করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বাজিকরের খেলা রে মন

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কথা বলার সময় হরতনের মুখ থেকে মরা ইঁদুরের গন্ধ ভেসে আসছে, অথচ ওর মুখে মিষ্টি পান। কী অদ্ভুত!
এই মিষ্টি পান তালেবই ওকে কিনে দিয়েছে। কালাভুনা দিয়ে একপ্লেট ভাত মানেই শ’দুয়েকের ধাক্কা। আর ওই মিষ্টি পানের দরুন দশ দশটি টাকা এক্সট্রা খরচা হলো বলে মনের ভেতর একটু খচখচানি যে নেই তা নয়। তবে মায়া বলে একটা কথা আছে না? বন্ধু হরতনের ওপর মায়াটা যে তালেবের বরাবরই একটু বেশি, তা আর কে না জানে! হরতন তো জানেই। জানে বলেই বন্ধুর কাছে ধুম-ধাম ভালো-মন্দ খাওয়ার বায়নাও ধরে। যেমন আজ সে কালাভুনা আর ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খাওয়ার ইচ্ছেটা মোটেও চেপে রাখেনি। জানত, তালেব না করবে না। তবে কিনা মিষ্টি পানটা ওর জন্য বোনাস। আর বোনাস পেয়ে হরতনের চোখেমুখে খুশি যে উপচে পড়ছে, তা এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও যেন তালেব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু মরা ইঁদুরের গন্ধটা নাকে বড় বেশি ধাক্কা দিচ্ছে থেকে থেকে। এ গন্ধ গত কয়েক দিন ধরে যেন একটু বেশিই পীড়া দিচ্ছে তালেবকে। ওর মতো ঠাণ্ডা মানুষের মগজও গরম হয়ে যাচ্ছে। হয়তো সে কারণেই মিষ্টি পান মনের অজান্তেই কিনে দিয়েছে বন্ধুকে। জানে না তালেব।
থকথকে অন্ধকারে তালেব তাকায় হরতনের দিকে। মায়া লাগে।
লম্বা লম্বা ঠ্যাং-এ ড্যাংড্যাং করে চলতে চলতে অনর্গল কথা বলছে হরতন। ওর পরনের লুঙ্গি ফরফর করে হাওয়ায় উড়ছে। জ্যৈষ্ঠের চড়চড়ে গরমে রাতের বেলা নিঝুম মেঠোপথের দু’পাশের গাছ-গাছালির ঝিরিঝিরি হাওয়ায় গা জুড়িয়ে যায়। এই যেমন এখন যাচ্ছে। তা না হলে তো গরুর মাংসের কালাভুনা আর গুমসা গরম দুই বন্ধুর গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরাচ্ছিল।
তালেবের পরনে আঁটোসাঁটো জিন্স-টিশার্ট। তবে হরতনের লুঙ্গি ছাড়া চলে না। ওই লুঙ্গিই হাওয়ার ধাক্কায় উড়ছে থেকে থেকে। উড়ে এমনভাবে ওর নিম্নাঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে, অন্ধকারে কোনো লিকলিকে গেছো ভূত তড়বড়িয়ে হেঁটে চলেছে।
এ কথা মনে হতেই আপন মনে হেসে ফেলল তালেব। মনে মনেই ও-বলল, ‘গায়ে-পায়ে একফোটা মাংস না থাকলি ভূতের মতনই তো লাগবি তোরে! তাই না?’
ভুস করে একটা সাইকেল চলে গেল পাশ দিয়ে। তারপর ফটফট করতে করতে একটা ভটভটি মাটি কাঁপিয়ে ধেয়ে চলল সামনের দিকে। হরতনের বকবকানিটা ওটার আওয়াজে চাপা পড়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ওই আওয়াজটুকু দূরে মিলিয়ে যেতেই ভোমরার মতো কালো অন্ধকার আর নিস্তব্ধ পথ আবারও কথায় ভরিয়ে ভুলল হরতন।
তালেব বলল,
‘চপ থাকবার পারিস না। সবসময় এত বকবক ভাল্লাগে না।’
‘বকবক কি আর সাধে করি রে! দেখ, একফোটা জ্যোৎস্না নাই, কী আন্ধার!’
বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভয়ে কেঁপে উঠল হরতন।
‘আন্ধার তো কী? এমনভাবে কইতাছোস, য্যান জিন্দেগিতে রাইতে পথে বাইরাস না। রোজই তো রিকশা চালাইতে সদরে যাস, আর রাইত কইরা ঘরে ফিরোস।’
বিরক্ত হয়ে বলে তালেব।
‘হ, ফিরি তো রাইত কইরা। ডরও পাই। তয় কেউ না কেউ সাথে তো থাকেই। কিন্তু আইজ ডর একটু বেশিই লাগবার লাগছে।’
বলে আবারও কেঁপে ওঠে হরতন। কেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গলায় হাত চলে যায় ওর। দেখে মাদুলিটা নেই। ভয় পায় বলে সেদিন কোত্থেকে যেন বিউটি ওটা এনে গলায় বেঁধে দিয়েছিল। তার জন্যে বউয়ের এই উদ্বেগ দেখে বুকটা খুশিতে ভরে গেছিল হরতনের। নিজের অজান্তেই চোখ দুটোও কি ভিজে যায়নি? খুব গিয়েছিল! সেই ভেজা চোখ বিউটির থেকে কায়দা করে আড়ালও করেছিল।
কিন্তু কখন, কোথায় হারালো সেই মাদুলি? মনে মনে হায় হায় করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনিও যেন একটু জোর ধরলো হরতনের। বিউটিকে কী জবাব দেবে ভেবে লজ্জাও পেল খানিকটা।
বিউটি হরতনের বউ। নামেও বিউটি কামেও বিউটি, মানে চেহারা ছবি মারাত্মক রকমের ভালো। হরতন বলে বেহেশতী হুর। এই হুর যে ওর মতো হতভাগার কপালে কেমন করে জুটল, সে এক বিস্ময়। আর এ বিস্ময়ের কথা সে বন্ধু তালেবকে বলে বলে হয়রান করে দেয়। তার সাত-আট মাসের বিবাহিত জীবনে কম করে হলেও সাত-আটশো বার তালেবের কাছে বিস্ময়ের কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছে। এ-ও বলেছে, যতক্ষণ ঘরে থাকে ততক্ষণ বউকে আদর-সোহাগে মাখামাখি করে রাখতে চায়। কিন্তু বউটা কেন যেন স্বামীর এ বাড়াবাড়িতে খুব একটা পাত্তা দেয় না। হরতনের ধারণা, বউয়ের লজ্জা এখনো ভাঙেনি। ভাঙলে ঠিকই স্বামীর সোহাগের জন্যে ছটফট করবে।
এগুলো হরতনের মনের ভেতরের কথা। সুখের কথা। সুখের ভেতর খুব সূ² এক সুতোর মতো চিনচিনে দুখের কথা। কাউকে বলে না। কিন্তু ‘কেউ’ আর তালেব কী এক হলো?
হলো না।
হলো না বলেই সুখে-দুঃখে তালেব আছে হরতনের জন্যে। হরতনও আছে। কিন্তু ওই থাকা পর্যন্তই। তালেব যেভাবে হরতনের সবকিছুতে বুক পেতে দেয়, হরতন তো তা পারে না। পারে না বলতে ক্ষমতা নেই। না টাকা, না শরীরের জোর কোনোটাই বিশেষ জোরালো নয় হরতনের। রিকশা চালিয়ে আর ক’টাকা হয়! সেদিক থেকে তালেব জোরদার। হরতনের ভাষায় জোতদারও বটে। বন্ধুকে আহ্লাদ করে সে ও-নামেই ডাকে। দেখতেও একেবারে সিনেমার হিরোদের মতো। সদরে এক ছোট্ট মুদি দোকান থেকে ধাঁই করে মোটামুটি বড় এক গার্মেন্টসের দোকানের মালিক যে বন্ধু, দেখতে হিরো হিরো, সে জোতদার ছাড়া আর কী!
হরতনের জোতদার ডাকে তালেব মনে মনে ভীষণ মজা পেলেও মুখে কিছু বলে না। তার মূল কারণ, ও-মুখে কথা কমই বলে। সেই ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ স্বভাবের। একটু বড় হওয়ার পর যখন ট্রাক ড্রাইভার বাপকে হারাল, তখন থেকে আরো চুপচাপ হয়ে গেল। অবশ্য বাপের ড্রাইভারিটা রপ্তও করে ফেলেছিল অল্প দিনেই। কিন্তু তালেবের মা চায়নি ও ট্রাক চালাক। চায়নি, ট্রাক চালাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে বাপের মতো অকালে মরে যাক। মায়ের ইচ্ছেতেই বাপের রেখে যাওয়া টাকায় মুদি দোকান দিয়ে ভালোই চলছিল। তবে, ওই মুদিগিরি করে আর কতদিন? একটু উঁচুতে উঠতে, কয়টা বেশি টাকার মালিক হতে কে না চায়! তালেব তাই গার্মেন্টেসের দোকান খুলেছে। মেয়েদের জন্য তৈরি পোশাকের দোকান তার। বিক্রি ভালো। ইদানীং আবার বোরখা আর হিজাবের চাহিদা বেশি। রং-বেরঙের বাহারি বোরখা; রঙিন, বে-রঙিন হিজাব। দোকানের একটা সাইড তাই সে ওই জিনিসেই ভরে ফেলেছে। বাকিটুকুতে থ্রি-পিস, টু-পিস আর ছোট মেয়েদের ফ্রক। আজ ও-হাতে করে একসেট থ্রি-পিস নিয়ে যাচ্ছে। হরতনের বউকে দেবে। হালকা গোলাপি রঙের পোশাকটি যখন বিউটি তার বিউটিফুল শরীরে জড়াবে, তখন কল্পনায় যেন দেখতে পেল তালেব। দেখে শিরশির করে উঠল ওর ভেতর বাহির। হরতন বুঝি অনুভব করল সেটা। বলল,
‘তুইও আমার মতন ডরাইছোস বন্ধু? একটু য্যান কাঁপন ট্যার পাইলাম!’
বিরক্ত হয়ে তালেব বলল, ‘যেমন হাঁটতাছোস, তেমনই হাঁট। মুখ বন্ধ।’
‘আইচ্ছা, করলাম মুখ বন্ধ। তয় আইজ য্যান তোরে একটু অন্যরকম লাগবার লাগছে। কেমন য্যান অনচেনা অনচেনা ঠেকে।’
হরতনের কথা যেন তালেবের কানেই ঢুকল না। গুনগুন করে গান ধরল ও। ওর মনের ভেতর তখন বিউটির অভিমানী মুখ, ‘ক্যান এইসব আনতে গ্যালা। জামাকাপড় আছে তো। শাড়িও আছে নীল, লাল, বেগুনি’
অভিমান যেন তালেবেরও কিছু কম নেই। মুখ ভার করে বলে, ‘আছে তো কী! ইচ্ছা হইল আনলাম। না পরলে ফালায়া দাও।’
‘পরের বউয়ের ওপর এত দরদ ক্যান তোমার? ভালোবাসা?’
ঘোরের মধ্যে বলা বিউটির ওই ‘ভালোবাসা’ শব্দটি যেন সশব্দে আছড়ে পড়ল নিস্তব্ধ অন্ধকারে। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে উড়তে লাগল প্রতিটি অক্ষর। ভয় হলো তালেবের, হরতন শুনে ফেলল না তো! গেছোভূতটা যে বন্ধুকে খুব বিশ্বাস করে!
এক মুহূর্তের দুর্বলতা, তারপর আবারও শক্ত হলো তালেব।
কয়দিনেরই বা বন্ধুত্ব ওদের! বড় জোর ছয়-সাত বছর হবে। একই গাঁয়ে পাশাপাশি বাড়ি, কিন্তু বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে তো বছরও হয়নি! এই গাঢ়ত্ব তো!
যাকগে, ও-নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। বিউটি ওর। হরতনের মতো গেছোভূতের কোনো অধিকার নেই ওই বেহেশতী হুরকে ভোগ করার। ভালোবাসার তো নয়-ই। মনে মনেই, তীব্র এবং ভীষণই শীতল এক হাসি হাসল তালেব।
ঝনাৎ করে একটা সাইকেল এসে থামল ওদের পাশে। আরোহী বলল, ‘কে, তালেব নাকি? সাতে ক্যাডা? ওহ হো হরতন! আমিও যেমুন, হরতন ছাড়া আর কে হইবো!’
গাঁয়ের সবুর চাচা। প্রতিবেশী। লোক খারাপ না, তবে কথা একটু বেশিই বলে। কম কথা বলা তালেবের তাই তাকে কোনোকালেই পছন্দ নয়। এড়িয়েই চলে। এখনো এড়িয়ে চলতেই কোনো কথা বলল না ও। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে থামিয়ে দিল খলবল করতে চাওয়া হরতনকেও। এখনই ঘোরটুকু কেটে যাক, তা চায় না তালেব। এই মুহূর্তে ঘোরটুকু বড় প্রয়োজন। নির্জন অন্ধকার রাত ঘোরটুকুকে আঁকড়ে কতকিছুই করে ফেলতে পারে!
কিন্তু সাইকেল আরোহী ওদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে না গিয়ে পাশাপাশি চলতে থাকে। চলতে চলতে নিত্যপণ্যের বাজার যে কত চড়া, তাই নিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ থাকে।
‘ত্যালের দাম নাকি আরো বাড়বো, তোমরা শুনছো কিছু?’
অন্ধকারে বোঝা যায় না, সবুর চাচা কার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়েছে। ওরা কেউ-ই গা করে না। চাচাজিও গা করে না। একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ছে তো ছুড়ছেই। হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এল পরীর খালের কাছে।
গাঁয়ের পথে এই খালের বিস্তর বদনাম।
লোকমুখের নানা কাহিনী অনুযায়ী রাত নামলেই নাকি খালটি হয়ে ওঠে জ্বিন-পরীদের আখড়া। দিনের আলো নিভে গেলেই ওই জ্বিন-পরীরা পথ ভুলে আসা মানুষকে টেনে নেয় খালের গভীরে। আলো নিভলে তাই এ পথে সহজে কেউ যেতে আসতে চায় না। একটু ঘুরপথে গাঁয়ে ফেরাই নিরাপদ মনে করে সবাই।
কিন্তু তালেবের এ নিয়ে কোনোদিনই মাথাব্যথা নেই। ও দিনে কী রাতে এই খালপাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে বসে হাওয়া খায়। কখনো কখনো হরতনও সঙ্গে থাকে। আজও তেমন ইচ্ছেতেই এ পথে আসা। সদর থেকে ফেরার সময় হরতনকে বলেছেও সে কথা। আর বন্ধু সঙ্গে থাকলে হরতন তো কোনো কিছুতেই আপত্তি জানায় না।
ওরা তিনজন হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে, বকবক করতে করতে কখন যে এ পথেই চলে এসেছে, তা সাইকেল ঝনাৎ করা সবুর চাচা বুঝতেই পারেনি।
‘আয় হরতন, খালপাড়ে বইসা একটু হাওয়া খায়া ঘরে ফিরি।’
আচমকা তালেবের এমন কথায় হুঁশ ফেরে তার। বলে,
‘হায় হায়, এ কী সর্বনাশের কথা! এই পরীর খালের ধারে ক্যামনে আইলাম? আর তুমিও বাবা কেমুন মানুষ, এইখানে হাওয়া খাওনের কথা কও!’
‘আপনের ডর করলে আপনি যান গিয়া। কে আটকায়?’
তালেবের প্রায় ধমকের সুরে বলা এই কথায় চাচাজি কেমন দিশেহারার মতো এদিক-ওদিক খানিকক্ষণ তাকিয়ে সাইকেল নিয়ে ছুট দেয়। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তালেব। বাঁচার আনন্দেই যেন ধপ করে বসে পড়ে খালপাড়ের জঙ্গল ফুঁড়ে আকাশে ওঠা তালগাছের গোড়ায়। হে-হে করে হাসতে হাসতে হরতনও বসে পড়ে ওর পাশে। তালেব ধমক দেয়, ‘ছাগলের মতন হাসিস ক্যান? চোপ!’
চুপ মেরে যায় হরতন।
করকর শব্দে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। ঝিরিঝিরি হাওয়া জঙ্গলের মধ্যে তুলছে মৃদু আলোড়ন। এই আলোড়নে অন্ধকার হয়ে বসে আছে দুটো ছায়ামূর্তি। চুপচাপ। খালের পানি থেকে থেকে ঝিলিক দিচ্ছে। আকাশে চাঁদ উঠল কী? নাকি থকথকে আন্ধার কখন, কোন অবসরে ওদের চোখে সয়ে গেছে? দুধসাদা জ্যোৎস্নাকে ভেবে নিয়ে ওরা কি যে যার মতো ভেসে যাচ্ছে?
ভাসতে ভাসতে হরতন ভাবছে বিউটির মুখ। আর তালেব? সে-ও তো বিউটির মুখটিই ভাবছে! ভাবছে, আর আরো বেশি করে ঘোরে ডুবে যাচ্ছে।
ডুবতে ডুবতেই ও -ডেকে ওঠে, ‘হরতন!’
বহুক্ষণ পর হরতন আবারও কেঁপে ওঠে। ভেবে নেয়া দুধসাদা জ্যোৎস্নায় তাকায় বন্ধুর দিকে। কেমন যেন অন্য মানুষ মনে হয় তালেবকে। তাহলে কি তালেব নয় ওটা? ভয়ে ভয়ে ও-হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে যাবে, ঠিক এমন সময়েই ভয়ানক এক ঢেকুর ওঠে ওর। কালাভুনা, মিষ্টি পান আর মরা ইঁদুরের মিশ্রিত একটা গন্ধ ওই ঢেকুর থেকে বেরিয়ে জ্যোৎস্নায় মিশে যাওয়ার আগেই তালেব ওর বাড়িয়ে দেয়া হাতটি ধরে ফেলে। ধরে কতক্ষণ বসে থেকেছে, নাকি দাঁড়িয়ে থেকেছে খেয়ালই নেই। একসময় অনুভব করে, কেমন যেন ঠাণ্ডা! যেন কোনো মৃত মানুষের হাত।
ঝট করে ওই হাত ছেড়ে দিয়ে তালেব উঠে দাঁড়ায়। ওর অজান্তেই হাতটি জল এবং জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
ও-ভয় পায়। কিন্তু ভয় কেন পাচ্ছে ও? সেই কোন ছোটবেলায়ই তো তালেব সব ভয়কে তাড়িয়ে দিয়েছে মন থেকে! নিজেকে সাংঘাতিক রকমের শক্ত আর ঠাণ্ডা মানুষ বলে মনে মনে দাবিও করে। সেই শক্তির জোরেই তো বিউটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে হরতনকে এই খালপাড়ে।
ভেবে নেয়া জ্যোৎস্না বোধহয় আরো একটু বেড়েছে। ঝিরিঝিরি হাওয়াও দমকে দমকে ছুটে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। ছুটে ছুটে জ্যোৎস্না মেখে খালের জলে ছুরি চালাচ্ছে অদৃশ্য তৎপরতায়। ঘোরের মধ্যে থেকেও তালেব অনুভব করল, এখন অনেক রাত। আর হরতনের বেহেশতী হুর বিউটি; না না, শুধুই তালেবের বিউটি, অন্ধকারে, একদম একা!
পরীর খালের ওপর থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল তালগাছের চ্যাপ্টা পাতাগুলোও যেন হঠাৎই তুমুল নড়াচড়া করে তা-ই জানান দিল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়