যেন। সেই ছবি এখন কোথায়, কীভাবে আছে সেটাও প্রশ্ন।
আট-নয় মাস তো কম সময় নয়। জল গড়িয়েছে কত। কত কিছু ঘটে গেছে দেশটাতে, এই নয় মাসে! রক্তে লাল হয়েছে সবুজ জমিন। আকাশ ভারি হয়েছে মা-বোনদের চিৎকারে। কাকও বসতে পারেনি গাছে। আতঙ্ক, ভয়, দুঃস্বপ্নের মতো মৃত্যু তাড়িয়ে বেরিয়েছে গোটা দেশটাকেই। শ্মশানের মতো জ্বলেছে দেশ। কী সীমাহীন অত্যাচার, নির্যাতন, নির্মমতা সইতে হয়েছে মানুষকে! অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন সরাফত আলী। ‘কইলেই হইলো আমাগো দেশেরটা খাইব, লইব, শেষকালে আমাগোরেই চোখ গরম? এক ফোটা রক্ত গায়ে থাকতে পায়ের তলার মাটিটাও ছাড়ব না।’ প্রায় নয় মাস আগে যখন ঘর ছাড়েন, তখন এই ছিল তার মুখে। তখনো পাকিস্তানি শকুনদের কালো ছায়া পড়েনি বিনোদপুরে। তার মতো গ্রামের আরো অনেকেই গিয়েছিলেন যুদ্ধে। কেউ ফিরেছেন, কেউ ফিরেননি। যারা ফিরে আসেননি, তাদের আশাও ছাড়েনি পরিবার। এখনো শেষ হয়নি ঘরে ফেরা। একজন দুজন করে ফিরছেন। যুদ্ধ করতে করতে কে কতদূর গেছে কে জানে? দূরগ্রাম থেকে আসতেও তো সময় লাগে। এই প্রবোধ মনে নিয়ে পথ চেয়ে আছেন অনেকে। ‘দেশ স্বাধীন হইছে। এখন আর মিলিটারির ভয় নাই। একদিন না একদিন ঠিকই ফিরব ঘরের ছেলে।’
পুকুরের দখিন পাশে ঝাঁকি জালটা দুইবার মেরেছেন সরাফত আলী। কয়েকটা দারকিনা, তিতপুটি, চিংড়ি, শামুক আর গাছের পচা ডালপালা উঠে এলো। কিন্তু ছবিটার কোনো হদিস মিলল না। স্পষ্ট মনে আছে তার, যাওয়ার আগে পুকুর পাড়ের তেঁতুলগাছটা বরাবর দখিনেই আলগোছে পানিতে নামিয়ে দিয়েছিলেন ছবিটা। না লুকিয়ে উপায় ছিল? ছবিটা পাকিস্তানি বর্বরগুলোর চোখে পড়লে আস্ত রাখত? ঘরদোড় সব পুড়িয়ে দিতো আগুনে। মাটি খুঁড়ে উচ্ছেদ করত বাপদাদার ভিটে। গ্রাম শুদ্ধ উজাড় করত খাকিউর্দি পরা শয়তানগুলো। সরাফত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যুদ্ধ থেকে ফিরতে পারলে যথাস্থানে ঝোলাবেন ছবিটা। সময় হয়েছে প্রতিজ্ঞা রাখার।
দক্ষিণ থেকে কয়েক কদম সরে আবারো জাল ফেললেন সরাফত। মাছ যেন হরকে না যায়, ঠিক সেভাবেই দক্ষ জেলের মতো টেনে টেনে তুললেন জালটা। এবারো কিছু মিলল না। তাহলে কি ছবিটা গহিনে নেমে গেছে? মাঝ পুকুরে? গহিন তো কম নয়। দাদার বাপের আমলের পুকুর। মাটি তুলে ঘর বেঁেধছিলেন প্রপিতামহ হায়াত আলী। তাও বহু আগের কথা।
সরাফত আলী উপায় খুঁজতে লাগলেন। কী করা যায়। পানির ঠমকে হরহরিয়ে মাঝেই নেমে গেছে হয়তো ছবিটা। উদ্ধারে যা করতে হয় করবেন। তাও ছবিটা তার চা-ই চাই। এই ছবির মানুষটাই তার জীবন বদলে দিয়েছেন। কী সরাফত আলী কী হয়েছেন। অলস, অবোধ বিশেষণ ছিল তার নামের পরে। নিত্য কত গালমন্দ শুনতে হতো পরিবার, পাড়া প্রতিবেশীর। সেই ছেলে সরাফত দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন, ভাবা যায়?
মানুষটাকে স্বচক্ষে দেখেননি কখনো। কণ্ঠস্বর শুনেছেন তাঁর। বেতারে। কী দরাজ গলা! সরাফত আলীর বাবার মতো। বাবারও এমন ভরাট গলা ছিল। পল্লীগীতি গাইতেন বাবা। শৌখিন মানুষ ছিলেন। বাইরে ছিল একটা শাদামাটা জীবন। একেবারে মাটির মানুষ। মিষ্টি হাসি লেগে থাকত মুখে। একদিন চিকন্দির হাট থেকে বাবাই তাকে কিনে দিয়েছিলেন ছবিটা। কাচে বাঁধানো। কাঠের ফ্রেম। সূর্যের আলো পড়তেই কাচটা কেমন ঝাঁ চকচক করত। সেই ঝলমলে আলো এসে পড়ত মুখে। নরম আলোয় মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। পেরেক পুঁতে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন মাটির দেয়ালে। সেই থেকে এই বাড়িরই একজন হয়েছিলেন তিনি। মিহিদানা হাসিমুখের মানুষটির অতলস্পর্শী দুটো চোখ। থির হতে থাকা দীঘির জলের মতো। বড় গভীর, সুদূরে দৃষ্টি। ছবিটার দিকে তাকালে সরাফত আলীর মনে হতো, মানুষটি তাকে ডাকছেন। বলছেন, ‘কীরে খোকা দেশের জন্য লড়তে পারবি তো?’ তখন মাথা নাড়তেন সরাফত আলী। মনে মনে বলতেন, ‘আপনে বললে জীবনও দিতে পারমু।’
‘সাব্বাস বেটা, বাঘের বাচ্চা। তোদের হাতেই বাংলা মা আমার স্বাধীন হবে, কথা দিলাম।’ যেন উত্তর করতেন ছবির মানুষটা।
জাল মেরে কাজ হবে না। যা করার সরাফত আলীকেই করতে হবে। গায়ের কোর্তাটা খুলে নামিয়ে রাখলেন পুকুর পাড়ের ঘাসের ওপর। মালকোচা মারলেন লুঙ্গিতে। ছোটবেলায় ডুব সাঁতারে পুকুরের এমাথা-ওমাথা করেছেন কতো। বুদবুদি ছেড়ে এক ডুবে তুলে এনেছেন তলার মাটি। সেই মাটিতে হাতি-ঘোড়া, থালা-বাটি কত কী হতো! সেই দিন কত আগে গত হয়েছে বটে। সাঁতার তো আর ভোলেননি।
পৌষের শেষাশেষি। শীত জেঁকেছে বেশ। কনকনে ঠাণ্ডা। পুকুরের থির জলও জমে বরফ-হিম। সরাফত আলী দখিনের পাড় বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেলেন জলে। পা দুটো নামাতেই কামড়ে ধরল জল। শিরদাড়া বেয়ে পিলপিল করে ওপরে উঠে গেল শিরশিরে ভাব। একবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল শরীরটা। কাঁটা দিল লোমকূপে। মাখনের মতো নরম কাদায় পা দুটো আস্তে আস্তে সিধিয়ে যেতে থাকল। জলের দাঁতগুলো পায়ের গোড়ালি থেকে কামড়ে কামড়ে উঠে এলো কোমর অবধি। শীতে টান ধরেছে জলে। পাড়ের দিকে অন্য সময় জল থাকে বুক বরাবর। এখন শুষে গিয়ে নেমেছে কোমরে। সরাফত আলী নখ দিয়ে কাদা খামছে ধরে থিতু হওয়ার চেষ্টা করলেন। বাঁ পায়ে শরীরের ভর দিয়ে ডান পা-টা আলগা করলেন মাটি থেকে। তেঁতুলগাছটা নিশানা করে সামনে এগোলেন দু-কদম। তারপর ডান পা-টা তলানীর মাটিতে ঘষে ছবির ফ্রেমটা ঠাওরানোর চেষ্টা করলেন। না, পঁচা পাতা, গাছের ডাল, নারকেলের মালই ছাড়া কিছুই বাঁধে না পায়ে।
সরাফত আলী ফের মুখ ফেরালেন তেঁতুলগাছটার দিকে। তার অদূরেই মাথা তুলে আকাশ ছোঁয়া দেবদারু গাছ। এগিয়ে গেলেন দুই গাছের মাঝের শূন্য জায়গা বরাবর। এবার বাঁ পা-টা কাদামাটিতে ঘষতে ঘষতে জিনিসটাকে হাতড়ে বেড়ালেন। চ্যাপ্টা ঠোঁটে হাঁসের কাদা খাওয়ার মতো বুড়ো আঙুলটাকে সিঁধিয়ে দিলেন কাদার ভেতর। তেলতেলে কাদামাটির পরতে পরতে গাছের মজে যাওয়া ডালপালা, ভাঙা শামুক। পলি পরে পরে আড়াল হয়েছে। আঙ্গুলের খোঁচায় খোঁচায় তার হাড়গোড় ঠেকছে পায়ে। ছবিটার কোনো হদিস নেই।
সরাফত আলী বিচলিত বোধ করেন। গেল কোথায় ছবিটা? তিনি তো অয়েলক্লথে মুড়ে এখানেই নামিয়ে দিয়েছিলেন। এবার একটু চোখ ফেরালেন উত্তরে। ছবিটা হয়তো জলের টানে আরও একটু গভীরে নেমে গিয়ে থাকবে। আট-নয় মাস আগে যেখানটায় যা ছিল, তা কি আর সেখানে আছে? ছবিটার কি হাত-পা আছে? না থাকুক, তাতে কী? জায়গা বদল হয়েছে নিশ্চয়ই। যেভাবেই হোক। তা না হলে যাবে কোথায়?
সেই বসন্তের শেষভাগে একরাতে বাড়ি ছেড়েছিলেন সরাফত আলী। কৃষ্ণপক্ষের রাত। নিজের শরীরও দেখা যায় না। উনুনে মাটির পোড়া হাড়ির মতো কালো। তারপর আম-কাঁঠাল পাকলো। বর্ষায় বান ডাকলো মাঠে ঘাটে। আকাশের কালো মেঘ আস্তে আস্তে সরে গিয়ে এল শরৎ। কাশের বনে নেমে এলো ধবধবে আলখেল্লা পরা এক দরবেশ। হেমন্তের মাঠে সোনালি পাড়ের শাড়ি পরা কুমারী ধান। কোথাও ছাই হয়েছে আগুনে পুড়ে। কোথাও নতুন বউয়ের মতো তাকে ঘরে তুলেছেন কৃষক। এই বিষাদ-আনন্দের মাঝেই খবর এলো, স্বাধীন হয়েছে দেশ। আর কোনো ভয় নেই। নীল আকাশটাকে ডানায় ঢেকে রেখেছিল যে শকুন, উড়ে গেছে সে। কত কিছু হয়ে গেল এই নয় মাসে!
দুধের সরের মতো হালকা আবরণ পড়েছে জলে। তার ওপর দৌড়ে বেড়াচ্ছে জল-মক্ষিকা। সরাফত আলী প্রেয়সীর চুলে বিলি কাটার মতো জল কেটে কেটে যেতে থাকেন গহিনের দিকে। কোমড়ে দাঁতবসানো জল এখন দাঁত বসাচ্ছে বুকে-পিঠে। হিম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। সরাফত আলী তোয়াক্কা করছেন না কিছুই। গায়ের ছেলে। শীতে জলের কামড় তার ভালোই রপ্ত। দুপায়ে কাদামাটি ঘষে ঘষে নেমে গেলেন মাঝপুকুরের দিকে। এখানে সংসার পেতেছে জলকলমি। গাঢ়ো সবুজ পাতা। টিয়ে রং লতা। থোকায় থোকায় ফুটে আছে ফুল। শাদা পাপড়ির মাঝে হালকা বেগুনি আভা। অদূরেই উঁকি দিচ্ছে কয়েকগুচ্ছ নীলকমল। থালার মতো সবুজ পাতাও দুলছে মৃদু ঢেউয়ের তালে তালে। দুহাতে কলমির ঝোঁপটা উত্তরে ঠেলে দিয়ে জায়গা করে নিলেন সরাফত।
কাঁধ ছাড়িয়ে গলা ছুঁয়েছে জল। ধীরে ধীরে তল খোঁজার চেষ্টা করছেন দুপায়ে। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মানুষটাকে যেন দুই বাহু ধরে ভাসিয়ে রেখেছে কেউ। তা না হলে তলানির নাগাল পাবেন না কেন? বুড়ো আঙুলটাকে খাড়া করে দিলে বুঝতে পারেন, তাকে খুব বেশি উঁচু করে ধরতে পারেনি। জলটা কানের লতি ছুলেই তল ছুতে পারবে পা। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? বালিশে মাথা রাখার মতো পেছনে হেলে দিলেন ঘাড়টা। শ্বাস ছাড়তে লাগলেন জলেই। হাত দুটোকে ভাসিয়ে দিলেন ডানার মতো। তারপর ডানা দুটো গুটিয়ে সিঁধিয়ে গেলেন জলের ভেতর। ঠিক যেমন ছুড়ে দিলে টুপুক করে হারিয়ে যায় ঢিল। কয়েকটি বুদবুদ পিপড়ের মতো জড়ো হয়ে মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
ঘোলা জলের বুধ ফুঁড়ে নেমে গেলে চোখ দুটো জ্বলে উঠল বাতির মতো। দম আটকে আরো গহিনে যাওয়ার চেষ্টা করলেন সরাফত। পারলেন না। খাটো হয়ে এলো দম। পড়ি কি মরি করে উঠে এলেন ওপরে। মাথাটা তুলে আকুপাকু করে শ্বাস নিলেন খাবি খাওয়া মাছের মতো। ঘনঘন শ্বাসে ফ্যার ফ্যার শব্দ হচ্ছে জলে। নাসারন্ধ থেকে গরম বাতাস তুলছে মৃদু ছন্দ। কিছু জল নাসারন্ধ গলিয়ে পৌঁছে যায় ভেতরে, নাসাপথে। তার ধার বেয়ে নেমে যেতে চায় গলবিলে। নাকটা দুহাতে চেপে ঝেরে বের করে দিতে চান ঢুকে পড়া জল। কিছুটা বেরোয়। কিছুটা রয়ে যায়। তাতেই সিঁদুরে দেখায় চোখ দুটো। দম নিয়ে আরো একবার ডুব দেন সরাফত। আরো একবার। হাতড়ে বেড়ান তল। খুঁজে ফেরেন ফ্রেমে বাঁধাই ছবিটা।
পর পর তিন ডুবে আরো খাটো হয়ে আসে দম। দুর্বল হয়ে পড়েন খানিকটা। ধীরে ধীরে। কিন্তু দমে গেলে তো চলবে না। যে করেই হোক স্পর্শ করতেই হবে তল। পাড় থেকে ঢালু বেয়ে এই পথে এসেই হয়তো থির হয়েছে ছবিটা। এখানেই কোথাও আছে। কেউ তো আর জানে না, যে তুলে নেবে। ফের বুক ভরে শ্বাস নেন সরাফত। শ্বাস ভরে নেন পেটেও। আবারো হাপুস ডুবে তলিয়ে যান। কেমন ভার ভার মনে হচ্ছে শরীরটা। দুর্বল হয়ে পড়েছেন, বুঝতে পারেন। ঘোলা পানিরা দল বেঁধে তাকে ঘিরে ফেলেছে যেন। তল অবধি পৌঁছতে দেবে না আর। না, হেরে গেলে চলবে না। তিনিও নাছড়। শত্রæর অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীন করেছেন দেশ। সামান্য জলের দেয়াল ভেদ করতে পারবেন না? এ কেমন কথা! জব্বারের বলীখেলার মতো মাংসল কাঁধ দুটো নুইয়ে মাথাটা চালান করে দেন জলের বুকে। হাজামজা গাছের ডালপালার স্তূপ ধরা দেয় চোখে। প্রায় বেরিয়ে যায় যায়, বুকে-পেটে জমা রাখা বাতাস।
সরাফত একনজরে তলদেশে চোখ বুলিয়ে ফের তুলে দেন মাথাটা। দীর্ঘ একটা শ্বাস উগড়ে দেন হিম জলে। যেন কেউ দুহাতে চেপে ধরেছিল কণ্ঠনালী। ছাড়া পেয়ে হাফ ছাড়লেন। অনেকটা নির্ভার মনে হচ্ছে তাকে। চকিতে তলদেশটায় যখন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন নজর কেড়েছে কিছু একটা। এক পা আগে পিছে নয়। ঠিক এই বরাবর ফের ডুবতে হবে তাকে।
কাছেধারে কোথায় কুপ্ কুপ্ কুপ্ করে ডেকে উঠল একটা কানাকুয়া। ডাকের রেশ ধরে পাখিটাকে খুঁজতে থাকেন সরাফত। একটু থেমে আবারো কুপ্ কুপ্ কুপু। পুকুরের পুবপাড়ের জামরুল গাছটার নিচু ডালটায় বসে আছে পাখিটা। দেখতে দাঁড়কাকের মতো। চঞ্চুটা অবিকল কাক। চকচকে কালোর ওপর হালকা নীল আভা ঝিলিক দেয় পৌষের মিঠে রোদে। উজ্জ্বল কালোর মধ্যে খয়েরি রঙের ডানা বেশ ফুটে আছে। যেন কালো কোর্তার ওপর খয়েরি কটি চাপানো বনেদি পুরুষ। খাড়া হয়ে ডানে হেলেছে দীর্ঘ কালো লেজটা। তিনি পাখিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। দূর থেকে জ্বলছে লাল চোখ দুটো। দেখতে দেখতে পাখিটা ফের উক্ উক্ উক্ শব্দে ধীর লয়ে ডেকে উঠে হারিয়ে গেল ঘনপাতার ফাঁকে।
আরেকটা ডুব দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরাফত। বুকে দম পুষে নিলেন আরো বেশি। যেন ফুরিয়ে না যায় সহজে। একনজর ঘোলা চোখে দেখা জিনিসটাকে লক্ষ্য করে ফের হারিয়ে গেলেন হাপুস ডুবে। তখনো মিলিয়ে যায়নি বুদবুদগুলো। জলের দেয়াল ফুঁড়ে চলছেন তিনি। জলের হাতগুলো এবার যেন আরো বেশি শক্তপোক্ত। পড়িমরি হয়ে তাকে রুখে দেয়ার চেষ্টা করছে। কাঁধ দুটো যেন ধরে ফেলেছে দুটো দানবীয় জলজ হাত। পেছন থেকে কপালটাকে কনুইয়ের ভাজে ফেলে আটকে দিতে চাইছে অসুরে শক্তি। পিঠের ওপর যেন চেপে বসেছে জলহস্তীর মতো কিছু একটা। যার ভারে ভেঙে যায় যায় শিরদাঁড়া। পা দুটো তো সেই কখন থেকেই ভাসছে শূন্যে। মনে হচ্ছে বেঁধে দেয়া হয়েছে শক্ত শিকলে। বাঁধা পা শূন্যে তুলে ধরেছে কোনো জলসিপাই। সরাফত আলীর দেহটা এখন সায়রের জলে ঘাই মারা তিমি মাছের মতো লম্বা হয়ে আছে। কাঁধের দানব, কপাল আকড়ে থাকা অসুরে শক্তি, পিঠের জলহস্তী, বাঁধা পা, জলসিপাইর বোঝাসহ দুহাতে জলের বুক চিড়ে নিচে নেমে যেতে থাকেন তিনি। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো জল ঢুকে পড়ছে নাসারন্ধ্রে। সেদিকে ভাবান্তর নেই সরাফতের। ধেয়ে যাচ্ছেন অতলস্পর্শের নেশায়। একটা সময় যখন তিনি সত্যি সত্যিই তলদেশে পৌঁছে গেলেন, দেখলেন, ভুল দেখেননি, দুধের সরের মতো কাদার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে অয়েলক্লথে মোড়া জিনিসটা। দু-হাতে ফ্রেমটা বুকে আকড়ে ধরে যখন ক্ষ্যান্ত হলেন, ততক্ষণে ফুরিয়ে এলো শরীরের সবটুকু শক্তিও। মরা মাছের মতো ঘোলাটে হয়ে এলো চোখ। কাঁধে, কপালে, পিঠে, পায়ে আকড়ে থাকা শক্তহাতগুলো তখন আলগা হচ্ছে আস্তে আস্তে। সব কেমন মহাকাশ যানের মতো শূন্যে ভেসে ভেসে সরে যাচ্ছে দূরে। পত্রিকায় ছাপা হওয়া নীল আর্মস্ট্রংয়ের ছবিটা ভেসে উঠছে চোখে। কঠিন পরিশ্রমের ক্লান্তিভার তার দেহে। রাজ্যের ক্লান্তি ভর করেছে ঘোলাটে চোখের পাতাতেও। সলিলের কোমল বিছানায় ধীরে ধীরে হেলে পড়ছেন তিনি। আহ্! গহনের অপার সুখ। কুপ্ কুপ্ কুপ্। কানাকুয়াটা ফের ডেকে উঠল আরেকবার। আরো একবার।
সরাফত আলী যখন ভেসে উঠলেন, তখন পুকুরপাড়ে পাড়া ভেঙে ঢল নেমেছে মানুষের। পায়ে পায়ে ঢাকা পড়েছে ঝরাপাতা, সবুজ ঘাস, ডুমুর, আকন্দের ঝোঁপ। মানুষের মতো একই সারিতে চলে এসেছে গাছগুলো। নাকি মানুষ দাঁড়িয়েছে গাছের সারিতে? সেদিকে খেয়াল নেই কারো। সবার চোখ পুকুরের ঘোলাটে জলে নিবব্ধ। দুজন সাঁতরে চলে গেছেন মাঝপুকুরে। যেখানে ভেসে আছেন সরাফত আলী, বুকে জাপটে ধরে কিছু একটা। ধরাধরি করে তোলা হলো ডাঙায়। পা দুটো তার জলকলমির লতায় জড়িয়ে আছে। যেন নিখুঁত হাতের কাজ। তখনো হাতদুটো শক্ত করে ভাজ করা বুকের ওপর। তার মাঝে অয়েলক্লথে মোড়ানো চৌকোণা জিনিসটা। হাত দুটো আলগা করে তা খসিয়ে নিলো কেউ একজন। একদল গোল হয়ে দাঁড়াল সারি ভেঙে। কেবল গাছগুলো দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁয়। পঁচন ধরেছে পাটের দড়ির বাঁধনে। ধরতেই আলাদা হয়ে গেল আঁশগুলো। জড়িয়ে রাখা অয়েলক্লথ কাদায় খেয়ে গেছে কোথাও কোথাও। ছিঁড়ে ফেলা হলো তা। বাঁধন গলিয়ে চুইয়ে চুইয়ে ঢুকেছে জল। ভিজে চুপষে গেছে চাদরটাও। সরিয়ে নেয়া হলো সেটিও। তারপর সবাই বিস্মিত নয়নে দেখলেন, কাঠের চারকোণা ফ্রেমে কাঁচে বাঁধাই করা এক মহাপুরুষ চেয়ে আছেন। তাঁকে চিনতে পারলেন সবাই। কেউ বললেন, ‘আমাগো মুজিবর।’ কেউ ডাকলেন, ‘মুজিব ভাই’। কারো মুখে ধ্বনিত হলো, ‘বঙ্গবন্ধু।’ দিনটি ছিল ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়